সারা দেশের মাদ্রাসাসমূহ

আল্লামা আব্দুল করিম শায়েখে কৌড়িয়া রহঃ এর সংগ্রামী জীবন

November 07 2018, 06:07

শায়খে কৌড়িয়া রাহ. ছিলেন সেসব ক্ষণজন্মা মানুষদের একজন, যিনি বৃটিশ শাসন থেকে পাকিস্তান, ভারত এবং সর্বশেষ বাংলাদেশে দ্বীনের সেবায় আতœনিয়োজিত ছিলেন। দারুল উলুম দেওবন্দ যে ক’জন মনীষির জন্ম দিয়েছিলো শায়খ রাহ. ছিলেন তাঁদের অন্যতম
শায়খে কৌড়িয়া রাহ. ছিলেন সেসব ক্ষণজন্মা মানুষদের একজন, যিনি বৃটিশ শাসন থেকে পাকিস্তান, ভারত এবং সর্বশেষ বাংলাদেশে দ্বীনের সেবায় আতœনিয়োজিত ছিলেন। দারুল উলুম দেওবন্দ যে ক’জন মনীষির জন্ম দিয়েছিলো শায়খ রাহ. ছিলেন তাঁদের অন্যতম।
এই মহান ব্যক্তিত্ব সিলেট জেলার উত্তর বিশ্বনাথের কৌড়িয়া পরগণার খাজাঞ্চী ইউনিয়নের গমরাগুল গ্রামে ১৯০১ ঈসায়ী সনে এক ধার্মিক পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন।

বংশ পরিচয় :
হযরত শাহজালাল মুজাররাদে ইয়ামনী রাহ.’র নেতৃত্বে আগত ৩১৩ জনের ইয়ামনী কাফেলার একজন হচ্ছেন সায়্যিদ বাটাউক রাহ.। তাঁর ঔরসে জন্মগ্রহণ করেন সায়্যিদ মুতিউর রহমান ও সায়্যিদ আতাউর রহমান। হযরত শায়খে কৌড়িয়া রাহ. হচ্ছেন তাঁদের বংশের অধস্তন কীর্তিমান পুরুষ। তাঁর পিতার নাম আল্লামা আব্বাস আলী। আব্বাস আলী রাহ. একাধারে পীর, সমাজ সংস্কারক, ওয়ায়েজ, মুবাল্লিগ, মুনাযির, রাজনীতিবিদ, লেখক ও সাহেবে কারামত বুযুর্গ ছিলেন। হায়াতে আব্বাসী গ্রন্থে হযরত শায়খে কৌড়িয়া রাহ.’র বংশ পরিচয় এভাবে তুলে ধরা হয়েছে ; সায়্যিদ আব্বাস আলী ইবনে সায়্যিদ কালীমুল্লাহ ইবনে সায়্যিদ নাজীবুল্লাহ ইবনে সায়্যিদ মাহদী ইবনে সায়্যিদ শাহাবুদ্দীন ইবনে সায়্যিদ গোরখান। উল্লেখ্য যে হযরত শায়খে কৌড়িয়া রাহ. তদীয় নামের অগ্রভাগে কিংবা পিছনে কখনো সায়্যিদ লিখতেন না।

শিক্ষাজীবন :
হযরত শায়খে কৌড়িয়া রাহ.’র সম্মানিতা মাতা ছিলেন একজন আবিদা,সালিহা ও শিক্ষিতা মহিলা। মাতা-পিতার তত্ত্বাবধানে পারিবারিক ভাবে তাঁর শিক্ষা জীবনের সূচনা হয়। পারিবারিক শিক্ষা সমাপ্ত হলে তাঁর পিতা পার্শ্ববর্তী হাজীগঞ্জ কওমী মাদরাসায় তাঁকে ভর্তি করে দেন। হযরত আব্বাস আলী রাহ. কলকাতা আলীয়া মাদরাসার শিক্ষিত হলেও সরকারি মাদরাসা শিক্ষিতদের চাল-চলন, চিন্তা-চেতনা, পোশাক-পরিচ্ছেদ এমনকি সেই শিক্ষারও বিরোধী ছিলেন। কিছুদিন পর মাদরাসাটি সরকারিকরণ হয়ে গেলে তিনি তাঁর পুত্রকে ফুলবাড়ি কওমী মাদরাসায় ভর্তি করে দেন। ফুলবাড়ি মাদরাসাও সরকারিকরণ হয়ে গেলে তাঁকে করিমগঞ্জের ঝড়ো কওমী মাদরাসায় ভর্তি করে দেন। হযরত শায়খে কৌড়িয়া রাহ. ছিলেন অত্যন্ত মেধাবী ও প্রখর স্মৃতিশক্তির অধিকারী। করিমগঞ্জের ঝড়ো কওমী মাদরাসায় অত্যন্ত কৃতিত্বের সাথে সেখানকার শিক্ষা সমাপ্ত করে ভারতের জামিয়া ইসলামিয়া আমরোহা মাদরাসায় চলে যান। সেখানে নামায পড়াতে সুবিধা হবে বিবেচনায় তাঁর উস্তাদ মাওলানা ফয়াজ আলী রাহ. কুআনের শেষ মঞ্জিল মুখস্ত করার জন্য বললে তাহফিযুল কুরআনের প্রতি তাঁর আগ্রহ বৃদ্ধি পায়। তিনি হিফয শুরু করে মাত্র এক বছরে পূর্ণ কুরআন মুখস্থ করেন।

জামিয়া ইসলামিয়া আমরোহাতে তিনি আল্লামা কাসিম নানুতুবী রাহ.’র অন্যতম শিষ্য শায়খুল হাদীস আল্লামা হাফিয আবদুর রহমান আমরোহী রাহ.’র নিকট বুখারী ও তিরমিযী শরীফ অধ্যয়ন করে ১৯২৩ খৃস্টাব্দে দেশে প্রত্যাবর্তন করেন।
শায়খে কৌড়িয়া রাহ.’র পিতা আব্বাস আলী রাহ.’র সাথে শায়খুল ইসলাম মাদানী রাহ.’র অত্যন্ত সুসম্পর্ক ছিলো। কথিত আছে যে মাদানী রাহ. নয়াসড়ক মসজিদে আব্বাস আলী রাহ.কে দিয়ে মাঝে মধ্যে বয়ান করাতেন। হযরত মাদানীর চাল-চলন, আমল-আখলাক দেখে আব্বাস আলী রাহ. মুগ্ধ হয়ে যান। স্বীয় পিতার মাধ্যমে মাদানী রাহ.’র সাথে কৌড়িয়া রাহ.’র প্রাথমিক সম্পর্কের সূত্রপাত হয়।
শায়খুল ইসলাম মাদানী রাহ. ১৯২৪ থেকে ১৯২৮ খৃস্টাব্দ পর্যন্ত সিলেটের নয়াসড়কস্থ খেলাফত বিল্ডিং এ হাদীসের দারস প্রদান করেন। ১৯২৮ সালে দারুল উলুম দেওবন্দ কর্তৃপক্ষ তাঁকে দেওবন্দের শায়খুল হাদীস পদে নিয়োগ প্রদান করলে তিনি খেলাফত বিল্ডিং থেকে চলে যান। শায়খে কৌড়িয়া রাহ. ও উচ্চ শিক্ষার উদ্দেশ্যে তাঁর সাথে দেওবন্দ গমন করে ১৯২৯ সালে দাওরায়ে হাদীসে ভর্তি হন। তাঁর লেখাপড়া, চাল-চলন, স্বভাব-চরিত্র দেখে সকল আসাতিযায়ে কেরাম তাঁকে অত্যন্ত স্নেহ করতেন। বিশেষত: পরীক্ষাসমূহে মেধা তালিকায় বিশেষ স্থান অর্জন করতে সক্ষম হওয়ায় সবার দৃষ্টি তাঁর প্রতি নিবদ্ধ হয়। তিনি প্রায় কিতাবাদিতে মোট ৫০ নাম্বারের মধ্যে ৫৫/৬০ নাম্বার অর্জন করতেন। দারুল উলূমের মেধা তালিকায় হাতেগোনা যে ক’জন বাংলাদেশী ছাত্র নাম লিখিয়েছেন তাঁদের মধ্যে শায়খে কৌড়িয়া রাহ.’র নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
১৯২৯-১৯৩১ ইংরেজী তিন বছর সেখানে হাদীস ও ফুনুনাতের বিভিন্ন বিষয় অধ্যয়ন করে দেশে প্রত্যাবর্তন করেন। দারুল উলূম দেওবন্দে অধ্যয়নরত অবস্থায় ক্বারী তায়্যিব রাহ. তাঁকে দারুল উলূম মসজিদের নাইবে ইমাম নিযুক্ত করেন। শায়েখ রাহ. বলেছেন- হাকীমুল ইসলাম ক্বারী তায়্যিব রাহ., শায়খুল আদব আল্লামা এযায আলী রাহ., হযরত ইবরাহীম বলিয়াভী রাহ.সহ অন্যান্য আসাতিযায়ে কেরামের উপস্থিতিতে তিনি কয়েকবার জুমআর নামাযে ইমামতি করেছেন।

পেশাগত জীবন :
দেওবন্দ থেকে প্রত্যাবর্তনের পর স্বীয় পিতার নির্দেশে ১৯৩৩ সালে জামিয়া ইসলামিয়া রাজাগঞ্জ, কানাইঘাটে প্রধান হাফিয ও পরিচালক হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন। ১৯৬২ ঈসায়ী পর্যন্ত প্রায় ৩০ বছর রাজাগঞ্জ জামিয়ার সাথে জড়িত ছিলেন।
১৯৫৩ ঈসায়ী সালে হযরত শায়খের আব্বা আব্বাস আলী রাহ. ইন্তেকাল করেন। ইন্তেকালের পূর্বে তিনি স্বীয় পুত্রকে রাজাগঞ্জ থেকে বাড়িতে চলে যাওয়ার নির্দেশ দিলে শায়খ রাহ. বলেন- আমি বাড়িতে আসলে আমার খোরাক দিতে হবে। আব্বাস আলী রাহ. খোরাক কি জানতে চাইলে বলেন- বাড়িতে একটি মাদরাসা করে দিতে হবে। আব্বাস আলী রাহ. খুশিমনে তাঁর ছেলে-মেয়েদের একত্রিত করে বাড়ির পশ্চিম পার্শে একটি মাদরাসা, মসজিদ, মুসাফিরখানা নির্মাণের জন্য কয়েক বিঘা জমি ওয়াকফ করে এলাকাবাসীকে আহ্বান করেন। এবং হযরত শায়খ রাহ.কে উক্ত ওয়াকফ স্টেটের মুতাওয়াল্লী নিযুক্ত করেন। ওয়াকফকৃত ভূমির উপর পরবর্তীতে আব্বাস আলী রাহ.’র নামে মাদরাসা প্রতিষ্ঠিত হয়। যা কৌড়িয়া মাদরাসা নামে পরিচিত।

আধ্যাত্মিক জীবন :
হযরত শায়খে কৌড়িয়া রাহ. শায়খুল ইসলাম মাওলানা হুসাইন আহমদ মাদানী রাহ.’র নিকট বায়আত গ্রহণ করে ইজাযাত প্রাপ্ত হন।
হযরত শায়খে কৌড়িয়া রাহ. আত্মপ্রচারকে কখনো পছন্দ করতেন না। তাই প্রচারণামূলক যে কোন বিষয় স্বযতেœ এড়িয়ে চলতেন। ফলে তাঁর মুরীদানের সংখ্যা তুলনামূলকভাবে অনেক কম। সাধারণ লোকদের তুলনায় আলিম-ওলামাগণ তাঁর কাছে বেশি বায়আত গ্রহণ করতেন।
খেলাফত ও ইজাযাতের ব্যাপারে তাঁর নীতি ছিল অত্যন্ত কঠোর। সুবিদবাজার ফাজিলচিস্ত এলাকার মরহুম সুলেমান খান সাহেবের মসজিদে প্রতি বছর রমযান মাসে মুরীদানরা এ’তেকাফ করার উদ্দেশ্যে সমবেত হতেন। পুরো মাসের নামাযের মধ্যে একাধিকবার কুরআন শরীফ খতম করা হতো। অন্যান্য মামুলাতও চলতো। রমজানের শেষদিকে যাদের সবক সমাপ্ত হতো, তাদের ইজাযাত প্রদান করতেন।

উল্লেখযোগ্য কয়েকজন খলীফা :
শায়খুল হাদীস মাওলানা রিয়াছত আলী চৌঘরী রাহ., হযরত মাওলানা আশরাফ আলী বিশ্বনাথী রাহ., শায়খুল হাদীস মাওলানা ওয়ারিছ উদ্দীন হাজিপুরী রাহ., হযরত মাওলানা তাহির আলী তৈপুরী রাহ., হযরত মাওলানা শফিকুল হক আকুনী রাহ., শায়খুল হাদীস মাওলানা মকদ্দস আলী দা.বা., শায়খুল হাদীস মাওলানা হুসাইন আহমদ বারকুটি দা.বা., শায়খুল হাদীস মাওলানা মুহিব্বুল হক গাছবাড়ি দা.বা., শায়খুল হাদীস মাওলানা শিহাবুদ্দীন দা.বা., শায়খুল হাদীস মাওলানা জিল্লুর রহমান দা.বা., শায়খুল হাদীস মাওলানা মাহমুদুল হাসান দা.বা., শায়খুল হাদীস মাওলানা আব্দুল হান্নান দা.বা., শায়খু হাদীস মাওলানা নাযির হোসাইন দা.বা., শায়খুল হাদীস মাওলানা আব্দুল মুসাব্বির দা.বা., শায়খুল হাদীস মাওলানা মাসউদ আহমদ দা.বা. প্রমুখ।

রাজনৈতিক জীবন :
হযরত কৌড়িয়া রাহ.’র উস্তাদ ও মুর্শিদ শায়খুল ইসলাম মাদানী রাহ. বৃটিশ খেদাও আন্দোলন ও অখণ্ড ভারতের দাবীতে জমিয়তে উলামায়ে হিন্দের নেতৃত্বে আন্দোলন করছিলেন। হযরত মাদানী রাহ. দেশব্যাপী তাঁর ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা শিষ্যদের নিজ নিজ অবস্থান থেকে আন্দোলনকে জোরদার করার লক্ষ্যে কাজ করার আহ্বান জানালে হযরত কৌড়িয়া রাহ. রাজনীতিতে পদার্পণ করেন।
আল্লামা মুশাহিদ বায়মপুরী, শহীদ শামসুল ইসলাম শেরপুরী, আল্লামা রিয়াছত আলী চৌঘরী, আল্লামা আব্দুল মতীন ফুলবাড়ি, মুজাহিদে মিল্লাত শায়খে বাঘা রাহ. প্রমুখ শীর্ষস্থানীয় উলামায়ে কেরামদের সাথে মিলে বৃটিশবিরোধী আন্দোলনের কাজ করতে থাকেন। কিন্তু বাংলাদেশের অধিকাংশ মানুষ মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ’র পাকিস্তান নীতির পক্ষে অবস্থান নিলে শায়খুল ইসলাম মাদানী রাহ.’র অখণ্ড ভারত ফর্মুলা সফলতার মুখ দেখেনি।

১৯৪৭ সালে পাকিস্তান স্বাধীনতা লাভ করলে হযরত কৌড়িয়া রাহ. জমিয়তে উলামায়ে ইসলামের সাথে জড়িয়ে পড়েন এবং ১৯৬৬ সালে পূর্ব পাকিস্তান জমিয়তের সভাপতি নির্বাচিত হন। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর দীর্ঘদিন জমিয়তের রাজনৈতিক তৎপরতা বন্ধ ছিল। পরবর্তীতে ১৯৭৪ ঈসায়ী সালে জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম বাংলাদেশ গঠন করা হয়। তখন থেকে ১৯৮৪ পর্যন্ত কখনো তিনি সভাপতি, উপদেষ্টা কিংবা অন্য কোনো দায়িত্ব আঞ্জাম দেন। ১৯৮৪ সাল থেকে ইন্তেকালের পূর্ব পর্যন্ত সবক’টি কাউন্সিলে তিনি সর্বসম্মতিক্রমে সভাপতি নির্বাচিত হন। দলবদলের রাজনীতিতে তিনি বিশ্বাস করতেন না। কখনো সভাপতি থেকে সহ-সভাপতি নির্বাচিত হওয়ার পরও দল ত্যাগ করা কিংবা আভ্যন্তরীণ ফাটল সৃষ্টির চেষ্টা করেননি। সবসময় বলতেন “খুলুসিয়্যাত আর লিল্লাহিয়্যাত ছাড়া সব কাজই অনর্থক।”
চট্টগ্রামের মাওলানা সিদ্দিক আহমদ সাহেব বলতেন “আমরা সবাই কমবেশি ধোঁকা খেয়েছি; কিন্তু মাওলানা আব্দুল করীমকে কেউ কোনদিন ধোঁকা দিতে পারেনি।”

মাদরাসা শিক্ষার প্রসারে তাঁর অবদান :
শায়খুল ইসলাম মাদানী রাহ.’র নির্দেশে প্রতিষ্ঠিত হয় বাংলাদেশ কওমী মাদরাসা শিক্ষাবোর্ড ‘আযাদ দ্বীনী এদারায়ে তালীম বাংলাদেশ’। শায়খে কৌড়িয়া রাহ. দীর্ঘ প্রায় পঞ্চাশ বছর আযাদ দ্বীনী এদারার সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন। এদারার প্রয়োজনে দেশের আনাচে-কানাচে সফর করতেন। অসাধারণ ইলমী যোগ্যতা এবং এদারার সভাপতি হওয়ার পরও বোর্ডের হিফয বিভাগের পরীক্ষা তিনি নিজেই নিতেন। তাঁর নেতৃত্বের প্রতি এদারাভূক্ত মাদরাসার আলিম-উলামার ছিলো পূর্ণ আস্থা। নয়তো অর্ধ শতাব্দীকাল ধরে একটি প্রতিষ্ঠানের দায়িত্বে থাকা সম্ভব ছিলো না।

পারিবারিক জীবন :
এক স্ত্রী ইন্তেকালের পর আরেকজন, এভাবে পর্যায়ক্রমে তিনি পাঁচটি বিয়ে করেন। শায়খ রাহ.’র প্রথম শ্বশুরবাড়ি ছিলো কুলাউড়া থানার বরমচাল ইউনিয়নের নন্দেনগর। দ্বিতীয়, চতুর্থ ও পঞ্চম শ্বশুরবাড়ি রাজাগঞ্জের মাস্টার বাড়ি এবং তৃতীয় শ্বশুরবাড়ি গোলাপগঞ্জের চৌঘরী গ্রামে ছিলো। তাঁর মোট সন্তানাদি চব্বিশ। এদের মধ্যে বর্তমানে উনিশজন জীবিত আছেন।

মাদানী পরিবারের সাথে সম্পর্ক :
শায়খুল ইসলাম হুসাইন আহমদ মাদানী রা.’র সাথে তাঁর আত্মার সম্পর্ক ছিলো। জীবনভর মাদানী রাহ.’র আদর্শের উপর অবিচল ছিলেন। মাদানী রাহ.ও তাঁকে অত্যন্ত মুহাব্বাত করতেন। মাদানী রাহ.’র সাথে শায়খ রাহ.’র এতো সুদৃঢ় সম্পর্ক ছিলো যে, শায়খের আকদ পড়ানোর জন্য মাদানী রাহ. সিলেট থেকে রানাপিং পৌঁছে সেখান হতে হেঁটে রাজাগঞ্জ গিয়ে বিয়েতে অংশ নেন। যে কোন স্থানে মাদানী রাহ. উপস্থিত থাকলে নামাযের ইমামতি তিনিই করতেন। কিন্তু অনেক সময় মাদানী রাহ. শায়খে কৌড়িয়া রাহ.কে ইমাম বানিয়ে নামায আদায় করেছেন। এজন্য উলামাদের কাছে তিনি ইমামে মাদানী উপাধিতে ভূষিত হয়েছিলেন। দারুল উলূম দেওবন্দে পড়ার সময় শায়খ রাহ. একবার টাইফয়েডে আক্রান্ত হলে মাদানী রাহ. তাঁকে দেখার জন্য প্রতিদিন তাঁর কামরায় আসতেন।

শায়খুল ইসলাম রাহ. যখন ইন্তেকাল করেন তখন শায়খ রাহ. রাজাগঞ্জ ছিলেন। ইন্তেকালের সংবাদ শুনে অস্থির হয়ে ভারত যাওয়ার জন্য ২ দিন পর্যন্ত নদীর ঘাঁটে বসেছিলেন। মাদানী রাহ.’র প্রতি তাঁর ভালোবাসা এতো তীব্র ছিলো যে জানিশীনে শায়খুল ইসলাম আল্লামা আসআদ মাদানী রাহ. বাংলাদেশে আসলে সব কাজ ফেলে মাস, অর্ধমাস পর্যন্ত দেশের আনাচে-কানাচে স্বীয় শায়খের পুত্রকে নিয়ে সফর করতেন। আসআদ মাদানী রাহ.ও শায়খকে অত্যন্ত মুহাব্বাত করতেন। আম্মু বর্ণনা করেন- “ফেদায়ে মিল্লাত রাহ. যখন বাংলাদেশ সফর শেষ করে ফিরে যেতেন, কয়েকদিন পর্যন্ত শায়খ রাহ.’র মন খুবই খারাপ থাকতো। দেখলে মনে হতো কি যেনো তিনি হারিয়ে ফেলেছেন।
মাদানী পরিবারের সদস্যদের কাছে তিনি পরিবারের একজন হয়ে ওঠেছিলেন। শায়খে কৌড়িয়া রাহ.’র এক খলীফা বর্ণনা করেন- মাদানী রাহ.’র ইন্তেকালের পর যখন দেওবন্দ যেতেন, শায়খুল ইসলাম রাহ.’র মেয়েদের জন্য অলঙ্কারসহ পরিবারের সবার জন্য হাদিয়া নিয়ে যেতেন। ফেদায়ে মিল্লাত আল্লামা আসআদ মাদানী রাহ. তখন ছোট ভাই-বোনদের কাছে বলতেন- বাংলাদেশ থেকে তোমাদের ভাই আবদুল করীম হাদিয়া নিয়ে এসেছেন।

অজানা কিছু কথা :
হাদীস শাস্ত্রে এতো যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও শায়খ রাহ. কখনোই হাদীস অধ্যাপনার সাথে জড়িত হননি। দেওবন্দ থেকে প্রত্যাবর্তনের পর (স্মারক গ্রন্থের তথ্য অনুযায়ী) প্রায় ত্রিশ বছর রাজাগঞ্জ মাদরাসার দায়িত্বে ছিলেন। তবে শুরুতে কয়েক বছর হিফয বিভাগের খিদমাত করার পর ব্যস্ততা বেড়ে গেলে আর পড়ানো হয়নি।

হাদীসের খিদমাতে কেন অংশ নেননি এ ব্যাপারে কেউ প্রশ্ন করলে শায়খ রাহ. বলতেন- দেওবন্দ থেকে প্রত্যাবর্তনের পর দেশের লোকদের মধ্যে হিফযের প্রতি অনাগ্রহ দেখে আমি হিফয বিভাগের খিদমাত করার সিদ্ধান্ত নেই। তবে শায়খ রাহ.’র খলীফা শায়খুল হাদীস আব্দুল হান্নান শায়খে পাগলা বর্ণনা করেন যে, শায়খ রাহ. তাঁর বিশেষ মহলে এ ব্যাপারে বলতেন- দেওবন্দ থেকে আসার পর সত্যিকারার্থে পড়ার মতো আগ্রহী ছাত্র নাকি খুঁজে পাননি। অবশ্য ব্যক্তিগতভাবে মাওলানা ওয়ারিসুদ্দীন হাজীপুরী রাহ., মাওলানা মুফতী জমশেদ আলী লালারচকী (চেয়ারম্যান) রাহ.সহ অনেক প্রখ্যাত আলিম হাদীসের কিতাবাদি তাঁর কাছে অধ্যয়ন করেছেন।
নিয়মিত তাহাজ্জুদ পড়তেন। আমার এখনো মনে আছে, রমযান মাসে দেখতাম সারাদিন বারান্দায় বসে তিলাওয়াত করতেন। এক অযু দিয়ে একাধিক ওয়াক্ত নামায আদায় করতেন। ঘরে থাকলে নিজ হাতে কুমড়ো বা আনারসের মুরব্বা তৈরি করতেন। খুব ভালো করে বড় মাছ ভাজতে পারতেন। এছাড়া সবধরণের রান্নার কাজও জানতেন। ঘরের ভেতরের অংশের সাথে বাইরের বেশ দূরত্ব ছিলো। মেহমান আসলে নিজ হাতে ভেতর থেকে খাবার-দাবার নিয়ে আসতেন। সময়ের প্রতি অত্যন্ত গুরুত্ব দিতেন। সফরে যাওয়ার দিন নির্ধারিত সময়ের অনেক আগেই তৈরি হয়ে বসে থাকতেন। কেউ সময়ের প্রতি অবহেলা করলে রাগ করতেন। এমনকি সফর বাতিল পর্যন্ত করে দিতেন। আমি নিজে কয়েকবার তাঁর সাথে তৈরি হয়ে শেষ পর্যন্ত কাপড় খুলে রেখেছি। আমাদের সবচেয়ে বড় বোন বলতেন- আব্বাজান অত্যন্ত শৌখিন ছিলেন। যখন ইস্ত্রির প্রচলন ছিলো না, টিফিনের বাটিতে কয়লা নিয়ে ইস্ত্রি করে কাপড় পরতেন। নিয়মিত সুগন্ধি ব্যবহার করতেন।

অমলিন কিছু স্মৃতি :
আমার ১০ বছর বয়সে ইন্তেকাল করেন আব্বু। দুর্ভাগ্য বলতে হবে যে, খুব বেশি দিন তাঁর সংস্পর্শ পাইনি। তবে যেটুকু পেয়েছি তা কিছুটা হলেও আগামীর পথচলায় সাহায্য করবে বলে আমার বিশ্বাস। সবার ছোট ছিলাম বলে হয়তো সবচেয়ে বেশি ভালোবাসতেন। অত্যন্ত ব্যস্ততা সত্ত্বেও প্রায় প্রতিটা ঈদে আমাকে নিয়ে কাপড় কিনতে যেতেন। এখন মনে হয় চাইলেই তো কাউকে দিয়ে আনিয়ে দিতে পারতেন। কিন্তু বাবার সাথে ঈদের বাজার করতে কেমন লাগে সেই অনুভূতি থেকে হয়তো বঞ্চিত করতে চাননি। অনেক দুষ্টুমি করতাম। কিন্তু কখনো প্রহার করেছেন বলে মনে পড়ে না। মনে আছে আমি তখন বাসার কাছাকাছি একটি মাদরাসায় পড়ি। কোনদিন মাদরাসায় যেতে না পারলে দরখাস্ত লিখে দিতেন। একবার ব্যস্ততার জন্য বড় বোনকে ডেকে লিখে দেয়ার জন্য বললেন। আরবী কিংবা উর্দু ভাষায় লিখতেন বলে আমি বুঝতাম না, কি লিখেছেন। তবে এটুকু ধারণা হয়ে গিয়েছিলো, আব্বু লিখে না দিলে হবে না। ফলে আপুর লিখে দেয়াতে আমি সন্তুষ্ট হলাম না। শেষে তিনি লিখে দিলেন। এভাবে বিভিন্ন সময় দুষ্টুমি করেছি; কিন্তু তিনি সব হাসিমুখে সহ্য করেছেন। সামান্য বুঝতে শিখেছি মাত্র; প্রতিদিন হাত খরচের জন্য আমায় পাঁচ টাকা দিতেন। শুক্রবারে তাঁর হাত ধরে মসজিদে যেতাম। এখনো মনে আছে সবসময় ২য় তলার ডানদিকের জানালার কাছে বসতেন। শুক্রবার এলেই দশ টাকা দিয়ে পাঁচ টাকা মসজিদে দেয়ার জন্য বলতেন। শেষদিকে যখন মসজিদে যেতে পারতেন না; প্রত্যেক শুক্রবারে মসজিদে টাকা দেয়ার কথা মনে করিয়ে দিতেন। এখনো শুক্রবার এলেই মনে পড়ে আব্বা যেনো বলছেন- “নিজে পাঁচ টাকা খেয়ো আর মসজিদে পাঁচ টাকা দিয়ো।” পরীক্ষার ফলাফল বের হলে তাঁর কাছে নিয়ে আসতাম। উৎসাহ দেয়ার জন্য দেখেই কখনো ২০ কখনো ৩০ টাকা দিতেন। একটু বড় হওয়ার পর বলতাম ২০/৩০ টাকা কম। আরো দিতে হবে। ফলে ৫০ টাকাও দিতেন। এছাড়া নতুন টাকা হাতে আসলে ডেকে ডেকে ঘরের প্রত্যেককে দিতেন।
যখন কুরআন শরীফ তিলাওয়াত করতেন, কখনো কখনো আমি পাশে বসে খেলা করতাম। একদিন বায়না ধরলাম, আমায় কুরআন শরীফ কিনে দিতে হবে। আমিও পড়বো। তখন একটা ব্যাগ থেকে আকারে বেশ ছোট রোলবিহীন তাঁর বাল্যকালের কুরআন শরীফ দিয়ে বললেন- আমি এই কুরআন দিয়ে হিফয করেছিলাম। এটা তোমার থাকুক। দুর্ভাগ্য বলতে হয় যে, তাঁর ইন্তেকালের পর আমি সেই কুরআন শরীফ রাখতে পারিনি। কেউ একজন আমার কাছ থেকে নিয়ে গেছেন।
এখনো তাঁর সংস্পর্শে কাটানো আমার শৈশবের প্রতিটি মুহূর্তকে জীবন্ত মনে হয়। এখনো অনুভূত হয় তিনি বিছানায় শুয়ে আছেন। আমি হাতের মধ্যে হাত রেখে পাশে বসে আছি। যদি বাস্তবিক এমনটি ঘটতো!

মাওলায়ে হাকিকীর ডাকে আপন পথে যাত্রা :
২০০০ সাল থেকেই সফর পুরোপুরি বন্ধ করে দেন। তবে বার্ধক্য ব্যতিত অন্য কোন রোগ ছিলো না। প্রতিদিন দেখা করতে লোকজন আসতেন। সবার সাথেই হাসিমুখে কথা বলতেন। নভেম্বর ২০০১ সামান্য জ্বর দেখা দিলে ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী ওষুধ চলতে থাকে। কফের সমস্যা ধীরে ধীরে বেড়ে যায়। তবে সবার সাথে ভালোভাবেই কথা বলতেন। সেদিন ছিল ১২ নভেম্বর ২০০১ ঈসায়ী। দ্বিপ্রহরের সময় পরিবারের সবার সামনে কালিমা পড়তে পড়তে মাওলায়ে হাকীকির ডাকে সাড়া দিয়ে পরপারে পাড়ি দেন শায়খ রাহ.। ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন।
পরদিন আলিয়া মাদরাসা ময়দানে সুযোগ্য পুত্র হাফিয মুহসিন আহমাদের ইমামতিতে জানাযার নামায অনুষ্ঠিত হয় এবং পৈত্রিক নিবাস ইসলামাবাদে তাঁকে আপন পিতা শায়খ আব্বাস আলী সাহেবের কবরের পাশে সমাহিত করা হয়।

লেখক : মাওলানা মাসুম আহমেদ, সাহেবযাদায়ে শায়খে কৌড়িয়া রাহ.

Spread the love