মুফতি মাওলানা মুজাফফর আহমদ রহ. এর সংক্ষিপ্ত জীবনী
May 27 2020, 08:14
![](https://www.qowmipedia.com/wp-content/uploads/2020/05/FB_IMG_15886030921522057.jpg)
নাম :- আল্লামা মুফতি মুজাফফর আহমদ রহ.
মহেশখালীতে জন্মগ্রহণ করেন। এখানেই তাঁর শৈশব কাল অতিবাহিত করেন।
শিক্ষা জীবন :- জামেয়া ইসলামিয়া পটিয়ায় তাঁর শিক্ষা জীবন শুরু হয়।
কর্ম জীবন :- মহেশখালী ঝাপুয়া মাদরাসাতে তাঁর কর্মজীবন শুরু হয়। পরে তিনি জামেয়া ইসলামিয়া পটিয়াতে শিক্ষকতা শুরু করেন।
অবদান :- স্মৃতিচারণ: আল্লামা মুফতি মুজাফফর আহমদ-রহ.
আল্লামা মুফতি মুজাফফর আহমদ-রহ. ছিলেন বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী অসাধারণ এক ব্যক্তিত্ব। বাংলাদেশসহ পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলের আকাবির ওলামা-মাশায়েখ, সুশীলসমাজ ও জাতীয় নেতৃবৃন্দের সাথে তাঁর উঠাবসার সুযোগ হয়েছে। তিনি একজন প্রবীণ বরেণ্য আলেম, প্রাজ্ঞমুহাদ্দিস ও মুফতি। হেফাজত ইসলামের নায়েবে আমীর ছিলেন।
আমি তাঁর সরাসরি ছাত্র নাহলেও বিভিন্ন ঘটনা ও স্মৃতিময় মুহূর্তের মধ্য দিয়ে নিজেকে তাঁর শিষ্য ভাবতে গর্ব অনুভব করি। এই অঘোষিত অধিকারের জায়গা থেকেই মূলত তাঁর অসাধারণ জীবন নিয়ে আমার এই যৎসামান্য স্মৃতিতর্পণ। এটি এমন এক স্মৃতিচারণ, যাতে তুলে আনার চেষ্টা করা হয়েছে তাঁর ইলমের গভীরতা ও সাধাসিধে যাপিত জীবনের কথা, বাতিলের বিরুদ্ধে তাঁর পাহাড়সম দৃঢ়তা, উন্নতচিন্তা-চেতনা, সিরাতে মুস্তাকিমের ওপর আমরণ অবিচল থাকার আখ্যান!
এক:
বাংলাদেশের সর্বদক্ষিণের জেলা ও নৈসর্গিক সৌন্দর্যের পর্যটন শহর কক্সবাজার। তারই অদূরে বিপুল জলরাশির ও বঙ্গোপসাগর বেষ্টিত দেশের একমাত্র পাহাড়ীদ্বীপ মহেশখালী উপজেলার অবস্থান। দৃষ্টিনন্দন, নয়নাভিরাম, প্রকৃতির তুলিতে আঁকা মহান আল্লাহর এক অনন্যসৃষ্টি এ দ্বীপ। আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের কুদরতের এক লীলাভূমি। এটি একটি উর্বর ভূখন্ড ও আলোকিত মানবসৃষ্টির সুতিকাগার!
এ ভূখন্ডে অনেক পীর-বুযুর্গ ও জ্ঞানী-গুণীর জন্ম হয়েছে। প্রতিষ্ঠিত হয়েছে বহুদ্বীনি ও সাধারণ শিক্ষাকেন্দ্র। প্রাকৃতিক সম্পদে ভরপুর এ দ্বীপ আল্লাহর প্রিয়বান্দাদের কাছেও ভালোলাগা-ভালোবাসার এক ভূ-খন্ড । এখানে রয়েছে অসংখ্য দ্বীনিশিক্ষা কেন্দ্র ও মসজিদ।
মহেশখালীত যে কজন সমকালীন প্রতিভূ ও সর্বজনীন ব্যক্তি জীবিত ছিলেন তাঁদের মধ্যে মুফতি সাহেব ছিলেন অন্যতম। প্রাতিষ্ঠানিক ও জাতীয় কর্মতৎপরতা ছাড়াও তিনি মহেশখালী উপজেলার ওলামায়ে কেরামের অভিভাবক ছিলেন।
দুই.
যুগযুগ ধরে তিনি শিক্ষা-দীক্ষার মাধ্যমে মানুষকে সু-পথে পরিচালিত করে এসেছেন এবং তালিবে ইলমের সুপ্তপ্রতিভাকে শাণিত করে পরিপূর্ণ মানুষ হিসেবে তৈরি করে জীবনকে বিলিয়ে দিয়েছেন। এ কারণেই আমরা তাঁকে শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করি এবং আমাদের গৌরব ও অহংকার হিসেবে বিবেচনা করি! যে দুটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে তিনি জীবনের অধিকাংশ সময় অতিবাহিত করে হাজার হাজার তালেবে ইলম তৈরি করেছেন সে প্রতিষ্ঠান-দুটির নাম উল্লেখ নাকরলে নয়, তা হচ্ছে, মহেশখালীর প্রাচীন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান জামেয়া আশরাফিয়া ঝাপুয়া। এটি১৯৪৬ সালে আল্লামা মুফতি আযীযুল হক রহ. এর ছাত্র মরহুম সুফি মাওলানা মুজহেরুল হক রহ. এলাকার কিছু গণ্যমান্য লোকেদের সাথে নিয়ে প্রতিষ্ঠা করেন। প্রতিষ্ঠানটি মহেশখালী উপজেলার ঐতিহ্যবাহী ও প্রাচীনতম দ্বীনিশিক্ষা প্রতিষ্ঠান। এবং আল্লামা মুফতি আযিযুল হক রহ. প্রতিষ্ঠিত দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম দ্বীনি মারকায ও ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় জামেয়া ইসলামিয়া পটিয়া।
তিন.
ক্ষণস্থায়ী জীবনে চিরস্থায়ী হওয়ার সুযোগ নেই। এ অমোঘ রীতিতে এই দ্বীপের অনেক রত্ন আমরা হারিয়েছি। অনেকে জীবনের শেষ পর্যায়ে উপনীত হয়েছেন। বর্তমান নিবন্ধে উল্লেখযোগ্য কজন (প্রয়াত) আলেম-ওলামা, ইসলামি ব্যক্তিত্ব ও গুণীজনের নাম উল্লেখ করা সমীচিন মনে করছি। বিশেষভাবে উল্লেখ্য ব্যক্তিত্বগণ হচ্ছেন- এ দ্বীপের মরহুম মাওলানা বশীর উল্লাহ-নয়াপাড়া,কালারমারছড়া (বহু ইসলামি গ্রন্থপ্রণেতা ও মুহাক্কিক আলেম); মরহুম মাওলানা সূফি মুজহেরুল হক (প্রতিষ্ঠাতা, ঝাপুয়া মাদরাসা); মরহুম মাওলানা মুহম্মদ সাঈদ (সাবেক পরিচালক,ঝাপুয়া মাদরাসা); মরহুম মাওলানা আলী আহমদ (সাবেক পরিচালক,ঝাপুয়া মাদরাসা); মরহুম মাওলানা নুরুচ্ছমদ (সাবেক পরিচালক, গোরকঘাটা মাদরাসা), বড়মহেশখালীর সন্তান (হযরত মাওলানা জাফর আহমদ ওসমানী রহ. এর খলিফা) মাওলানা মকবুল আহমদ, ওলামা কুলের শিক্ষক মাওলানা আব্দুল বারী সাহেব, মাওলানা হাশমত আলী, মাওলানা কাজী হামীদুর রহমান, মওলানা মকবুল সুবহান, মাওলানা ফজল আহমদ; -রাহিমাহুমুল্লাহ- প্রমূখ।
সদ্য প্রয়াত আল্লামা মুফতি মুজাফ্ফর আহমদ (প্রধান মুফতি ও মুহাদ্দিস, জামেয়া ইসলামিয়া পটিয়া), সহ উপর্যুক্ত ব্যক্তিবর্গ এ দ্বীপের অত্যন্ত যোগ্যতা সম্পন্ন আলেম,সূফি-আল্লাহওয়ালা ছিলেন। -রাহিমাহুমুল্লাহ।
চার.
এমনই এক অসাধারণ ব্যক্তিত্ব ও সু-পুরুষের সাথে সাক্ষাত ও সৌজন্য সাক্ষাতের সুযোগ হয় আমার প্রায় দেড়যুগ আগে। আমি তখন জামেয়া দারুল মা\’আরিফ আল-ইসলামিয়ার জামেইয়্যা স্তরের ছাত্র। মাধ্যমিক স্তরে পড়াকালীন আমার কাছে তিনি ছিলেন অপরিচিত। কিন্তু একদিন জানলাম, জামেয়া ইসলামিয়া পটিয়ায় মুফতি মুজাফ্ফর আহমদ নামে এক প্রাজ্ঞআলেম রয়েছেন। তিনি আমাদের মহেশখালী উপজেলার কৃতীসন্তান। সেইদিন থেকে তাঁর সাথে সাক্ষাতের কৌতূহল জাগে। বন্ধুবর হাফেয মাওলানা আব্দুল গফ্ফার (বর্তমান সুপার, আল-ঈমান মহিলা মাদরাসা,মহেশখালী) ও আমি পটিয়াস্থ বাসাতে তাঁর সাথে সাক্ষাত করি। দেখি, তিনি একজন সাধাসিধে ও মিতভাষী শিক্ষাগুরু। প্রয়োজনীয় আলাপচারিতার ফাঁকে তিনি আমাদের পারিবারিক খোঁজ-খবরও নিলেন। কারণ তিনি মহেশখালীর প্রায় পরিবারকে চিনতেন এবং অনেকের সাথে উঠাবসা ছিলো। কথার ফাঁকে আমাদের উপযোগী বিভিন্ন জ্ঞানগর্ভ কথা বলে উৎসাহিতও করেন। এবং নিজ হাতে নাস্তা পরিবেশন করে মেহমানদারী করেন।
পাঁচ.
ইলমের গভীরতা ও উচ্চ চিন্তা-চেতনার কথা তাঁর ছাত্র-শিষ্যরাই ভালো বলতে পারবেন। তবে, আমি তাঁর এক দরসি মজলিসে বসে অনুমান করতে পেরেছি, তিনি কত বড়প্রতিভাধর ও মুহাক্কিক আলেম ছিলেন। মৃত্যুর দুবৎসর পূর্বে ককসবাজার ইমাম মুসলিম রহ.ইসলামিক সেন্টারে খতমে মেশকাত শরিফের শেষ দরসের তিনি ছিলেন প্রধান অতিথি। বিশেষ অতিথি ছিলেন জামেয়ার দারুল মাআরিফ আল-ইসলামিয়ার উপ-পরিচালক হযরত মাওলানা মুহাম্মদ ফুরকানুল্লাহ খলীল। আমরা জামেয়ার দারুল মা\’আরিফের বেশকজন শিক্ষকও খতমে মিশকাত উপলক্ষে সেন্টারের প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক হাফেয শায়খ সালাহুল ইসলামের পক্ষ থেকে তাঁর প্রতিষ্ঠান পরিদর্শনের দাওয়াত পাই। মুফতি সাহেব উপস্থিত হওয়ার কথা আমরা জানতাম না। উপস্থিত হয়ে ব্যানারে দেখতে পেলাম; প্রধান অতিথি জামেয়া ইসলামিয়ার নায়েবে মুদীর ও প্রধান মুফতি আল্লামা মুজাফফর আহমদ সাহেব।
অনুষ্ঠানের শেষ পর্যায়ে ঘোষণা করা হলো মেশকাত শরীফের শেষ দরস দিবেন মুফতি সাহেব। শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত দরসটি ছিল অনন্য ও জ্ঞানগর্ভ। তাঁর সেদিনের এ অনন্য দরস দ্বারা আমরা অনেক উপকৃত হয়েছি।
ছয়.
জীবনের দীর্ঘ সময়ে তিনি শিক্ষা-দীক্ষায় নিয়োজিত ছিলেন। আমরা তাঁকে কাছ ও দূর থেকে একজন পরোপকারী বড়োমনের মানুষ, নীতিবান প্রশাসক,আদর্শ শিক্ষক,সমাজহিতৈষী ও দানবীর হিসেবেই দেখেছি। এবং আমার যতোটুক জানাশোনা, তিনি শিক্ষার্থী, শিক্ষকবৃন্দ,আলেম-ওলামা এবং জামেয়ার প্রশাসনের কাছেও ছিলেন যথেষ্ট গ্রহণযোগ্য এক ব্যক্তিত্ব।
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নিজেকে আত্বনিয়োগ করে শেষদিন পর্যন্ত তিনি সিরাতে মুস্তাকিমের পথে অবিচল ছিলেন। এ কথা বললে অত্যুক্তি হবেনা যে, তিনি যে অকল্পনীয় সফলতা ও গ্রহণযোগ্যতা অর্জন করেন তা তাঁর একনিষ্ঠতা ও আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের কাছে গ্রহণযোগ্যতার প্রমাণ বহন করে। তাঁর তিরোধানে শিক্ষিত ও সাধারণ নির্বিশেষে প্রত্যেকেই ভীষণ ব্যথিত হয়েছেন। দেশের সোস্যাল মিডিয়া ও জাতীয় মিডিয়াসমূহ তাঁর মৃত্যু সংবাদ গুরুত্বের সাথে প্রচার করেছে। এবং ২০১৭ সালের ৩রা মে সকাল ১১টায় আল্লামা সুলতান যওক নদবির ইমামতিত্বে হাজার-হাজার তাওহিদি জনতা তাঁর জানাযায় শরিক হন।
রাব্বুলআলামিন এ মহান ব্যক্তিত্বকে জান্নাতুল ফিরদাউসের উচ্চ মকাম দান করুন এবং তাঁর জীবনের যাবতীয় দোষ-ত্রুটি ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টিতে দেখুন…এটাই হোক আমাদের একান্ত প্রার্থনা!
লিখেছেন মুহাম্মদ ফুরকান হুসাইন
শিক্ষক, জামেয়া দারুল মাআরিফ আল-ইসলামিয়া চট্টগ্রাম।
মৃত্যু তারিখ :- ০২.০৫.১৭
তথ্য দানকারীর মোবাইল :- ০১৯৭৯১৩১৩৯৯