সারা দেশের মাদ্রাসাসমূহ

মাওলানা শামসুল হক ফরিদপুরী রহ.

November 14 2018, 05:02

জন্ম ও পরিবার

তিনি ১৮৯৬ খ্রিষ্টাব্দ ১৩০২ বঙ্গাব্দের ২ ফাল্গুন গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়া উপজেলার পাটগাতী ইউনিয়নের ঘোপেরডাঙ্গা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন।তাঁর পূর্বপুরুষগণ প্রায় তিনশো বছর পূর্বে ইসলাম প্রচারের উদ্দেশ্যে আরব থেকে বাংলায় আগমন করেন। তাঁর পিতার নাম মুন্সি মুহাম্মদ আব্দুল্লাহ এবং মাতার নাম আমেনা খাতুন। তাঁর পিতা মুন্সি আবদুল্লাহ ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দে সিপাহী বিপ্লবে এবং তাঁর দাদা চেরাগ আলী সৈয়দ আহমদ শহীদের শিখ-ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেছিলেন

শিক্ষাজীবন

ছদর সাহেব পাটগাতীর স্থানীয় জনৈক হিন্দু পণ্ডিতের কাছে লেখাপড়া শুরু করেন। এরপর টুঙ্গিপাড়া এবং বরিশালের সুটিয়াকাঠি স্কুল থেকে প্রাথমিক শিক্ষা শেষ করেন। ১৯১৫ খ্রিষ্টাব্দে তিনি নোয়াপাড়ার বাঘরিয়া হাই স্কুলে ষষ্ঠ শ্রেণীর বার্ষিক পরীক্ষায় প্রথম স্থান অর্জন করেন। ষষ্ঠ শ্রেণী পর্যন্ত লেখা-পড়া সমাপ্ত করার পর সপ্তম শ্রেণীতে ভর্তি হন কলিকাতা আলিয়া মাদ্রাসায় এবং ১৯১৯ খ্রিষ্টাব্দে কলিকাতা আলিয়া মাদ্রাসার এ্যাংলো পার্সিয়ান (ইংলিশ মিডিয়াম) বিভাগ থেকে প্রবেশিকা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। এরপর তিনি স্কলারশিপ নিয়ে ভর্তি হন প্রেসিডেন্সি কলেজে। কিছুদিন পর শুরু হয় মহাত্মা গান্ধীর অসহযোগ আন্দোলন। তখন তিনি কলেজ ত্যাগ করে থানাভবনে হাকীমুল উম্মাত মাওলানা আশরাফ আলী থানভীর কাছে চলে আসেন।

এরপর তিনি থানভী রহ.এর পরামর্শে ১৯২০ খ্রিষ্টাব্দে সাহারানপুরের মাযাহিরুল উলুম মাদ্রাসায় ভর্তি হন। সেখানে ইসলামিয়্যাতে মাধ্যমিক, উচ্চ মাধ্যমিক ও স্নাতক শিক্ষা অর্জন করেন। (কাফিয়ে থেকে মেশকাত পর্যন্ত) এরপর দারুল উলুম দেওবন্দে উচ্চ শিক্ষা অর্জন করেন। আল্লামা আনোয়ার শাহ কাশ্মীরী, শায়খূল ইসলাম মাদানী ও শায়খুল আদব এজাজ আলী রহ প্রমুখ মনীষীগণের নিকট তিনি হাদীস অধ্যয়ন করেন। তিনি মাওলানা জাফর আহমাদ উসমানী ও মাওলানা আব্দুল গনী প্রমুখ মনীষীগণ থেকেও খেলাফত লাভ করেন।

 

বাংলাদেশের শীর্ষ স্থানীয় দ্বীনি ব্যক্তিত্ব, ইসলাম ও আধুনিক জ্ঞানসমৃদ্ধ, আধ্যাত্মিক সাধক পুরুষ মাওলানা শামসুল হক ফরিদপুরী ইসলামের নীতি-আদর্শের উপর ছিলেন ইস্পাতকঠিন। কোন হুমকি বা লোভ-প্রলোভনের হাতছানি তাঁকে চুলপরিমাণও ইসলামী আদর্শ থেকে টলাতে পারত না। তাঁর জীবনের বিভিন্ন জটিল মুহূর্তেও নীতি-আদর্শ নিষ্ঠার যেমন বহু প্রমাণ মিলে, তেমনি বিপুল পরিমাণ অর্থ-প্রলোভনের প্রস্তাব ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যানের বহু বিস্ময়কর দৃষ্টান্তও তিনি রেখে গেছেন। খোদাভীরু ঈমানদীপ্ত আল্লাহর একজন অতিপ্রিয় মুজাহিদ বান্দাই শুধু এ জাতীয় পরিস্থিতিতে নিজেকে নির্লোভ রাখতে পারেন এবং নির্ভীক চিত্তে অন্যায়ের প্রতিবাদে সোচ্চার হবার ক্ষমতা রাখেন। মাওলানা শামসুল হক ফরিদপুরী (রহ)-এর জীবনের বহু ঘটনায় তা-ই প্রত্যক্ষ করা যায়। তন্মধ্য থেকে দু’একটি এখানে লক্ষণীয়।

পাশ্চাত্যের ধ্যানধারণার সামনে পরাজিত মনের অধিকারী অন্যান্য মুসলিম শাসকদের ন্যায় তৎকালীন পাকিস্তানের শাসক আইয়ুব খানের মধ্যেও ইসলামী শাসন ব্যবস্থার ব্যাপারে হীনমন্যতা ছিল। কিন্তু ক্ষমতায় টিকে থাকতে হলে সরাসরি দেশের ইসলামী জনতার মতের বিরুদ্ধে কিছু করাও ছিল অসুবিধা। তাই তিনি নামেমাত্র মুসলমান কিছুসংখ্যক চতুর বুদ্ধিজীবীর পরামর্শে ‘ইসলামী আবরণের’ মধ্য দিয়েই ইসলাম পরিপন্থী কতিপয় পদক্ষেপ গ্রহণ করেছিলেন। ইসলামকে আধুনিকীকরণের উদ্ভট মনোবৃত্তি ছিল তাঁর মধ্যে প্রকট।

শুরুতেই দেশের বিচক্ষণ ও খাঁটি আলেমগণ ইসলামকে আধুনিকী করণের নামে বিধৃত করণের পদক্ষেপের প্রতিবাদ করায় আইয়ুব খান তাঁর সপক্ষে কিছু আলেমকে হাত করার চেষ্টা করেন। যেহেতু প্রতি যুগে যুগেই কিছু না কিছু দুনিয়াদার স্বার্থপর ধর্মব্যবসায়ী আলেম থাকেন, অথবা স্থূলজ্ঞান বিশিষ্ট অগভীর ও দুর্বল চিত্তের এ জাতীয় লোকের সন্ধান মিলে, যারা অর্থ এবং পদলি≈vয় পড়ে যে কোন বাতিলপন্থী শাসকের ‘হ্যাঁ’-এর সঙ্গে ‘হ্যাঁ’ এবং ‘না’-এর সঙ্গে ‘না’ মিলাতে একটুও বিবেকের দংশন অনুভব করেন না। আইয়ুব আমলেও একই ধরনের কিছু আলেম পাওয়া যায়নি যে তা নয়। কিন্তু দেশের ইসলামী জনতা এই শ্রেণীর লোকদের কথা ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। মুসলিম পারিবারিক আইন তৈরির পর আইয়ুব খান মাওলানা শামসুল হক ফরিদপুরীকে তাঁর সাথে সাক্ষাৎ করার জন্যে একাধিকবার দাওয়াত দেন। কিন্তু যতদূর সম্ভব তিনি তার থেকে দূরে সরে থাকতেন। অতঃপর চিকিৎসার উদ্দেশ্যে তিনি যখন ১৯৬৪ সালে রাওয়ালপিন্ডি হাসপাতালে ভর্তি হন, সে সময় হাতের কাছে পেয়ে তাঁকে তাঁবেদার বানাবার জোর প্রচেষ্টা চলে। প্রায় সময় তাঁর কাছে লোক পাঠানো হতো। হুযুর বহু চিন্তা-ভাবনার পর তথাকথিত মুসলিম পারিবারিক আইন সংশোধন ও অন্যান্য অনৈসলামিক পদক্ষেপের ব্যাপারে সরাসরি আইয়ুব খানের সাথে কথা বলার সিদ্ধান্ত নেন।

অতঃপর একদিন তিনি প্রেসিডেন্ট আইয়ুবের সাথে সাক্ষাৎ করেন এবং ইসলামের দৃষ্টিতে আপত্তিকর পারিবারিক আইন বাতিল করার ব্যাপারে তাঁকে পরামর্শ দেন। কিন্তু তাতে কোন ফলোদয় ঘটেনি। অতঃপর তিনি পুনর্বার হাসপাতালে আসার পর পূর্ব পাকিস্তানী বিশিষ্ট ৩ জন মন্ত্রীর মাধ্যমে গওহরডাঙ্গা মাদরাসার নামে তাঁর কাছে দশ লাখ টাকার একটি চেক পাঠানো হয়। যার বর্তমান মূল্যমান হবে প্রায় দশ কোটি টাকা তাঁকে এতদূরও বলা হয় যে, এসব টাকার কোন হিসাব চাওয়া হবে না। মাওলানা ফরিদপুরী উক্ত দশ লাখ টাকার চেক ফেরত দিয়ে মন্তব্য করেন, ‘‘খান সাহেব মনে করেছেন, টাকার দ্বারা শামসুল হককে কেনা যাবে। তা ইনশাআল্লাহ কোনদিনই সম্ভব হবে না।’’

অবশেষে তাকে এক সরকারি ভোজসভায় দাওয়াত গ্রহণের প্রস্তাব দেয়া হলো। তিনি সাফ জবাব দিয়েছিলেন যে, যার নীতিকে সমর্থন করতে পারি না, যার টাকা ফেরত দিলাম, তার দাওয়াতে যাওয়া কি করে সঙ্গত হতে পারে? সরকারের মনগড়া ঈদের বিরোধিতা : ১৯৬১ সালে ঈদের চাঁদ নিয়ে আইয়ুব খান এক হঠকারিতার পরিচয় দিয়েছিলেন। গভীর রাতে করাচীতে চাঁদ দেখা গেছে বলে পূর্ব পাকিস্তানেও ঐ অনুসারে পরদিন ঈদ করতে হবে,- এ মর্মে তৎকালীন গভর্নরের কাছে নির্দেশ আসলো অথচ পূর্ব পাকিস্তানের কোনো জেলাতেই চাঁদ দেখার কোন খবর পাওয়া যায়নি।

করাচী থেকে দূরত্বের কারণে যা করা এখানকার রোজাদারদের জন্য শরীয়তসম্মত ছিল না। তৎকালীন প্রাদেশিক গবর্নর মোনায়েম খানের নির্দেশে মাওলানা ফরিদপুরী সাহেবকে স্থানীয় ডিসি পরদিন ঈদ করার কথা বললে তিনি তা প্রত্যাখ্যান করেন। বরং মাইকযোগে সকলকে ঐদিন ঈদ না করার জন্যে তিনি সর্বত্র ঘোষণা করে দেন। অতঃপর ডিসি পুনরায় ‘গবর্নরের নির্দেশের বিরুদ্ধাচরণ হচ্ছে’ বলে তাঁকে স্মরণ করিয়ে দিলে তিনি স্পষ্ট জবাব দিয়েছিলেন যে, ‘‘ডেপুটি কমিশনার সাহেব, আপনি দয়া করে আবদুল মোনায়েম সাহেবকে বলে দেবেন, এ অবস্থায় আমি মোনায়েম সরকারের আদেশ-অনুরোধ কিছুই মানতে রাজী নই, এটা শরীয়তের ব্যাপার।

–উল্লেখ্য যে, প্রত্যেক এলাকার অন্তত পাঁচশত মাইলের ভিতরে চাঁদ দেখা গেলে তখনই ঐ এলাকায় পরদিন ঈদ করা যায়। এর চাইতে দূরবর্তী এলাকায় চাঁদ উঠার খবরে ঈদ করা শরীয়তসম্মত নয়। এই বলে মাওলানা ফরিদপুরী এ নীতির উপর অটল ছিলেন এবং সরকারের চাপের মুখে পরদিন ঈদ করে মহান একটি ফরয রোযা নষ্ট করার মতো জঘন্য কাজ করতে কিছুতেই রাজী হননি। আইয়ুব শাসনামলে ১৯৬৬ সালে দ্বিতীয়বার প্রেসিডেন্ট নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। নির্বাচনের পূর্বে আইয়ুব খান করাচীতে এক ওলামা ও মাশায়েখ কনফারেন্স আহবান করেছিলেন। মাওলানা শামসুল হক ফরিদপুরী এ কনফারেন্সের উদ্দেশ্য বুঝতে পেরে তাতে অংশগ্রহণ করেননি। আইয়ুব খানের প্রতি সমর্থন জানাননি। অবশ্য তারই এক সপ্তাহ পূর্বে পীর-মাশায়েখের মধ্য থেকে এদেশের কেউ কেউ ঢাকার চক মসজিদে অনুষ্ঠিত এক ওলামা সম্মেলনে কুরআনের কাফের, ফাসেক ও জালেম শাসক সম্পর্কিত আয়াতসমূহ দ্বারা পরোক্ষভাবে আইয়ুবের তীব্র সমালোচনা করেছিলেন। কিন্তু বিমানের মুফত টিকেট পেয়েই নিজেদের সব বক্তব্য বেমালুম ভুলে গিয়ে তারা উক্ত কনফারেন্সে গিয়ে যোগ দিতে এবং পরে আইয়ুব সমর্থক বনে যেতে তাদের দেখা গেছে। শুধু তাই নয়, আইয়ুবের পারিবারিক আইনসহ ইসলামিক সকল কাজের সমালোচনাকারী ও ইসলামী সমাজব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার জন্য সংগ্রামরত অনেক নিষ্ঠাবান মুজাহিদকে এহেন ব্যক্তিরাই আহলে সুন্না ওয়াল জামাতের খারিজ বলে ফতোয়া দিতেও কুণ্ঠিত হয়নি।

যা হোক, অতঃপর দোর্দন্ড প্রতাপশালী ফিল্ড মার্শাল মুহাম্মদ আইয়ুব খান নিজেই ঢাকা আসেন এবং প্রেসিডেন্ট ভবনে দেশের বিশিষ্ট ওলামা ও পীরদের দাওয়াত করে নেন। মাওলানা ফরিদপুরী প্রথমে ওলামা প্রতিনিধি দলের সাথে অনুষ্ঠিত প্রেসিডেন্টের এই বৈঠকে যোগ দিতে অস্বীকৃতি জানিয়েছিলেন। পরে মুফতী দীন মুহাম্মদ খাঁ ও মাওলানা নূর মুহাম্মদ আজমীর অনুরোধে তিনি যেতে সম্মত হন। তবে হুযূর মজলিসে কিঞ্চিৎ বিলম্বে পৌঁছেন এবং গিয়ে প্রেসিডেন্টের সম্মুখস্থ আসনেই তশরিফ রাখেন। উক্ত বৈঠকে বিশিষ্ট মন্ত্রীরাও উপস্থিত ছিলেন। খান সাহেবের উদ্দেশ্য ছিল, আসন্ন নির্বাচনে এখানে আগত পীর মাশায়েখগণ তাকে সমর্থন জানাবেন-এ প্রতিশ্রুতি নিয়েই তিনি তাঁদের বিদায় দেবেন। কারও কারও সাথে করাচীতেই কথা শেষ হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু পূর্ব পাকিস্তানের আলেমদের মতে আনতে হলে মাওলানা ফরিদপুরীকে অবশ্যই মতে আনতে হবে, এ জন্যে এখানে এই বৈঠকের আয়োজন। এক পর্যায়ে প্রেসিডেন্ট আইয়ুব সবাইকে লক্ষ্য করে বললেন, ‘‘আশা করি আসন্ন নির্বাচনে আপনারা আমার প্রতি সমর্থন জানাবেন’’। নির্ভীক মোজাহিদ মাওলানা শামসুল হক ফরিদপুরী তখন ইতিহাসখ্যাত মুজাদ্দেদে আলফেসানীর নৈতিক দৃঢ়তা নিয়ে প্রেসিডেন্ট আইয়ুবকে সরাসরি তাঁর মুখের উপর জিজ্ঞেস করে বসলেন যে, ‘‘আপনি নিজের বিগত দীর্ঘ কয় বছরের শাসনামলে পাকিস্তান তথা ইসলামের উন্নতিকল্পে এমন কি কাজ করেছেন, যদ্দরুন আলেম সমাজ আপনাকে সমর্থন করতে পারে?’’ আইয়ুব খান বললেন, ‘‘আমি বহু স্কুল কলেজ বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেছি। স্কুলের অষ্টম শ্রেণী থেকে ইসলামিয়াত ও আরবী শিক্ষার ব্যবস্থা করেছি। মাদরাসার ফাজেল পাসের পর আইএ ভর্তি হবার সুযোগ দিয়েছি।’’ জবাবে মওলানা ফরিদপুরী বললেন, আপনি ইসলামিয়াত শিক্ষা হ্রাস করে দিয়েছেন। ইসলাম বিরোধী শিক্ষা-সংস্কৃতি বাড়িয়ে দিয়েছেন। ইংরেজ আমলে স্কুলে এর চাইতেও বেশি আরবী ছিল। ইসলামিয়াত ও আরবীকে আপনি ঐচ্ছিক বিষয়ে পরিণত করেছেন, এ স্থলে সে সময় ঐগুলো ছিল বাধ্যতামূলক। এছাড়া আপনি ইসলামবিরোধী সহশিক্ষা চালু করেছেন। নাচ, গান ছাত্রছাত্রীদের জন্যে জরুরি বিষয় হিসেবে গণ্য করেছেন। কুরআন বিরোধী ‘মুসলিম পারিবারিক আইন’’ পাস করেছেন। শরীয়ত বিরোধী পরিবার-পরিকল্পনা আইন পাস করে ব্যভিচারের পথ উন্মুক্ত করেছেন। আপনার আমলে নগ্ন ছবি, অশ্লীল গান ইত্যাদির অধিক উন্নতি ঘটেছে।

সুতরাং আপনি কোনরকম সমর্থন পেতে পারেন না। তবে হাঁ, পরিবার পরিকল্পনা ও পারিবারিক আইন বাতিল করে যদি দেশে ইসলামী শাসন ও শিক্ষাব্যবস্থা চালু করার প্রতিশ্রুতি দেন, তাহলে আপনি অবশ্যই সমর্থন পাবেন। নিজে ভোট চাওয়ার দরকার হবে না, আমরাই এ ব্যাপারে চেষ্টা করবো।’’ আইয়ুব খান জানালেন, ‘‘এসব বিষয় আমি আইন পরিষদের হাতে ছেড়ে দিয়েছি। এ সম্পর্কে কিছু করা আমরা ক্ষমতার বাইরে। যা হোক আপনি আমাকে সমর্থন না করুন কিন্তু বিরোধিতা করবেন না। চুপ থাকবেন।’’ মাওলানা শামসুল হক তখন উত্তর দিলেন যে, ‘‘আমি আমার দায়িত্ব পালন করেই যাব।’’ প্রসঙ্গত ইসলামিক রিসার্চ ইনস্টিটিউট এর কথাও আলোচিত হয়। সেখানে ইসলামকে বিকৃত করনের কাজ চলতো। এক পর্যায়ে মাওলানা ফরিদপুরী মন্তব্য করেন যে, কার্যত এগুলোর দ্বারা ইসলামের ফায়েদার পরিবর্তে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করা হচ্ছে।

অতঃপর এ নিয়ে কথা কাটাকাটি হতে হতে বিষয়টি রীতিমতো এক তিক্ত বাকযুদ্ধে পরিণত হলো। প্রেসিডেন্ট আইয়ুব এক পর্যায়ে রাগের মাথায় বলে বসলেন যে, ‘‘দেখিয়ে মাওলানা আপনে কো সাম্ভালকে বাত কিজিয়ে, মাই পাঠান কা বাচ্চা পাঠান হোঁ।’’ মাওলানা ফরিদপুরী তখন মুখের উপর বলে দিয়েছিলেন, দেখিয়ে খানসাব, আপ আগার পাঠান কা বাচ্চা পাঠান হ্যাঁ, তো মাইভী মুসলমানকা বাচ্চা মুসলমান হোঁ। আল্লাহ্ কে সিওয়া মাঁই কেসীকো নাহী ডারতা হোঁ। আপহী বাতাইয়ে, ইয়েহ্ ধোকাবাজী নাহী তো কেয়া হ্যা?’’ প্রেসিডেন্ট আইয়ুবের সাথে মাওলানা শামসুল হক ফরিদপুরীর এ বাকবিতন্তা চলাকালে সেখানে যারা উপস্থিত ছিলেন, সকলেই অনেকটা ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে উঠেছিলেন। কারণ, এমন একজন পরাক্রমশালী সামরিক অধিনায়ক ও রাষ্ট্রপ্রধানকে তারই মন্ত্রিবর্গ ও উচ্চ সরকারি কর্মচারীদের সামনে এরূপ সরাসরি তীব্র সমালোচনা শাস্তিরও কারণ হতে পারতো। কেননা, সেটা ব্যক্তিগত মর্যাদার প্রশ্ন। চতুর্দিক সেনাবাহিনী দ্বারা পরিবেষ্টিত এ পরিবেশ থেকে বের হয়ে আসার সময় মাওলানা শামসুল হক ফরিদপুরী বলে আসলেন, ‘‘এখানে বসে কথা বলা ঈমানের ক্ষতি ছাড়া কিছু নয়, চলুন আমরা বের হয়ে যাই।’’ বাদশাহ ফয়সলের আমন্ত্রণে মাওলানা ফরিদপুরীকে আইয়ুব সরকার কর্তৃক যেতে না দেয়া : আইয়ুব খান মাওলানা শামসুল হক ফরিদপুরীর সাথে যুক্তিতে হেরে গিয়ে উষ্মা প্রকাশ করলেও তাঁর বিরুদ্ধে আইনগত কোন ব্যবস্থা নিতে সাহসী হননি। তবে অপর একদিক দিয়ে এর প্রতিশোধ নিতে ত্রুটি করেননি। সেটা হলো, ঐ বছরই সৌদি আরবের বাদশাহ্ তাঁকে রাবেতা-এ-আলমে ইসলামীর মহাসম্মেলনে সৌদি আরবে যাবার জন্য দাওয়াত করেছিলেন। ঐ সম্মেলনে মুসলিম বিশ্বের সমস্যা, সংহতি ও দ্বীনী উন্নতি-অগ্রগতি সম্পর্কে আলোচনা হয়েছিল। মাওলানা সাহেবকে আইয়ুব সরকার বিদেশ যাবার পাসপোর্ট দেননি। সেখানে মুসলিম বিশ্বের বহু রাজনীতিক অভিজ্ঞ ওলামা, ইসলামী বিশেষজ্ঞ ও চিন্তাবিদ যোগদান করেছিলেন। বহু প্রতিক্ষার পর ‘‘মুফতীয়ে আজম পাকিস্তান’’ মাওলানা শফী সাহেবের মাধ্যমে রাওয়ালপিন্ডি হেডকোয়ার্টার থেকে খবর নিয়ে কারণ জানা যায় যে, খোদ আইয়ুব খাঁ তাঁকে বিদেশ যাবার অনুমতি দেয়ার জন্য অফিসে নিষেধ করে রেখেছিলেন। তাঁকে তিনি পাকিস্তানের ‘এক নম্বর শত্রু’ বলেও মন্তব্য করেছিলেন।

গবর্নর আজম খানের দরবারে মাওলানা ফরিদপুরী (রহঃ) : ন্যায়, সত্য ও দীন শরীয়তের প্রশ্নে ফরিদপুরীর নির্ভীকতা ও স্পষ্টবাদিতার অসংখ্য দৃষ্টান্ত বিদ্যমান। গবর্নর মোনায়েম খানের পূর্বে একবার গবর্নর আজম খান এভাবে ওলামা প্রতিনিধিদের সাথে গবর্নর হাউজে মিলিত হয়েছিলেন। তিনি ওয়াজ নসীহতের দ্বারা জনগণকে সৎ নাগরিকে পরিণত করার জন্যে আলেম সমাজের প্রতি আহবান জানিয়েছিলেন। মাওলানা ফরিদপুরী তখন আজম খানকে বলেছিলেন, ‘‘মুহতারাম গবর্নর সাহেব। ডক্টর বিমারকো কিৎনাহী আচ্ছা দাওয়া কেঁউ নাপিলায়ে, আগার বিমার কী তরফছে হামেশা বদপরহেযী চল্তি রাহে, তু দাওয়া কারেগার না হোগা।’’ অর্থাৎ ‘‘ রোগী ওষুধও খাবে, কুপথ্যও খাবে তা হবে না- তাতে ওষুধ কোন কাজ করবে না। রোগের কোন উপশম হবে না। ওষুধ খাবার সাথে সাথে কুপথ্যও পরিহার করতে হবে।’’ তিনি আরও বলেছিলেন, ‘‘হাম তো যাহাঁ তক্মুমকিন, লোগোঁকো নেক ও সহী রাস্তা দেখানেকী কোশেশ মে হেঁ, লেকীন দোসরী তরফ হুকুমত কী তরফছে আগার লোগোঁকো জুরম কী তরফ উকসানে ওয়ালা ইকদাম কিয়া জায়ে আওর ফাহেশা সিনেমা ওগায়রাহ বদআখলাখী কামো কী তায়ীদ আওর বদপরহেযী চলতী রাহে, তো ইস বিমার কওমকো ছেহেত ইয়াবী কেয়ছী নাছীব হোগী।’’ অর্থাৎ ‘‘আমরাতো যথাসাধ্য মানুষকে সৎ ও সঠিক পথ দেখাবার চেষ্টায় নিয়োজিত আছি। কিন্তু সরকারের পক্ষ থেকে যদি জনগণের অপরাধপ্রবণ হবার নীতি অনুসৃত হয় আর অশ্লীল সিনেমা ইত্যাদি চরিত্র হানিকর কুপথ্য খাওয়ানোর কাজ অব্যাহত থাকে, তাহলে এই রুগ্ন জাতি কিভাবে আরোগ্য লাভ করবে?’’ আতাউর রহমান শিক্ষা কমিশনের রিপোর্টের প্রতিবাদ : পঞ্চাশের দশকের মাঝামাঝির সময়। পূর্ব পাকিস্তানে আতাউর রহমান খানের মুখ্য মন্ত্রিত্বের আমল। প্রদেশের শিক্ষার আমূল পরিবর্তন সাধনকল্পে তারই নেতৃত্বে একটি শিক্ষা কমিশন গঠিত হয়। উক্ত কমিশনের রিপোর্টে ধর্মনিরপেক্ষ শিক্ষা ব্যবস্থার সুপারিশ ছাড়াও মাদরাসা শিক্ষাকে কটাক্ষ করে মন্ত্রব্য করা হয়েছিল যে, মাদরাসা শিক্ষা হচ্ছে সময় এবং অর্থের অপচয়। এছাড়া অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত আরবী বিষয় উঠিয়ে ফেলার সুপারিশও তাতে ছিল। ঐ রিপোর্ট সর্বসাধারণ্যে প্রকাশ হতে না হতেই তার বিরুদ্ধে দেশের ইসলামী জনতা প্রচন্ড আক্রোশে ফেটে পড়ে। সে সময় এ আন্দোলনের পুরোভাগে থেকে যারা নেতৃত্ব দিয়েছিলেন তাদের মধ্যে মাওলানা শামসুল হক ফরিদপুরী একজন। তিনি রিপোর্টের প্রতিবাদে সর্বত্র জনসভা করেছেন। শুধু তাই নয়, মাদরাসা শিক্ষার অতীত, বর্তমান ও এর প্রায়োজনীয়তার উপর সংবাদপত্রে নিজের লেখা জ্ঞানগর্ভ প্রবন্ধও তিনি প্রকাশ করেছিলেন। আমার যতদূর মনে পড়ে মাওলানা শামসুল হক ফরিদপুরী, মাওলানা নূর মোহাম্মদ আজমী ও অধ্যাপক গোলাম আজম এ তিনজনের ৩টি যুক্তিপূর্ণ প্রবন্ধ দৈনিক আজাদে ও অন্য সংবাদপত্রে প্রকাশিত হবার পরই উক্ত শিক্ষা কমিশনের রিপোর্টের বিরুদ্ধে দেশজোড়া ছাত্র জনতার মাঝে বিরাট আন্দোলন দেখা দিয়েছিল। সেই আন্দোলনেরই এক পর্যায়ে কোর্ট কাছারীর সম্মুখস্থ ঢাকার সাবেক ‘ডিবি হলে’ মাওলানা আকরম খানের সভাপতিত্বে কবি গোলাম মোস্তফার উপস্থিতিতে অনুষ্ঠিত এক প্রতিবাদ সভায় ছাত্রেরা উক্ত কমিশনের রিপোর্ট আগুনে পুড়িয়ে দিয়েছিল। দীর্ঘ একযুগের অক্লান্ত চেষ্টা-সাধনা ও বহু আন্দোলনের ফলশ্রুতিস্বরূপ ১৯৫৬ সালের শাসনতন্ত্রটি রচিত হয়েছিল, সে সম্পর্কে ইতোপূর্বে বলা হয়েছে। এ দীর্ঘ সময়ে এ উদ্দেশ্যে যারা শুরু থেকে কষ্ট পরিশ্রম করে আসছেন, আইয়ুব খানের মতো একজন সেনাপতি ক্ষমতায় এসেই উক্ত শাসনতন্ত্র বাতিল ঘোষণা করলে স্বভাবতই তাদের অন্তরে অধিক ব্যথা অনুভূত হয়। এ ছাড়া ঐ শাসনতন্ত্রটি ছিল গোটা জাতি কর্তৃক গৃহীত।

মাওলানা শামসুল হক ফরিদপুরীও একই কারণে অর্থাৎ ৫৬ সালের শাসনতন্ত্র বাতিলের ঘোষণায় অত্যন্ত মর্মাহত হন। তবে তিনি উদ্যম হারাননি। বিরোধিতার ধরন হয়তো ভিন্ন প্রকারের তা কিন্তু ইসলামের ব্যাপারে কোন অবস্থাতেই তিনি নিশ্চুপ থাকতেন না। সুতরাং আইয়ুব শাসন প্রবর্তিত হবার কিছুদিন পরই মাওলানা সাহেবের পরামর্শ ও সহযোগিতাক্রমে ঢাকার ইস্কাটন রোডস্থ মসজিদ প্রাঙ্গনে এবং তার ১ বছর পর (১৯৬০ সালে) সিদ্ধেশ্বরীতে যথাক্রমে একটি সেম্পোজিয়াম ও একটি ইসলামিক সেমিনারের আয়োজন করা হয়। এ সময় সকল প্রকার রাজনৈতিক তৎপরতা ও সভা-সমিতি নিষিদ্ধ থাকলেও সীরাতুন্নবী জলসা ও ইসলামের শিক্ষা আদর্শের আলোচনামূলক সভা-সমিতি নিষিদ্ধ ছিল না। মাওলানা শামসুল হক ফরিদপুরী ও তাঁর সহকর্মী ইসলামী আন্দোলনের নেতা ও কর্মীরা অতঃপর ঢাকার বাইরেও একই পদ্ধতিতে ইসলামী সেমিনার, সিম্পোজিয়াম অনুষ্ঠান করতে থাকেন। বলাবাহুল্য, সারাদেশের সকল শ্রেণীর ওলামা ও ইসলামী আন্দোলনের নেতা ও কর্মীবৃন্দ আইয়ুব শাসনের শুরুতে অনেকটা কিংকর্তব্যবিমূঢ় ছিলেন। মাওলানা ফদিরপুরী নির্ভীকতার সঙ্গে ইসলামের নামে বের হয়ে পড়ায় সকলের মধ্যে এ নতুন প্রাণের সঞ্চার ঘটে। চলমান ইসলামী আন্দোলনের গতি আইয়ুবী সামরিক আইনের ফলে হঠাৎ থমকে দাঁড়ালেও এভাবে পুনর্বার ইসলামী আন্দোলনের পথ কিছুটা উন্মুক্ত হয়। এই আলেমরাই প্রথম খুলনায় আইয়ুব বিরোধী মার্শাল ল ভঙ্গ করেন, যার পর থেকে আইয়ুব বিরোধী গণআন্দোলন জোরদার হয়ে উঠে। যেই আন্দোলন প্রথমে এনডিএফ, পরে পিডিএম এবং সর্বশেষে ডাক অর্থাৎ ডোমোক্রেটিক এ্যাকশান কমিটিতে পরিণত হয়। এই ডাকের আন্দোলনেই মরহুম শেখ মুজিবুর রহমান আগরতলা ষড়যন্ত্র কেইস থেকে মুক্তি পান এবং নিষিদ্ধ দৈনিক ইত্তেফাক পত্রিকা ছাড়া পায়। করাচীর দৈনিক পাকিস্তান স্ট্যান্ডার্ড পত্রিকার সম্পাদক ফরিদ জাফরী সুন্নাহর বিরুদ্ধে বিষোদগার করে একটি প্রবন্ধ প্রকাশ করলে দেশব্যাপী ৫৫ সালে এর প্রচন্ড বিরোধিতা হয়। মাওলানা শামসুল হক ফরিদপুরী সে সময় ফিৎনা-এ-এনকারে হাদীসের বিরুদ্ধে বিরাট প্রতিবাদী ভূমিকা পালন করেন। লেখা ও বক্তৃতার মাধ্যমে মুসলিম আইনে সুন্নাহর গুরুত্বকে দেশবাসীর সামনে তুলে ধরেন। জাফরীর উক্তির প্রতিবাদে ঢাকাতে ১৯৫৫ সালে পল্টন ময়দানে বিরাট ওলামা সম্মেলনও অনুষ্ঠিত হয়। বলাবাহুল্য, উল্লিখিত মহলটিই সরাসরি ইসলামের বিরুদ্ধে কথা বলার সাহস না পেয়ে ইসলামকে আধুনিকীকরণের নামে প্রেসিডেন্ট আইয়ুবকে বিভ্রন্ত করতে সমর্থ হয়। মুনকির এ হাদীস এবং কেন্দ্রীয় ইসলামিক ইন্সটিটিউটের ডিরেক্টর ডক্টর ফজলুর রহমান একদিকে ইসলামকে তথাকথিত আধুনিকীকরণের গবেষণায় নিয়োজিত হন, অপরদিকে আইয়ুবকে দিয়ে ইসলামী মূল্যবোধবর্জিত সমাজের উপর তলার অত্যাধুনিক কিছু মহিলার চাপে মুসলিম পারিবারিক আইন নামে একটি কুরআন-সুন্নাহ বিরোধী আইন চালু করার ব্যাপারে সাফল্য লাভ করে। দেশে সামরিক আইন বলবৎ থাকা অবস্থায় এর বিরুদ্ধে তখন কোন কথা বলা বিরাট ঝুঁকিপূর্ণ ব্যাপার ছিল বৈকি। কিন্তু মাওলানা সাহেব এর তোয়াক্কা না করে আইয়ুবের পারিবারিক আইনের বিরুদ্ধাচরণ করেন। এ ব্যাপারে পূর্ব পাকিস্তানের বিশিষ্ট কতিপয় আলেমের নিকট থেকে স্বাক্ষর সংগ্রহকালে যথেষ্ট উদ্যোগের পরিচয় দেন।

পরিবার আইনের ত্রুটি-বিচ্যুতি নির্দেশ করে লিখিত এবং আলেমদের স্বাক্ষর সম্বলিত একটি বই প্রকাশ করা হয়। ঐ বইতে মাওলানা ফরিদপুরী ও দেশের অন্যান্য খ্যাতনামা ওলামায়ে কিরাম পারিবারিক আইন বাতিলের জন্যে প্রেসিডেন্ট আইয়ুবের নিকট দাবি জানান। উক্ত পারিবারিক আইনের বিরোধিতায় জনমত গঠন ও সাথে সাথে ইসলামী শাসনতন্ত্র রচনার দাবিতে অনুষ্ঠিত সভা-সামিতিতেও তিনি অংশ নেন। মাওলানা ফরিদপুরী (রহ.) সরকারে অনুসৃত নীতির সমালোচনার জন্যে তাকে আইয়ুব সরকারের রোষানলে পড়তে হয়। তারপরও নিজ নীতির উপর তিনি সম্পূর্ণ অটল থাকেন। মার্শাল-ল’ ভঙ্গ করা : পারিবারিক আইনের ব্যাপারে সরকারকে টেলিগ্রাম ও পত্রের দ্বারা দেশের ইসলামী জনতার মনোভাব জানানো অব্যাহত থাকে। অতঃপর সরকার বিষয়টি অাঁচ করতে পেরে অর্ডিন্যান্সটি ধামাচাপা দিয়ে রাখেন এবং এটিকে শিথিল করে ঐচ্ছিকের পর্যায়ে নিয়ে আসেন। এদিকে আইয়ুব সরকার ফরিদপুরীকে হুঁশিয়ার করে দিলেন যে, তিনি যেন মার্শাল-ল’র বিরোধিতা না করেন। কিন্তু তিনি নির্ভীকভাবে তাঁর কাজ করেই যান।

আর তারই ফলশ্রুতিতে অর্থাৎ আলেমদের আন্দোলনের সঙ্গে অন্যান্য রাজনৈতিক দলের দ্বারা মার্শাল-ল’ ভঙ্গ হয়। যাকে ভিত্তি করে সৃষ্ট গণআন্দোলনে আইয়ুবের পতন হয় ও মরহুম শেখ মুজিবেরও মুক্তি সম্পন্ন হয়।

 

মাওলানা শামসুল হক ফরিদপুরী স্বভাবগতভাবে বিনয়ী, নম্র ও মিষ্টভাষী ছিলেন। তবে জাতীয় জীবনের যেকোন সমস্যায় তিনি নির্ভীক ভূমিকা পালন করতেন। তিনি কারও রক্তচক্ষুকে পরোয়া করে কথা বলতেন না। মাওলানা শামসুল হক দেশের রাজনীতি, অর্থনীতি, শিক্ষা-সংস্কৃতি, সাহিত্য, সাংবাদিকতা সকল ক্ষেত্রে ইসলামী জীবনাদর্শের প্রাধান্য প্রতিষ্ঠায় সচেষ্ট ছিলেন। এ উদ্দেশ্যে তিনি প্রধানত শিক্ষা-সাহিত্য অঙ্গনে বিরাট অবদান রাখলেও দেশে ইসলামী শাসনতন্ত্র রচনা ও ইসলামী সমাজব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার আন্দোলনেও বিশেষভাবে জড়িত ছিলেন। বার্ধক্যজনিত কারণে শেষের দিকে রাজনৈতিক অঙ্গনে তাঁকে প্রত্যক্ষভাবে তেমন একটা দেখা না গেলেও ইসলামী আন্দোলনের নেতা-কর্মীবৃন্দের সাথে ঘনিষ্ঠভাবে তাঁর যোগাযোগ বজায় ছিল। তিনি ছিলেন যাবতীয় কোন্দল ও সংকীর্ণতার ঊর্ধ্বে। দল-মত নির্বিশেষে সকল শ্রেণীর আলেম ও মুসলমানদের মাঝে ঐক্য সাধনে সদা সচেষ্ট। জাতীয় বিভিন্ন সমস্যার ক্ষেত্রে দেশের আলেম সমাজের ঐক্যবদ্ধ মতামত ব্যক্ত করার প্রয়োজন দেখা দিলে তাঁর নেতৃত্বেই সেটা সম্ভব হতো। জামায়াতে ইসলামী ও অন্যান্য ইসলামী দলের সঙ্গে মিশে তিনি বহু কাজ করেছেন। অন্যদের ন্যায় পান থেকে চুন খসতেই তিনি কোন ইসলামী দলের সঙ্গে অনৈক্যের প্রাচীর গড়ে তুলতেন না।

ব্যক্তিগত পর্যায়ে তিনি তাঁর আধ্যাত্মিক গুরু উপমহাদেশের অন্যতম শ্রেষ্ঠ বুজুর্গ ও মহাসাধক, বহু গ্রন্থপ্রণেতা মাওলানা আশরাফ আলী থানভী (র.)-এর আদর্শে দ্বীনী শিক্ষার বিস্তার, পীরী-মুরিদী ও মাতৃভাষায় সাহিত্য রচনার উপর অধিক গুরুত্ব আরোপ করেন, সমাজসংস্কার সাধন এবং সমাজের মানুষকে সৎকর্মশীল, সৎ নাগরিক ও ইসলামী আদর্শের খাঁটি অনুসারী করে গড়ে তোলার উদ্দেশ্যে তিনি অন্তরের গভীর দরদ দিয়ে অনেকগুলো পুস্তক রচনা করে গেছেন। অন্য ভাষাভাষী মনীষীদের একাধিক গ্রন্থও তিনি অনুবাদ করেছেন। তাঁর লিখিত এসব বই কেবল বাংলা সাহিত্য ভান্ডারেরই সম্পদ নয়, মানুষকে চরিত্রবান, খোদাভীরু করণে, সমাজ সংস্কারে ও ইসলামী আন্দোলনকে সুসংহত করার কাজে বিরাট ভূমিকা পালন করছে। সূফী সাধক মাওলানা শামসুল হক ফরিদপুরী সাহেবের জীবনের প্রধান বৈশিষ্ট্যই হলো এই যে, তিনি একাধারে ছিলেন শিক্ষাবিদ, সংস্কারক, লেখক, সমাজসেবী নেতা এবং সাথে সাথে নিঃস্বার্থ খাঁটি পীর। ইংরেজি, বাংলা, আরবি, উর্দূ ও ফারসি এই পাঁচ ভাষার উপরই তাঁর দখল ছিল। জাতি ও ধর্মের একনিষ্ঠ দরদী ও বিরল ব্যক্তিত্ব সকল শ্রেণীর মানুষের পরম শ্রদ্ধার পাত্র ছিলেন। তিনি ছিলেন একজন নিষ্ঠাবান ব্যক্তি। নীতি-আদর্শের প্রশ্নে কোন দিন অন্যায়-অসত্যের কাছে মাথা নত করতেন না।

কোন প্রকার লোভ-প্রলোভন ও চাপের মুখে নতি স্বীকার করা তার স্বভাব বিরুদ্ধ ছিল। দ্বীন ও শরীয়তের মাপকাঠির ব্যতিক্রম তিনি কোনো কিছু করতে রাজি হতেন না। পরহেযগারী, খোদাভীতি, সাধুতা, ভদ্রতা, নম্রতা, সহনশীলতা, পরোপকারিতা প্রভৃতি মহৎগুণ ছিল তার জীবনের প্রধান ভূষণ। মাওলানা শামসুল হক ফরিদপুরী ইসলামের জন্যে নিবেদিত প্রাণ, আত্মমর্যাদাবোধ সম্পন্ন খালেস একজন নায়েবে নবী তথা অন্যতম ওয়ারেসুল আম্বিয়া হিসাবেই নিজ ব্যক্তি চরিত্রকে গড়ে তুলেছিলেন। নিষ্ঠাবান খোদাপ্রেমিক এ মহৎ ব্যক্তির পরিচালিত কর্মময় জীবন হাজারো মানুষের জন্যে হেদায়াত ও পথের দিশা হিসাবে কাজ করেছে। তার অসংখ্য ভক্ত অনুরক্ত দেশ-বিদেশে ছড়িয়ে আছে। শতশত ছাত্র তাঁর কাছে ইসলামী শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ লাভ করে দেশ, সমাজ ও দ্বীন শরীয়তের খাদেম হিসাবে নিজ নিজ কর্মক্ষেত্রে ইসলামের আলো বিস্তার করছে। মাওলানা ফরিদপুরীর মতো আদর্শবান এবং বিভিন্নমুখী জ্ঞানপ্রতিভার অধিকারী খোদাভীরু আলেমের নেতৃত্ব যে মুহূর্তে সমাজের অধিক প্রয়োজন, সে মুহূর্তে তাঁর এ শূন্যতা পূরণে অনুরূপ চরিত্রের তাঁর কোনো শিষ্য অনুসারীই উপযুক্ত ভূমিকা পালন করতে পারেন। তারা ঐক্যবদ্ধ হয়ে তারই অনুরূপ সার্বিক যোগ্যতা নিয়ে দেশ জাতি ধর্মের স্বার্থে এগিয়ে আসার দ্বারাই তাঁর প্রতি যেমন উপযুক্ত সম্মান প্রদর্শন করা যেতে পারে, তেমনি জাতি তার অনুসারীদের দ্বারা কল্যাণপ্রাপ্ত হতে পারে।

Spread the love