সারা দেশের মাদ্রাসাসমূহ

হজরত মুহাম্মদ উল্লাহ হাফেজ্জী হুজুর (রহ.) এর সংক্ষিপ্ত জীবন দর্শন

September 15 2019, 04:28

Manual4 Ad Code
উপমহাদেশের প্রখ্যাত বুজুর্গ ও আলেমে দ্বীন হজরত মাওলানা মোহাম্মদ উল্লাহ হাফেজ্জী হুজুর (রহ.) ১৮৯৫ সালে লক্ষীপুর জেলার রায়পুর থানাধীন লুধুয়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন।

শেষ জীবনে রাজনীতির মাঠে এসে তিনি আলোড়ন সৃষ্টি করেন। হাফেজ্জী হুজুরকে তওবার রাজনীতির প্রবর্তক বলা হয়। তিনি সব মত ও পথের রাজনৈতিক নেতাদের লক্ষ্য করে বলেছিলেন- আসুন, মন থেকে সব ধরনের কলুষতা মুছে তওবা করে দেশ-মাতৃকার উন্নয়নে রাজনীতিতে আত্মনিয়োগ করি। তিনি দেশবাসীকে কোরআনের আয়াত উল্লেখ করে এ আহবান জানান। তওবা প্রসঙ্গে কোরআনে কারিমে ইরশাদ হয়েছে, ‘হে ঈমানদারগণ! তোমরা আল্লাহর কাছে তওবা করো, নিশ্চয়ই তোমরা কামিয়াব হবে।’ -সূরা নূর : ৩১

Manual1 Ad Code

রাজনীতি হাফেজ্জী হুজুরকে ব্যাপক পরিচিতি দিলেও পবিত্র কোরআন নিয়েই ছিল তার যাবতীয় ভাবনা-চিন্তা ও সারা দিনের কর্মব্যস্ততা। তিনি ভাবতেন কিভাবে দেশের প্রতিটি গ্রামে কোরআনের আলো পৌঁছে দেওয়া যায়, কিভাবে শিশু-কিশোররা সহজে কোরআনের জ্ঞান লাভ করতে পারে। এ জন্য যিনি বারবার বলতেন, ৬৮ হাজার গ্রামে ৬৮ হাজার মক্তব প্রতিষ্ঠার কথা।

শিক্ষাজীবন
হাফেজ্জী হুজুর (রহ.) শৈশবে নিজ গ্রামের অদূরে ফতেপুর প্রাইমারি স্কুল থেকে উচ্চ প্রাইমারি পাস করে চন্দ্রগঞ্জ মাদ্রাসায় এক বছর পড়াশোনা করেন। কুমিল্লার লাকসামে নওয়াব ফয়জুন্নেসা চৌধুরানীর মাদ্রাসায় আরো এক বছর পড়েন। তখন তিনি এক পীর সাহেবের বাড়ি জায়গির থাকতেন। পীর সাহেব তাকে দৈনিক এক-দেড় ঘণ্টা আপাদমস্তক কাপড়ে ঢেকে জিকির করাতেন। ফলে ছোটবেলা থেকেই হাফেজ্জী জিকিরে অভ্যস্ত হয়ে পড়েন। পীর সাহেবের বাড়িতে পড়াশোনায় সমস্যা হলে তিনি নোয়াখালীর খিলবাইছ মাদ্রাসায় ভর্তি হন।

Manual7 Ad Code

এ সময় একদিন আবর্জনার মধ্যে কোরআন পাকের আয়াত ‘বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম’ লেখা এক টুকরা কাগজ দেখে তিনি তা তুলে এনে পরিষ্কার করে সযত্নে রেখে দেন। এই ঘটনার প্রভাবে তার মন গভীরভাবে আল্লাহ ও কোরআনের দিকে ঝুঁকে পড়ে। তিনি কোরআন হিফজ করার জন্য কাউকে না বলে মাত্র দেড় টাকা সম্বল নিয়ে ভারতের পানিপথের উদ্দেশে বেরিয়ে যান। উল্লেখ্য, সে যুগে ভারতবর্ষে পানিপথের হিফজখানাটি ছিল হিফজ ও ইলমে কিরাত শিক্ষার অদ্বিতীয় স্থান।

Manual6 Ad Code

নানা ঘটনার মধ্য দিয়ে পানিপথে পৌঁছে তিনি ১৯১৩ সালে হজরত কারী আবদুস সালাম (রহ.)-এর অধীনে হিফজ শুরু করেন। হিফজ শেষ হওয়ার আগেই তিনি ও তার ওস্তাদ দুজনই মহামারিতে আক্রান্ত হন। এতে ওস্তাদ হজরত কারী আবদুস সালাম (রহ.) ইন্তেকাল করেন, কিন্তু তিনি বেঁচে যান। সুস্থ হওয়ার পর বাকি হিফজ হজরত কারী আখলাক হুসাইন (রহ.)-এর অধীনে ১৯১৫ সালে শেষ করেন।

Manual3 Ad Code

পানিপথ থেকে হিফজ শেষে তিনি ১৯১৫ থেকে ১৯২২ সাল পর্যন্ত সাহারানপুর মাদ্রাসায় পড়াশোনা করেন এবং সেখান থেকে সিহাহ সিত্তার কিতাব শেষ করে ১৯২৩ সালে দারুল উলুম দেওবন্দ থেকে ইসলামী শিক্ষার সর্বোচ্চ স্তরের সনদ লাভ করেন।

হাফেজ্জীর কর্মজীবন ও অবদান
পড়াশোনা শেষে তিনি তার সাথি মোজাহেদে আজম আল্লামা শামসুল হক ফরিদপুরী সদর সাহেব (রহ.) ও হজরত মাওলানা আবদুল ওয়াহাব পীরজি হুজুর (রহ.)-এর সহায়তায় দেশের বিভিন্ন স্থানে দেওবন্দের নিয়মে নতুন নতুন মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠার কাজ শুরু করেন। তাদের প্রচেষ্টায় ব্রাহ্মণবাড়িয়া, বাগেরহাট ও ঢাকায় অনেক মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠিত হয়। এসব মাদ্রাসার উল্লেখযোগ্য কয়েকটি হলো- বড়কাটারা, ফরিদাবাদ ও লালবাগ মাদ্রাসা। তবে ১৯৬৫ সালে ঢাকার কামরাঙ্গীরচরে হাফেজ্জী হুজুর (রহ.)-এর একক প্রচেষ্টায় নূরিয়া মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠিত হয়।

বর্তমানে সারা দেশে প্রচলিত মক্তব শিক্ষা ও কোরআন হিফজের বিশাল পরিধির পেছনে রয়েছে হজরত হাফেজ্জী হুজুর (রহ.)-এর বিশেষ অবদান। হাফেজ্জী হুজুর বলতেন, ‘আমরা তিনজন (আমি, শামসুল হক ফরিদপুরী সদর সাহেব হুজুর ও পীরজি হুজুর) যখন ঢাকায় এসে বড়কাটারা মাদ্রাসা শুরু করলাম, তখন ঢাকার মসজিদগুলোতে সহি-শুদ্ধভাবে কোরআন তিলাওয়াতে সক্ষম ইমামের সংখ্যা ছিল খুবই সামান্য। এখন আলহামদুলিল্লাহ পানিপথের পদ্ধতিতে কোরআনের ওপর ধারাবাহিক মেহনতের ফলে শুধু ঢাকা নয়, সারা দেশে সহি-শুদ্ধভাবে কোরআন পাঠকের সংখ্যা কল্পনাতীত।’

হজরত হাফেজ্জী হুজুর (রহ.) নিজেকে কোরআন ও সুন্নতে রাসূলের বাস্তব নমুনারূপে গড়ে তোলার সাধনায় জীবনের প্রতিটি মুহূর্ত তিলে তিলে কাজে লাগিয়েছিলেন। হাফেজ্জী হুজুর (রহ.) ছিলেন চতুর্দশ শতাব্দীর মহান সংস্কারক হাকিমুল উম্মত মাওলানা শাহ আশরাফ আলী থানভী (রহ.)-এর বিশেষ খলিফাদের অন্যতম।

রাজনীতিতে অংশগ্রহণ
হাফেজ্জী হুজুর বাংলাদেশ খেলাফত আন্দোলনের প্রতিষ্ঠাতা। তিনি ১৯৮১ ও ১৯৮৬ খ্রিস্টাব্দে অনুষ্ঠিত বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেন। ১৯৮১ সালের নির্বাচনে ১.৭৯% ভোট পেয়ে তৃতীয় এবং ১৯৮৬ সালে ৫.৬৯% ভোট পেয়ে দ্বিতীয় স্থান লাভ করেন।

বিদেশ সফর
১৯৮২ সালে হাফেজ্জী হুজুর (রহ.) ইরান-ইরাক সফর করেন এবং ইমাম খোমেনি ও সাদ্দাম হোসেনের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে ইরান-ইরাক যুদ্ধ বন্ধের চেষ্টা করেন।

ইন্তেকাল
হাফেজ্জী হুজুর (রহ.) ১৯৮৭ সালের ৭ মে ইন্তেকাল করেন। হাইকোর্টসংলগ্ন জাতীয় ঈদগাহ ময়দানে তার জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। ইমামতি করন হাফেজ্জী হুজুর (রহ.)-এর জ্যেষ্ঠ পুত্র কারী শাহ আহমদুল্লাহ আশরাফ (বড় ছেলে)। জানাজায় দেশের বিভিন্ন স্থান ও অঞ্চল থেকে হাজার হাজার শোকার্ত জনতা অংশগ্রহণ করেন। তিনি ছিলেন জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সমাজের সব মানুষের ভালোবাসা ও শ্রদ্ধার পাত্র। যা এ যুগে খুবই বিরল।

ঢাকার সাবেক মেয়র মরহুম মোহাম্মদ হানিফ উদ্যোগী হয়ে নগর ভবন সংলগ্ন ফিনিক্স রোডের নাম পরিবর্তন করে নতুন নামকরণ করেন, ‘মওলানা মুহাম্মদুল্লাহ হাফেজ্জী হুজুর (রহ.) রোড।’ আল্লাহ তার কবরকে জান্নাতের বাগানে পরিণত করুন। আমীন।

লেখক : হাফেজ্জী হুজুরের ছেলে-  খতিব, আম্বরশাহ শাহি মসজিদ, কাওরান বাজার,  ঢাকা

Spread the love

Manual1 Ad Code
Manual7 Ad Code