সারা দেশের মাদ্রাসাসমূহ

মাওলানা শামসুল হক দৌলতপুরী রাহ. এর জীবন সংগ্রাম

May 15 2019, 05:27


Manual7 Ad Code

লিখেছেন- মাওলানা শাহ আসগর আলী 

শিক্ষা ও জ্ঞান দ্বার যারা দেশ ও জাতিকে করেছেন আলোকিত, সমাজ ও মুসলিম উম্মাহকে দিয়েছেন হেদায়াতের দিক নির্দেশনা, কোরআন ও হাদীসের আলোকে নিজের জীবন গড়ে যারা সমাজে নিজেকে ইসলামী আদর্শরূপে প্রতিষ্ঠিত করেছেন, তাদেরই একজন শায়খুল হাদীস আল্লামা শামসুল হক দৌলতপুরী রাহ.।

বহুগুণের অধিকারী এবং গভীর জ্ঞানের আধার ছিলেন তিনি। একাধারে তিনি ছিলেন প্রখ্যাত হাদীস বিশারদ, তাফরিকারক, বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ, লেখক ও সাহিত্যিক।

কোরআন ও হাদীসের বর্ণনা অনুযায়ী একজন মুত্তাকী ও ওলীর যা গুণাবলী রয়েছে, তা সবই মরহুম শায়খুল হাদীস ওয়াত্ তাফসীর রাহ.’র মধ্যে বিদ্যমান ছিল। তিনি একজন আত্মপ্রচার বিমুখ লোক ছিলেন। অত্যন্ত সহজ-সরল ও সাদাসিদে জীবন যাপন করতেন তিনি। লৌকিকতার লেশমাত্র ছিলনা তাঁর মধ্যে। নির্লোভ ও নিরঅহঙ্কার মহামনিষী ছিলেন তিনি। সদা সর্বদা সুন্নত পাবন্দের আদর্শ প্রতিচ্ছবি তিনি ছিলেন। কোরআনে হাফেয ছিলেন না বটে, তবে সর্বদাই কোরআন তেলাওয়াতরত থাকতেন তিনি। সর্বক্ষণ অযুর সাথে অবস্থান করতেন। সামান্য ফুরসতেই নফল নামায পড়তেন তিনি।

Manual6 Ad Code

শায়খুল হাদীস আল্লামা শামসুল হক রাহ. বি-বাড়ীয়া জেলার নাসিরনগর থানাধীন দৌলতপুর গ্রামের এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে আনুমানিক ১৯২৯-৩০ খ্রিস্টাব্দের ঈদুল আযহার দিন সুবহে সাদেকের সময় জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম মিজায আলী, মাতার নাম কুরতন বিবি।

পারিবারিক পরিবেশে অতি অল্প সময়ে তিনি পাঠশালার লেখাপড়া ও মক্তবের শিক্ষা শেষ করেন। পাঠশালা সমাপনী পরীক্ষায় অত্যন্ত কৃতিত্বের সাথে বৃত্তি লাভ করে বাল্যকালেই তিনি মেধার স্বাক্ষর রাখেন। অতপর দ্বীনের একজন খাটি আলেম বানানোর লক্ষ্যে তাঁর পরহেযগার পিতা নিকটবর্তী এক মাদরাসায় ভর্তি করে দেন। সেখানে তিনি আরবী, উর্দূ ও ফার্সীর সাথে বাংলাও অধ্যয়ন করেন। এ সময় তাঁর পিতার ইন্তেকাল হয়। এরপর স্নেহময়ী মাতা ও দাদা আব্দুল গণীর তত্ত্বাবধানে তাঁর লেখাপড়ার কাজ চলতে থাকে। এখানে লেখাপড়া শেষ হওয়ার পর ঢাকার হুসাইনিয়া আশরাফুল উলূম বড় কাটারা মাদরাসায় তাঁকে ভর্তি করে দেয়া হয়। সেখানে তিনি একাধারে ৮বছর অধ্যয়ন করে কৃতিত্বের সাথে দাওরায়ায়ে হাদীসের সনদ লাভ করেন।

অতপর উচ্চতর শিক্ষা ও জ্ঞান লাভের জন্য তিনি পান্জাবের প্রসিদ্ধ মাদরাসা খায়রুল মাদারিসের উদ্দেশ্যে সুদূর পাকিস্তান গমন করেন। সেখান থেকে তিনি অত্যন্ত কৃতিত্বের সাথে কোরআন ও হাদীস এবং ফুনূনাতের উপর প্রথম শ্রেণীতে উচ্চতর ডিগ্রী লাভ করেন।

Manual5 Ad Code

তাঁর উস্তাদদের মধ্যে উল্লেখযোরা হচ্ছেন হাকীমুল উম্মাত হযরত থানবী রাহ.’র বিশিষ্ট খলিফা হযরত খায়ের মুহাম্মদ রাহ., দেওবন্দের সাবেক শায়খুল হাদীস হযরত শরীফ কাশ্মীরী রাহ., মাওলানা আব্দুল ওয়াহাব পীরজী হুজুর রাহ. ও শায়খুল হাদীস হযরত মাওলানা ওয়াহিদুজ্জামান রাহ. প্রমুখ।

তখনকার সময়ের উপমহাদেশের শীর্ষস্থানীয় আলেম ও পীর-মাশায়েখের সুহবতে থেকে ইলমে-দীন হাসিল করে তিনি একজন খাঁটি আলেম ও জ্ঞানতাপস হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেন। দীনি ইলম প্রচার-প্রচার করা ছিলো তার জীবনের লক্ষ্য ও সাধনা। তাই তিনি শিক্ষকতার মাধ্যমে তার কর্মজীবনের সূচনা করেন এবং মৃত্যুর পূর্বপর্যন্ত এই মহান খেদমতের মাঝে নিজেকে নিয়োজিত রাখেন।

Manual3 Ad Code

তিনি হবিগঞ্জ জেলার চুনারুঘাট থানাধীন শাহপুর মাদরাসার পরিচালক হিসেবে স্বাধীনতার পূর্বপর্যন্ত প্রায় দশবছর দায়িত্বপালন করেন। তখনকার সময়ে ওই মাদরাসা হবিগঞ্জের সর্ববৃহৎ দীনিপ্রতিষ্ঠান এবং হাদীসের দরসলাভের একমাত্র মাদরাসা ছিলো। কওমী মাদরাসার পাশাপাশি তিনি সে সময় চাটপাড়া আলিয়া মাদরাসাও উচ্চপর্যায়ের কিতাবাদির ক্লাস নিতেন। অতঃপর স্বাধীনতা উত্তরকালে সিলেটের বালাগঞ্জ এলাকায় ঐতিহ্যবাহী দারুস সুন্নাহ গলমুকাপন মাদরাসায় তাকে কেন্দ্র করে হাদীসের সর্বোচ্চপর্যায়ের শ্রেণি দাওরায়ে হাদীস খোলা হয়। সেখানে তিনি বহু বছর তিরমিযী শরীফসহ তাফসীরের উচ্চপর্যায়ের বিভিন্ন কিতাবাদির দরসপ্রদান করেন।

এমনিভাবে আরো অনেক মাদরাসায়ই হযরত দৌলতপুরী রহ.কে কেন্দ্র করে ইলমে-দীনের সর্বোচ্চপর্যায়ের শ্রেণি দাওরায়ে হাদীস খোলা হয়। তন্মধ্যে হবিগঞ্জের কাসিমুল উলুম বাহুবল মাদরাসা, কিশোরগঞ্জের ভৈরব মাদরাসা এবং ঢাকা মিরপুর ১২ নম্বরে অবস্থিত মাদানিয়া আরাবিয়া মাদরাসা ইত্যাদি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। তাছাড়া সাধারণ দীনদার মুসলমানদেরকে সরাসরি কুরআন-হাদীস থেকে উপকৃত করার লক্ষে তিনি যেখানে অবস্থান করতেন সেখানকার মসজিদে দরসে কুরআন ও দরসে হাদীস পরিচালনা করেছেন।

rokimg_20151205_107141ইলমে-দীনের দরসপ্রদানের পাশাপাশি লেখালেখিও করতেন। একসময় মাসিক মদীনা ও মাসিক আদর্শ নারীতে নিয়মিত ও ধারাবাহিক লিখতেন। ইসলামিক ফাউন্ডেশন কর্তৃক সংকলিত ও প্রকাশিত ইসলামী বিশ্বকোষেও তিনি লিখেছেন। এছাড়াও গুরুত্বপূর্ণ ও তাত্ত্বিক ইসলামী গ্রন্থাবলীর লেখক তিনি। তার লিখিত আহকামসম্বলিত কুরআনে কারীমের পাঁচশত আয়াতের উপর বাংলাভাষায় প্রথম মৌলিক তাফসীরগ্রন্থ ‘তাফসীরে আহকামুল কুরআন’ এবং ইসলামিক ফাউন্ডেশন প্রকাশিত ‘তাফসীর শাস্ত্র পরিচিতি ও ‘হাদীস শাস্ত্র পরিচিতি’ নামক গ্রন্থাবলী পাঠক মহলে ব্যাপক গ্রহণযোগ্যতা অর্জন করে। এছাড়াও তার লিখিত ও প্রকাশিত বইগুলো হচ্ছে ‘টেলিভিশনের লাভ-ক্ষতি’ মাসায়েলে রমযান ও ‘পকেট মাসনুন দুয়া’ ইত্যাদি। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সীরাতবিষয়ক একখানা অমূল্য গ্রন্থসহ আরো বেশকিছু অপ্রকাশিত মূল্যবান গ্রন্থ রয়েছে।

মাওলানা শামসুল হক দৌলতপুরী রাহ. নিজ গ্রামের ঈদগা মাঠের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ও ইমাম ছিলেন। সে হিসেবে প্রতিবার ঈদের আগের দিন তিনি বাসা থেকে রওনা হয়ে গ্রামে চলে যেতেন। প্রতি বছরের মত ১৪৩১ হিজরির ১০ জিলহজ, ৩ অগ্রহায়ণ ১৪১৭ বাংলা এবং ১৭ নভেম্বর ২০১০ খৃস্টাব্দ বুধবার অনুষ্ঠিতব্য ঈদুল আযহার নামায পড়ানোর উদ্দেশ্যে গ্রামে চলে গেলেন। কিন্তু তাহাজ্জুদের নামায শেষে বসা থেকে দাঁড়ানোর সময় হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে যায় এবং হাসপাতালে নেয়ার পথে সকাল ৮টা ৩০ মিনিটে আল্লাহর নাম উচ্চারণ করতে করতে ইহজগৎ ত্যাগ করেন। যে মাঠে তিনি সকাল ৮টা ৩০ মিনিটে ঈদের নামায পড়ানোর কথা সে মাঠেই রাত ৮টায় তার জানাযার নামায পড়ানো হয়। আর কাকতালীয় ব্যাপার হলো, মরহুম মাওলানার জন্মও ঈদুল আযহার দিন সুবহে সাদিকের সময় হয়েছিলো। মুত্যুকালীন তিনি ছেলে-মেয়ে এবং স্ত্রীসহ হাজার হাজার ছাত্র-ছাত্রী, আত্মীয়-স্বজন ও গুণগ্রাহী রেখে গেছেন। আল্লাহতায়ালা তাকে জান্নাতে উচ্চ মাকাম দান করুন। আমিন!

Manual2 Ad Code

সূত্র. কওমীনিউজডটকম

Spread the love

Manual1 Ad Code
Manual8 Ad Code