সারা দেশের মাদ্রাসাসমূহ

প্রিন্সিপ্যাল মাওলানা হাবিবুর রহমান রহ. এর বর্ণাঢ্য জীবন

November 08 2018, 04:42

Manual4 Ad Code

লিখেছেন- মুহাম্মদ আব্দুল হামিদ>

সেই জীবন ধন্য, যে জীবন বহু গুণে গুণান্বিত। এমন একটি জীবন নিয়েই বলতে চাচ্ছি, যা শুধু একটি নামই নয়; বরং একটি নাম, একটি চেতনা, একটি বিপ্লব, একজন সিংহপুরুষ, একজন লৌহমানব, সর্বোপরি একটি ইতিহাস। আমি সেই ব্যক্তির কথা বলছি, যিনি ছিলেন এদেশের তৌহিদী জনতার হৃদয়ের স্পন্দন। বিশ্ব বরেণ্য ইসলামী গবেষক। অগণিত আলেমের উস্তাদ। অপকৃষ্টির বিরুদ্ধে আপোষহীন সিপাহসালার। হ্যা, এমন এক কিংবদন্তির কথা বলছি, যিনি হচ্ছেন কীর্তিমান এক মহাবীর প্রিন্সিপাল আল্লামা হাবীবুর রহমান (রহ.)।

Manual2 Ad Code

তিনি ছিলেন একাধারে ইসলামী আন্দোলনের অগ্রজ নেতা, তুখোর রাজনীতিবিদ, শিক্ষাবিদ, সংগঠক, লেখক, ও গবেষক। দ্বীনি শিক্ষার অগ্রগতি ও আদর্শ জাতি গঠনের নেতৃত্ব এবং বিভিন্ন আন্দোলন-সংগ্রামে তাঁর অবদান অবিস্মরণীয়। ধর্মদ্রোহী ও অপ-শক্তির বিরুদ্ধে তাঁর আওয়াজ ছিল বলিষ্ট। যার গর্জনে কেঁপে উঠতো বাতিলের তখতে তাউস। তিনি ছিলেন স্পষ্ঠভাষী। সভা-সমাবেশে তাঁর বক্তব্যের ভাষা ছিল তেজদ্ব্যীপ্ত। ব্যক্তি হাবীবুর রহমান তিলে তিলে হয়ে উঠেছিলেন জনতার হাবীবুর রহমান হিসেবে। তাঁর বৈশিষ্ট্য ছিল তিনি যেখানেই বক্তব্য দিতেন সেখানেই লোকে-লোকারণ্য হয়ে যেত। এমনও দেখা যেত যে, তিনি কোন ওয়াজ মাহফিল বা সমাবেশে গেছেন যেখানে মানুষের সংখ্যা খুব কম ছিল, কিন্তু  যখনই তিনি বক্তব্য শুরু করতেন, সাথে সাথে মানুষের উপস্থিতিতে সভা-সমাবেশ কানায় কানায় পরিপূর্ণ হয়ে যেত। তাঁর জানাযায়ও একই চিত্র ফুটে উঠেছিল। তিনি ছিলেন আন্দোলন-সংগ্রামে রাজপথের এক বিপ্লবী জননেতা। সামনের কাতারে থেকে যিনি নেতৃত্ব দিতেন। কারো রক্তচক্ষু পরোয়া করতেন না। সেকারণেই তাঁকে বলা হতো রাজপথ কাঁপানো সিংহপুরুষ। যখনই কোন বাতিল শক্তি মাথাঝাড়া দিয়ে উঠত, তখনই প্রিন্সিপাল হাবীব (রহ.) মাথায় পাগড়ী বেঁধে সৈনিকের বেশে রাজপথে ঝাঁপিয়ে পড়তেন। চক্রান্তের শিকার হয়েছেন, আলোচিত-সমালোচিতও হয়েছেন বহুবার। আন্দোলন-সংগ্রামের কারণে একাধিকবার কারাবরণ করেছেন দ্বীনের এই রাহবার। সকল বাধার পাহাড় ডিঙ্গিয়ে সাফল্য চিনিয়ে আনতেন আপোষহীন এই বিপ্লবী সিপাহসালার।

শাহজালালের পূণ্যভুমি, আধ্যাত্মিক রাজধানী সিলেটের পবিত্রতা রক্ষায় তিনি ছিলেন এক বীর সেনানী। শুধু সিলেট নয়, বাংলার ৫৬ হাজার বর্গমাইল পেরিয়ে বহির্বিশ্বেও তাঁর হুংকার বাতিলের মসনদ কাঁপিয়ে দিত। দ্বীনের খেদমতে তিনি ছিলেন নিবেদিতপ্রাণ। যিনি ধর্মদ্রোহী নাস্তিক-মুরতাদদের আতঙ্ক ছিলেন। তিনি বলেছিলেন, “আমার শরীরের শেষ রক্তবিন্দু দিয়ে হলেও এদেশ থেকে নাস্তিক-মুরতাদদের বিতাড়িত করবো।” এই লক্ষ্যে তিনি সাহাবা সৈনিক পরিষদের ব্যানারে সিলেটে অসংখ্য সভা-সমাবেশ ও তীব্র আন্দোলন গড়ে তুলে দেশ ব্যাপী আলোড়ন সৃষ্টি করেছিলেন। তিনি শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করার পূর্বপর্যন্ত দেশের ধর্মদ্রোহী নাস্তিক-মুরতাদ বিরোধী আন্দোলনে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছেন।

বিগত চার দশকে ধর্মদ্রোহী ও ইসলাম বিরুধী অপ-শক্তির বিরুদ্ধে আন্দোলন-সংগ্রাম করে তৌহিদী জনতার মধ্যমনি হয়ে উঠেন। ১৯৮৭-৮৮ সালে তরুণ হাবীবুর রহমানের আন্দোলন-সংগ্রামের তীব্রতায় নাস্তিক দাউদ হায়দার, সরদার আলাউদ্দিন এবং ১৯৯৩-৯৪ সালে নারীবাদী লেখিকা নাস্তিক তসলিমা নাসরিন নির্বাসনে যেতে বাধ্য হয়েছিল। এছাড়াও শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় হলের নাম করণ, ওপেন কনসার্ট, মদের আড্ডা ও জুলুম-নির্যাতনের বিরুদ্ধে যে কোন আন্দোলন-সংগ্রামে সামনের কাতারে থেকে নেতৃত্ব দিতেন শ্রদ্ধেয় উস্তাদ প্রিন্সিপাল আল্লামা হাবীবুর রহমান (রাহ.)।

Manual2 Ad Code

জন্ম : জীবন পথের ক্লান্তি বিহীন এই বিপ্লবী বীর ১৯৪৫ সালে সিলেটের গোলাপগঞ্জ উপজেলার ফুলবাড়ি ইউনিয়নের ঘনশ্যাম গ্রামের এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে জন্ম গ্রহণ করেন। তাঁর পিতা মাওলানা মাহমুদ আলী দীর্ঘদিন সিলেটের হাওয়াপাড়া জামে মসজিদের ইমাম ও খতীব ছিলেন ।

Manual3 Ad Code

শিক্ষা জীবন : প্রিন্সিপাল আল্লামা হাবীবুর রহমান (রহ) ফুলবাড়ি ইউনিয়নের বইটিকর প্রাইমারি স্কুল থেকে প্রাথমিক শিক্ষা লাভ করেন। এরপর কিছুদিন রুস্তুমপুর কওমী মাদরাসায় পড়ালেখা করে ইলমে দীনের শিক্ষায় অনুপ্রাণিত হন। এরপর তিনি ভর্তি হন ফুলবাড়ী আলীয়া মাদরাসায়। ১৯৭০ সালে ফুলবাড়ি মাদরাসা থেকে ফাযিল পাশ করেন। ১৯৭৩ সালে সিলেট সরকারী আলীয়া মাদরাসা থেকে কৃতিত্বের সহিত কামিল পাশ করেন।

কর্ম জীবন: বাংলার সূর্যসন্তান, এদেশের আলেম সমাজের অহংকার, সিংহপুরুষ, প্রিন্সিপাল আল্লামা হাবীবুর রহমান (রহ.)’র রয়েছে বর্ণাঢ্য এক কর্মময় জীবন। ১৯৭৩ সালে কাজির বাজার পেয়াজ হাটা মসজিদের ইমাম ও খতীব হিসেবে তিনি কর্মজীবন শুরু করেন। ১৯৭৪ সালের জুন মাসে তিনি সুরমা নদীর তীরে ঐতিহ্যবাহী জামেয়া মাদানিয়া কাজির বাজার মাদরাসা প্রতিষ্ঠা করেন। শিক্ষাবিদ প্রিন্সিপাল আল্লামা হাবীবুর রহমান (রহ.) দারুল উলুম দেওবন্দের আদলে প্রতিষ্টিত জামেয়া মাদানিয়ার শিক্ষা পদ্ধতিতে মাদরাসার মূল নেসাবের পাশাপাশি আধুনিক শিক্ষার সমন্বয়ে সিলেবাস প্রণয়ন করে কওমী শিক্ষার ক্ষেত্রে যুগপথ পরিবর্তন আনার চেষ্টা করেন। তিনি কওমী সনদের সরকারি স্বীকৃতি আদায়ের আন্দোলনে হযরত শায়খুল হাদিস (রহ.) এর সাথে সামনে থেকে নেতৃত্ব দেন। আমৃত্যু সিলেটের ঐত্যিবাহী জামেয়া মাদানিয়া কাজির বাজার মাদরাসার প্রিন্সিপালের দায়িত্ব পালন করেন। লেখালেখিতেও তার গুরুত্বপূর্ণ অবদান রয়েছে। তিনি ‘বিশ্বনবীর ডায়েরী’ নামে একটি সিরাত গ্রন্থ রচনার পাশাপাশি উন্নত চরিত্র ও ঈমান জাগানিয়া বহু গ্রন্থ রচনা করেন। আলেম সমাজের মধ্যথেকে একদল যোগ্য লেখক তৈরি করা ছিলো তাঁর জীবনের অন্যতম সাধনা। সে লক্ষ্যে তিনি মাদরাসায় মাসিক ও বার্ষিক কাফেলা বের করতেন। প্রবন্ধ রচনা, কবিতা ও সাহিত্যের প্রতি তিনি তাঁর ছাত্রদের অনুপ্রাণিত করতেন।

রাজনৈতিক জীবন: প্রিন্সিপাল আল্লামা হবীবুর রহমান (রহ.)’র রাজনৈতিক জীবনের সুত্রপাত হয়েছিলো জমিয়তে যুগদানের মাধ্যমে। ১৯৭৭-৮১ পাঁচ বছর সিলেট জেলা জমিয়তের সেক্রটারি জেনারেল ছিলেন। পরে মাওলানা মুহাম্মদুল্লাহ হাফেজ্জী হুজুর (রহ.) কর্তৃক খেলাফত আন্দোলন প্রতিষ্ঠিত হলে তিনি এতে যোগ দেন। খেলাফত আন্দোলন ভেঙ্গে শায়খুল হাদীস আল্লামা আজীজুল হক (রহ.) বাংলাদেশ খেলাফত মজলিস প্রতিষ্ঠা করলে তাতে যোগ দিয়ে তিনি শায়খুল হাদিসের সংস্পর্শে আসেন। পর্যায়ক্রমে বাংলাদেশ খেলাফত মজসিলের আমির নির্বাচিত হন। ২০১২ সালে ইসলামি ঐক্যজোটের চেয়ারম্যান ও বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসের আমির শায়খুল হাদিস আল্লামা আজিজুল হক (রাহ.) মৃত্যুবরণ বরণ করার পর দলের আমির নিযুক্ত হন। শিক্ষা ও নেতৃত্বে তাঁর অসামন্য কৃতিত্বের কারণে ২০১৬ সালের ডিসেম্বর মাসে লন্ডনের ক্রাউন প্লাজায় এক ঐতিহাসিক সম্মেলনে আন্তর্জাতিক “এ্যানুয়াল কমিউনিটি লিডারশিপ” এ্যাওয়ার্ড লাভ করেন।
ব্যক্তিগতভাবে হুজুর ছিলেন আমার প্রাণপ্রিয় উস্তাদ। আমার বাবা মরহুম দানাউর রহমান (রহ.) এর সাথে হুজুরের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক ছিলো। এরই সুবাদে প্রিন্সিপাল হুজুর আমাদেরকে নিজ সন্তানের মত মহব্বত করতেন। বাবার ইন্তেকালের পর বলতে গেলে তিনিই ছিলেন আমাদের অভিভাবক, আমাদের রাহবার। আন্দোলন-সংগ্রামের পাশাপাশি আধ্যাত্মিকতায়ও তিনি ছিলেন অনন্য। রাসূলের সুন্নতের প্রতি ছিলেন খুবই যতœবান। তিনি ছিলেন আল্লামা আবদুল জলীল বদরপুরী (রহ)’র খলিফা। সর্বদা আল্লাহর যিকিরে ধ্যানে মগ্ন থাকতেন। সৌখিন, সুশৃঙ্খল, পরিচ্ছন্ন জীবনযাপনের অধিকারী ছিলেন প্রিন্সিপাল আল্লামা হাবীবুর রহমান (রহ.)। কতই না সম্মানিত সেই ব্যক্তি! যার খ্যাতি দিগন্ত জুড়ে বিস্তৃত। যার কারুকার্যে ধনাঢ্যতার রহস্য নিহিত। যার বদান্যতা সৌন্দর্য্য বর্ধন করে। নেতৃত্ব সন্তুষ্ট করে। তার তুলনা তিনি নিজেই।

Manual8 Ad Code

মৃত্যু : তৌহিদী জনতার হৃদয়ের স্পন্দন প্রিন্সিপাল আল্লামা হাবীবুর রহমান (রহ.) ১৯ অক্টোবর ২০১৮ ইংরেজি শুক্রবার রাত সাড়ে ১২ টায় মানুষ যখন বেডরুমের বৈদ্যুতিক বাতি নিভিয়ে ঘুমে মগ্ন হতে যাচ্ছিল, ঠিক তখনই ইসলামপ্রিয় মুসলিম জনতাকে স্তব্ধ করে স্ত্রী, চার ছেলে, তিন মেয়ে ও অসংখ্য শিষ্য এবং গুণগ্রাহী রেখে নশ্বর পৃথিবী ছেড়ে ইশ্বরের ডাকে পরপারে পাড়ি জমান। কে জানতো! ঘরের বৈদ্যুতিক বাতি নিভানোর সাথে সাথে মাথার উপর থেকে নিভে যাচ্ছে দিগন্ত বিস্তৃত এক উজ্জল নক্ষত্র। পরিশেষে, ১৯ অক্টোবর শুক্রবার বিকেল সাড়ে তিনটায় সিলেটের আলীয়া মাদরাসা মাঠে তাঁর জানাযা অনুষ্ঠিত হয়। তাঁর ঐতিহাসিক জানাযায় ধর্মপ্রাণ মুসলিম জনতার ঢল নামে। দেশ-বিদেশের অসংখ্য ভক্ত, অনুসারী ও শিষ্যদেরকে শোকের সাগরে ভাসিয়ে তাঁর প্রতিষ্ঠিত মাদরাসার বাগানে চিরনিদ্রায় শায়িত হন প্রিন্সিপাল আল্লামা হাবীবুর রহমান (রহ.)। কীর্তিমান এই রাহবার মরেও অমর হয়ে থাকবেন। আল্লাহ তাঁকে জান্নাতের সুউচ্চ মাকাম দান করুন। আমীন

Spread the love