সারা দেশের মাদ্রাসাসমূহ

মাওলানা মুফতি মাহফুজুল হক এর সংক্ষিপ্ত জীবনী

October 29 2020, 04:59

Manual4 Ad Code

নাম :- মুফতি মাহফুজুল হক

উপমহাদেশের প্রখ্যাত হাদিস বিশারদ, রাজপথের আপোষহীন নেতা শায়খুল হাদিস আল্লামা আজিজুল হক রহমাতুল্লাহি আলাইহির সুযোগ্য সন্তান মুফতি মাহফুজুল হক। বর্তমানে তিনি বেফাকুল মাদারিসিল আরাবিয়া বাংলাদেশের ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব ও জামিয়া রাহমানিয়া আরাবিয়া মোহাম্মদপুরের মুহতামিম হিসেবে দায়িত্বরত আছেন।

১৯৬৯ সালের নভেম্বর মাসের মাঝামাঝিতে ঢাকার আজিমপুরে মুফতি মাহফুজুল হকের জন্ম। তেরো ভাইবোনের সংসারে তিনি অষ্টম। বাবা শায়খুল হাদিস (রহ.)-এর কাছে প্রাথমিক শিক্ষার হাতেখড়ি। এর পর আজিমপুর চাঁনতারা মসজিদ সংলগ্ন হিফজ মাদরাসায় হাফেজ আবদুল মতিন (রহ.)-এর কাছে পবিত্র কোরআন হেফজ করেন। মুফতি মাহফুজুল হক হেফজের শেষ সবক শোনান উপমহাদেশের প্রখ্যাত বুজুর্গ হজরত মোহাম্মদুল্লাহ হাফেজ্জী হুজুর (রহ.)-এর কাছে। এ সময় মুহাদ্দিস সাহেব হুজুরখ্যাত মাওলানা হেদায়েতুল্লাহ (রহ.), মুফতি আব্দুল মুইজ (রহ.) ও মাওলানা আবদুল মজিদ ঢাকুভী হুজুর (রহ.)সহ লালবাগ মাদরাসার অন্য উস্তাদরাও উপস্থিত ছিলেন। ১১ বছর বয়সে তিন বছরের কম সময়ে তিনি হেফজ সম্পন্ন করেন।

Manual1 Ad Code

মুফতি মাহফুজুল হক হাফেজ হওয়ার পর লালবাগ মাদরাসার কিতাব বিভাগে ভর্তি হন। নাহবেমীর জামাতে পড়ার সময় ১৯৮৪ সালে হাফেজ্জী হুজুর (রহ.)-এর আহ্বানে জেনারেল এরশাদ বিরোধী আন্দোলনে যোগ দেন এবং মাত্র ১৪ বছর বয়সে গ্রেফতার হয়ে কারাবরণ করেন।

১৯৮৬ সালে লালবাগ মাদরাসায় বিভক্তির ফলে মাদরাসা বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর তিনি ভর্তি হন বড়কাটারা মাদরাসায়। কিন্তু সেখানে আর আনুষ্ঠানিক দরসে অংশ নেওয়া হয়নি। ইতিমধ্যে লালবাগ জামিয়া কোরআনিয়ার একাংশ ছাত্র-শিক্ষক নিয়ে মোহাম্মদী হাউজিং মোহাম্মাদপুরে শায়খুল হাদিস আল্লামা আজিজুল হক প্রতিষ্ঠা করেন জামিয়া মোহাম্মদিয়া মাদরাসা। ফলে মুফতি মাহফুজুল হক বড়কাটারা আর না গিয়ে চলে যান জামিয়া মোহাম্মাদীয়ায়। এখানে ২ বছর মাদরাসা চলার পর শায়খুল হাদিস (রহ.) জামিয়া রাহমানিয়া আরাবিয়া নামে ঐতিহাসিক সাতমসজিদ সংলগ্নে মাদরাসা স্থানান্তর করেন। মুফতি মাহফুজুল হকও চলে আসেন জামিয়া রাহমানিয়ায়। অতপর এই জামিয়া রাহমানিয়া থেকেই ১৯৯১ সালে দাওরায়ে হাদিস শেষ করে ‘মাওলানা’ সনদ লাভ করেন। ১৯৯২ সালে দ্বিতীয়বার দাওরায়ে হাদিস পড়ার উদ্দেশ্যে ভারতের দারুল উলুম দেওবন্দে গমন করেন ।

১৯৯২ সালের ৬ ডিসেম্বর ভারতের উগ্রবাগী হিন্দুদের হাতে ঐতিহাসিক বাবরি মসজিদ ধ্বংস হয়। এর প্রতিবাদে শায়খুল হাদিস (রহ.) ভারত অভিমুখে লংমার্চের ডাক দেন। তার এ কর্মসূচি বিশ্বে ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি হয়। এ কারণে শায়খুল হাদিস (রহ.)-এর সন্তান হিসেবে মুফতি মাহফুজুল হকের নিরাপত্তা নিয়ে দেওবন্দের উস্তাদগণ বিশেষ করে ওয়াকফ দেওবন্দের মাওলানা আনজার শাহ কাশ্মিরী (রহ.) উদ্বেগ প্রকাশ করে বিভিন্ন পরামর্শ দিয়ে আগলে রাখেন। ১৯৯২ সালে দেওবন্দ থেকে দ্বিতীয়বারের মতো দাওরায়ে হাদিস শেষ করে ‘কাসেমী’ সনদ লাভ করেন।

শিক্ষাজীবন শেষে ১৯৯৩ সালে জামিয়া রাহমানিয়ায় শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন। শিক্ষকতার পাশাপাশি তিনি দারুল ইফতায় অধ্যয়ন শুরু করেন এবং সফলতার সঙ্গে ‘মুফতি’ সনদ লাভ করেন। রাহমানিয়ায় শিক্ষক হিসেবে নিয়োগের অল্পদিনেই সুখ্যাতি অর্জন করতে সক্ষম হন। ২০০০ সাল পর্যন্ত ছাত্রদের বুনিয়াদি কিতাবগুলো দক্ষতার সঙ্গে পাঠ দেন।

২০০০ সালে শায়খুল হাদিস (রহ.) জামিয়া রাহমানিয়া থেকে চলে আসেন। রাজনৈতিক কারণে সরকারের প্রচ্ছন্ন সহায়তা ও প্রশাসনের মদদে সৃষ্ট পরিবেশের কারণে তিনি রাহমানিয়া ছেড়ে মোহাম্মদপুরের কুবা মসজিদকে কেন্দ্র করে হাদিসের দরস অব্যাহত রাখেন এবং জামিয়া রাহমানিয়া হাকিকিয়া নামে মাদরাসার কার্যক্রম শুরু করেন। জামিয়া হাকিকিয়ার মুহতামিম হিসেবে নিযুক্ত হন মুফতি মাহফুজুল হক।

২০০১ সালের শেষের দিকে শায়খুল হাদিস (রহ.) পুনরায় জামিয়া রাহমানিয়া ফিরে আসেন। তখন মুফতি মাহফুজুল হক প্রথমে ভাইস প্রিন্সিপাল ও ২০০২ সাল থেকে প্রিন্সিপালের দায়িত্ব পান। সেই থেকে দক্ষতার সঙ্গে প্রিন্সিপালের দায়িত্ব পালন করে আসছেন। পাশাপাশি বোখারি শরীফের কিছু অংশ এবং অন্য কিতাব নিয়মিত দরস দিয়ে আসছেন। ছাত্রদের পড়াশোনা, পরীক্ষার ফলাফল এবং তালিম-তরবিয়তের পাশাপাশি রাহমানিয়ার ঐতিহ্যবাহী ধারা তিনি সমুন্নত রেখেছেন।

কওমি মাদরাসাগুলোর নিয়ন্ত্রক প্রতিষ্ঠান ও উলামায়ে কেরামের সর্ববৃহৎ ঐক্যবদ্ধ প্ল্যাটফর্ম বেফাকুল মাদারিসিল আরাবিয়ার যুগ্ম-মহাসচিব হিসেবে নির্বাচিত হন ২০০৫ সালের কাউন্সিলে। যুগ্ম-মহাসচিব হিসেবে চৌদ্দ বছরের বেশি সময় বেফাকে গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা রাখেন। কওমি মাদরাসা শিক্ষাব্যবস্থার উন্নতি, নেসাব সংস্কার, কওমি সনদের স্বীকৃতি, কওমি কমিশন থেকে শুরু করে বেফাকের অগ্রযাত্রার প্রতিটি ধাপেই রয়েছে তার সরব অংশগ্রহণ। শায়খুল হাদিস (রহ.)-এর সঙ্গে কওমি সনদের সরকারি স্বীকৃতির আন্দোলনে যেভাবে সক্রিয় ছিলেন, পরবর্তীতে কওমি সনদের স্বীকৃতি অবিস্মরণীয় ভূমিকা পালন করেন। তিনি কওমি মাদরাসার সবোর্চ্চ নিয়ন্ত্রক সংস্থা আল হাইআতুল উলয়ার একজন গুরুত্বপূর্ণ সদস্য।

বাংলাদেশের আলেম-উলামা বিশেষ করে কওমি মাদরাসার ছাত্র-শিক্ষকদের আশা-আকাঙ্খার প্রতীক বেফাক যাদের অক্লান্ত পরিশ্রমের ওপর ভর করে আজকের এই অবস্থানে পৌঁছেছে তাদের মধ্যে মুফতি মাহফুজুল হক একজন। সর্বশেষ ২০২০ সালের ৩ অক্টোবর তিনি বেফাকের ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব নির্বাচিত হন।

Manual3 Ad Code

বেফাকুল মাদারিসিল আরাবিয়া আলেমদের আস্থা ও বিশ্বাসের এক বিশ্বস্ত প্ল্যাটফর্ম। বেফাকের ত্যাগী মহাসচিব মাওলানা আবদুল জাব্বার জাহানাবাদী (রহ.)-এর ইন্তেকালের পর বেফাক তার পথ চলায় হোঁচট খায়। এমতাবস্থায় নানামহল থেকে দাবি ওঠে, বেফাক মহাসচিবের দায়িত্ব দক্ষ, যোগ্য, কর্মঠ ও তরুণ কোনো আলেমকে দেওয়ার। উদাহরণ হিসেবে পাকিস্তান বেফাকের মহাসচিব মাওলানা হানিফ জলন্ধরীকে দায়িত্ব প্রদান এবং বেফাকের বর্তমান অবস্থান নিয়ে আলোচনা ছড়িয়ে পড়ে মুখে মুখে। এমন বাস্তবতায় ২০২০ সালের ৩ অক্টোবর বেফাকের নির্বাহী কমিটির বৈঠকে মুফতি মাহফুজুল হককে বেফাকের ভারপ্রাপ্ত মহাসচিবের দায়িত্ব দেওয়া হয়। সাধারণ আলেমদের প্রত্যাশা, মুফতি মাহফুজুল হক সহকারী মহাসচিবের অভিজ্ঞতাসমৃদ্ধ কর্ম তৎপরতা, নিষ্ঠা, সততা ও স্বচ্ছতার সঙ্গে কাজ করে বেফাককে তার কাঙ্খিত স্থানে নিতে সক্ষম হবেন। আলেমদের আস্থার প্রতিদান তিনি দেবেন। বেফাককে একটি জাতীয় প্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়ে তুলবেন।

Manual1 Ad Code

মোহাম্মদপুর এলাকায় অবস্থিত মাদরাসাগুলোর পরস্পরে সম্পর্ক উন্নয়ন, প্রতিষ্ঠানের উন্নতি ও ঐক্যবদ্ধ অবস্থান সৃষ্টির লক্ষে প্রতিষ্ঠিত ‘ইত্তেফাকুল মাদারিসিল কওমিয়া মোহাম্মদপুর’ গঠন ও পথচলায় মুফতি মাহফুজুল হকের অবদান অপরিসীম।

মুফতি মাহফুজুল হকের কর্মতৎপরতা শুধু মাদরাসা, বেফাক ও মোহাম্মদপুর এলাকায় সীমাবদ্ধ নয়, রাজনীতির মাঠেও রয়েছে তার সক্রিয় উপস্থিতি। তরুণ বয়সে কারাবরণ আর শায়খুল হাদিস (রহ.)-এর সন্তান হিসেবে বলা চলে তিনি আন্দোলন-সংগ্রামের মাঝেই বেড়ে উঠেছেন। রাহমানিয়ায় শিক্ষক হিসেবে নিয়োগের পর বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসের রাজনীতিতে যুক্ত হন। ২০০৫ সালে দলটির শুরা সদস্য নির্বাচিত হন। ২০১২ সানে সহ-সভাপতির দায়িত্ব পান। ২০১৩ সাল থেকে ২০২০ সালের ১০ অক্টোবর পর্যন্ত তিনি দলের মহাসচিব হিসেবে দক্ষতার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করেন।

সাম্প্রতিককালের আলোড়ন সৃষ্টিকারী অরাজনৈতিক সংগঠন হেফাজতে ইসলামের ঢাকা মহানগর কমিটির সহ-সভাপতি মুফতি মাহফুজুল হক চলমান তাবলিগ ইস্যুতেও কার্যকর ভূমিকা রাখেন। তাবলিগের সংকট নিরসনে ভারত সফর থেকে শুরু করে সরকারের সঙ্গে আলোচনা ও রাজপথে বিশাল ভূমিকা রাখেন।

বিভিন্ন ইস্যুভিত্তিক আন্দোলন তিনি সক্রিয়। বিভিন্ন সামাজিক ও মানসেবামূলক সংগঠনের সঙ্গেও তিনি জড়িত। দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে অসংখ্য মসজিদ ও মাদরাসা তার তত্ত্বাবধানে পরিচালিত হয়। দেশের যেকোনো প্রান্তে আলেম-উলামাদের সংকট, নেতৃস্থানীয় আলেমদের জানাজায় মুফতি মাহফুজুল হকের উপস্থিতি অনেকটা রুটিন করা।

Manual2 Ad Code

দ্বীনের দাওয়াত, আলোচনা সভা, ওয়াজ মাহফিল কিংবা কওমি মাদরাসার স্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিষয়সহ নানা কাজে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে নিয়মিত সফর করেন। বিভিন্ন সেমিনার ও শিক্ষা প্রোগ্রামে অংশ নিতে সফর করেছেন দক্ষিণ আফ্রিকা, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, কাতার, ভারত ও পাকিস্তানসহ বেশ কিছু দেশ।

মুফতি মাহফুজুল হক চার সন্তানের জনক। তার স্ত্রীও কোরআনে কারিমের হাফেজ। তিন মেয়েও কোরআনের হাফেজ। ছেলেও হাফেজ হওয়ার পথে। বড় মেয়ের বিয়ে দিয়েছেন। সম্প্রতি তিনি নানা হয়েছেন।

তথ্য দানকারীর নাম :- মুফতি এনায়েতুল্লাহ

তথ্য দানকারীর মোবাইল :- muftianaet@gmail.com

Spread the love