সারা দেশের মাদ্রাসাসমূহ

মাওলানা ফয়েজ আহমদ কানাইঘাটী রাহ.এর সংক্ষিপ্ত জীবনী

June 21 2020, 08:02

Manual3 Ad Code

লিখেছেন : মু’তাসিম বিল্লাহ সাদী

Manual4 Ad Code

বাংলাদেশের আধ্যাত্মিক রাজধানী হযরত শাহজালালের পূণ্যভূমি শায়খুল ইসলাম মাদানী রাহ. এর চারণভূমি,আলেম ওলামা জন্মগ্রহণের উর্বভূমি নামে খ্যাত কানাইঘাট ৷ সেই কানাইঘাটে জন্মগ্রহণ করেছিলেন যুগের কলম সৈনিক,শেকড় সন্ধানী সাহিত্যিক, যিনি খুব কম সময়ে খ্যাতির শীর্ষে নিজেকে আসীন করেছিলেন আপন মেধা,প্রজ্ঞা, সমাজসেবা,ব্যক্তিত্ব ও সাধনার মাধ্যমে ঈর্ষণীয়ভাবে তিনি হলেন মাওলানা ফয়েজ আহমেদ কানাইঘাটী রাহ. ৷
জন্ম ও বংশ পরিচয় : মাওলানা ফয়েজ আহমদ কানাইঘাটী রাহ.১৯৬০ঈসায়ী মোতাবেক ১লা কার্তিক ১৩৬৭ বাংলা রোজ মঙ্গলবার সুবহে সাদিকের সময় সিলেট জেলার কানাইঘাট উপজেলার ২নং পশ্চিম লক্ষিপ্রসাদ ইউপির লোভা বরাক ও সুরমা নদীর মিলন কেন্দ্রের পশ্চিম তীরে প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি লক্ষীপ্রসাদ গ্রামের এক সম্ভ্রান্ত ধার্মিক পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন ৷ তিন ভাই-বোনের মধ্যে তিনি ছিলেন দ্বিতীয় ৷ তাঁর পিতার নাম মৌলভী গোলাম রব্বানী রাহ. বিন আসদ আলী ৷ তিনি ছিলেন নেককার উন্নত চরিত্রের অধিকারী এবং দ্বীনি কাজে অক্লান্ত পরিশ্রমী, একান্ত আগ্রহী নিষ্ঠাবান মসজিদের ইমাম ৷ তাঁর মাতার নাম নুরুন্নেসা তিনিও ছিলেন দ্বীনদার আল্লাহ ওয়ালা পর্দানশীন রমণী ৷ তৎকালীন দেশের পীর-মাশায়েখ, আলেম-ওলামা ও বুযুর্গদের আসা-যাওয়ায় ধন্য হয়েছিল এই বাড়িটির প্রতিটি ধূলিকণা ৷

Manual6 Ad Code

শিক্ষাজীবন : প্রাকৃতিক ও জন্মগতভাবে তীক্ষ্ণ মেধার অধিকারী মাওলানা ফয়েজ আহমদের পিতাই হলেন প্রাথমিক শিক্ষার হাতেখড়ি ৷ তিনি তার সন্তানকে প্রকৃতপক্ষে একজন নায়বে নবী হিসাবে গড়ে তোলার জন্য নিজ কর্মস্থল বাগিচা বাজার মসজিদে সকালে যাওয়ার সময় তাঁকে নিয়ে যেতেন সারা দিন নিজের তত্ত্বাবধানে রেখে শিক্ষা-দীক্ষা দানের পর রাতে বাড়িতে নিয়ে আসতেন ৷
এরপর নিজ গ্রামের স্কুলে ভর্তি হয়ে পঞ্চম শ্রেণী পর্যন্ত অত্যন্ত কৃতিত্বের সাথে শিক্ষা লাভ করেন ৷ বাল্যকালে পিতার সাথে অতি আগ্রহের সহিত পবিত্র রমজান মাসে এতেকাফ করতেন ৷
অতঃপর দ্বীনি শিক্ষা অর্জনের জন্য কানাইঘাট লালারচক রহমানিয়া মাদরাসায় ভর্তি করে দেন ৷ সেখানে অত্যন্ত সুনামের সাথে ছাফেলা ছুওম ( ৭ম শ্রেণি ) পর্যন্ত লেখাপড়া করেন ৷ এরপর ঐতিহ্যবাহী কানাইঘাট দারুল উলুম মাদরাসায় পুনরায় সপ্তম শ্রেণীতে ভর্তি হয়ে তাকমিল ফিল হাদিস পর্যন্ত অত্যন্ত সুনাম ও সুখ্যাতির সাথে প্রতিটি জামাতে ও বোর্ডের ক্লাসেও প্রথম বিভাগে প্রথম স্থান অধিকার করে ১৯৮৩ সালে সর্বোচ্চ ডিগ্রি দাওরায়ে হাদীসের সনদ লাভ করেন অত্যন্ত কৃতিত্বের সাথে ৷
তিনি যাঁদের অক্লান্ত কর্মপ্রচেষ্টা ও স্নেহমমতায় ইলমে দ্বীন হাসিল করতে সক্ষম হন সেসকল শ্রদ্ধাভাজন উস্তাদদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ক’জন হলেন – শায়খুল হাদীস আল্লামা শহর উল্লাহ রাহ., শায়খুল হাদীস মাওলানা ফয়জুল বারী মহিষপুরী রাহ., মাওলানা আব্দুল হাফিজ কুররমাটি রাহ.,শায়খুল হাদীস মাওলানা মোহাম্মদ বিন ইদ্রীস লক্ষিপুরী,শায়খুল হাদীস মাওলানা আলিমুদ্দীন দুর্লভপুরী প্রমুখ মনীষীগণ ৷
তাঁর উস্তাদরা তাকে নিয়ে গর্ব করতেন ৷ তার প্রখর মেধা নিয়ে পরষ্পর আলোচনা করতেন এবং তার উজ্জল ভবিষ্যত কামনা করতেন ৷
কর্মজীবন : সুযোগ্য ও প্রতিভাবান এ আলেমে দ্বীন কর্মজীবন হিসাবে শিক্ষকতাকে বেছে নেন সানন্দে ৷ শিক্ষাঙ্গনে ঐশ্বরিক জ্ঞান বিতরণ করা হয়,মানব সভ্যতার সূচনা থেকেই জ্ঞান অর্জন ও বিতরণের প্রক্রিয়া চলে আসছে ৷ নীতি- নৈতিকতা ও মানবিক মূল্যবোধ সৃষ্টি, ইসলামী সমাজ ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা তথা মুসলমানদের বস্তুতগত ও পার্থিব উন্নতির লক্ষ্যে শিক্ষকতার মাধ্যমে তিনি এক মহান মিশনের সূচনা করেন শতাব্দী প্রাচীন মাদরাসা জৈন্তাপুর উপজেলার ঐতিহ্যবাহী মদিনাতুল উলুম খরিলহাট মাদরাসায় ৷ এখানে তার কর্মজীবনের শুরু ৷ এখানে অত্যন্ত সুনামের সাথে বছর এক শিক্ষকতা করার পর তাঁর সহপাঠি সাহিত্যিক সাংবাদিক,কলামিষ্ট মাওলানা খলিলুর রহমানের অনুরোধে চলে যান সিলেট সদর উপজেলার রাজারগাঁও মাদরাসা ৷ সেখানে অত্যন্ত সুনামের সাথে বছর তিনেক শিক্ষকতা করার পর ১৯৮৭ সালে আল্লামা শহর উল্লাহ রাহ.এর ইন্তেকালের পর উস্তাদগণের নির্দেশে ঐতিহ্যবাহী দারুল উলুম কানাইঘাট মাদরাসায় চলে আসেন ৷ এখানে অত্যন্ত সুনাম ও দক্ষতার সাথে পাঠদানের ফলে তাঁর শিক্ষকগণ দরসে নেজামীর গুরুত্বপূর্ণ কিতাবসমূহ তাঁর নেসাবে দেন, মিযানুস সরফ,কাফিয়া,মুখতাসারুল মাআনী,মাকামাতে হারিরী,শরহে আকাঈদে আন নাসাফী ও আবুদাউদ শরীফের মত কঠিন কিতাবসমূহ সিংহ সাবকের ন্যায় পাঠদান করেন ৷ তাঁর পাঠদান ছিল বিপুল সাড়া জাগানো, অভূতপূর্ব আলোড়ন সৃষ্টিকারী যা আজও তাঁর ছাত্রগণ প্রসংশায় পঞ্চমুখ ৷
স্মরণ শক্তি ও কিতাব অধ্যায়ন : স্মরণ শক্তি বা স্মৃতি শক্তি আল্লাহ তাআলার অনেক বড় নিয়ামত। আল্লাহ তাআলা এনিয়ামত যাঁদেরকে দান করেছেন,তাঁরা তার যথাযত মূল্যায়ন করে নিজেকে জ্ঞানের আলোয় আলোকিত করার পাশাপাশি অন্যের মাঝে জ্ঞানের আলো বিতরণ করে স্বরণীয় ও ভরনীয় হয়ে আছেন ৷ তাঁর সাথীগণ বলেন যে, এলাকার মসজিদে রমজান মাসে ১০ দিন এতেকাফের মধ্যে তিনি ১৫ পারা কোরআন শরীফ হেফজ করেন ৷ তিনি নিজেই অনেক সময় বলতেন,এশারপর কিতাব অধ্যয়নে বসতেন কিন্তু রাত শেষ হয়ে সূর্যদয় হয়ে গিয়েছে তিনি খেয়াল করতে পারেননি ৷ তাঁর স্মরণশক্তি এতো প্রখর হওয়া সত্বেও অধ্যয়ন বা মোতালাআ করতেন সবচেয়ে বেশি ৷ এত বেশি অধ্যয়নের কারণে অনেক সময় তিনি অসুস্থ হয়ে পড়তেন ৷ তাঁর উস্তাদগন ও ডাক্তাররা দীর্ঘক্ষণ অধ্যয়ন না করার পরামর্শ দিয়ে বলতেন, অধিক অধ্যয়নের কারণে তোমার শরীরের এ অবস্থা ৷ তবু ও তিনি অধ্যয়ন থেকে বিরত থাকেন নি,অধ্যয়ন ছিল তাঁর সবসময়ের নেশা ৷ মাদরাসা সিলেবাসের গুরুত্বপূর্ণ কিতাব কাফিয়া,মাকামাতে হারিরী ও মুখতাসারুল মাআনীর মত কঠিন কিতাব তাঁর মুখস্ত ছিল ৷

তিনি ছিলেন কিতাবের উইপোকা,কোথায়ও কোনো নতুন কিতাবেন সন্ধান পেলে তা সংগ্রহ করে পড়ার জন্য ব্যাকুল হয়ে যেতেন ৷ এব্যাপারে একটি ঘটনা পেশ করছি , শায়খুত তাফসির আল্লামা নূরুল ইসলাম ওলিপুরী হাফিজাহুল্লাহ “কুয়েত সফরের কাহিনী” শিরোনামে মাসিক মঈনুল ইসলাম পত্রিকায় ১৯৯৫ সালে একটি প্রবন্ধ লিখেছিলেন ৷ সে প্রবন্ধে তিনি বলেন,কুয়েতের একজন শায়খ তাকে জিজ্ঞাসা করেছিলো,কুয়েত সফরে আপনার কাছে সবচেয়ে বেশি কোন জিনিস পছন্দনীয় লেগেছে ? তিনি বলেন,”আল মাওসূআতুল ফিকহিয়তুল কুয়েতিয়া ”
( الموسوعة الفقهية الكويتية)
নামক বিশাল কিতাবখানা আমার কাছে সবচেয়ে বেশি পছন্দনীয় লাগছে ৷ সাথে সাথে হযরত ওলিপুরীকে কুয়েতের এই শেখ কিতাবখানা হাদিয়া দিলেন ৷ হযরত কানাইঘাটী রাহ. এই কিতাবখানার সন্ধান পেয়ে ( কানাইঘাট দারুল উলুম মাদরাসার মুহাম্মদীয়া কুতুবখানার ভবন ও কিতাবাদী কুয়েতের শেখ মুহাম্মদ নামে একজন দানবীর, দ্বীনদার ও আলেম ওলামা ভক্ত দান করেছিলেন ) সাথে সাথে শেখ মুহাম্মদের কাছে পত্র লিখেন ৷ পত্র পেয়ে শেখ মুহাম্মদ ৩০ খন্ডের বিশাল কিতাব খানা কানাইঘাট মাদরাসার মুহাম্মদীয়া কুতুবখানায় পাঠান ৷ এই বৃহৎ কিতাবখানা পরবর্তিতে আরো বর্ধিত হয়ে বর্তমানে ৪৫ খন্ডে আছে ৷ মুহাম্মদীয়া কুতুবখানার প্রায় কিতাবাদী তিনি শেখ মুহাম্মদের সাথে যোগাযোগ করে সংগ্রহ করেছেন ৷

ওয়াজ নসীহত ও সামাজিক কর্মকাণ্ড : বিভিন্ন সামাজিক ও রাজনৈতিক সংগঠনের সঙ্গে তিনি জড়িত ছিলেন অঙ্গাঙ্গীভাবে ৷ নিজ এলাকার প্রত্যেকটি সামাজিক সংগঠনে তাঁর ভূমিকা ছিল অগ্রগণ্য ৷
তখনকার সময়েও পূর্বসিলেট অঞ্চলে বিষয় ভিত্তিক মুনাযারা ( তর্কানুষ্ঠান) মুশাআরা (কাব্যানুষ্ঠান ) অনুষ্ঠিত হত ৷ এতে বিভিন্ন মাদরাসার মেধাবী,তার্কিক ও বাকপটু ছাত্ররা অংশগ্রহণ করত ৷ মাওলানা কানাইঘাটী রাহ.এসব অনুষ্ঠানে অংশ নিতেন ৷ তিনি যেখানে যেতেন এবং যে দলে যোগ দিতেন সেখানে তাঁর ও তাঁর দলের বিজয় ছিল অবধারিত ৷ ফলে ছাত্রজীবনেই তাঁর সুনাম চতুর্দিকে ছড়িয়ে পড়ে ৷
তিনি ছিলেন একজন স্পষ্টভাষী বক্তা যখন কোরআন হাদিসের আলোকে যুক্তিপূর্ণ বয়ান পেশ করতেন তখন অনেক আধুনিক শিক্ষিতরা তাঁর প্রাঞ্জল ভাষায় বয়ান শুনে সত্য পথের সন্ধান পেতো ৷ তিনি নিজগ্রাম ও সিলেট শহরস্থ সুবিদবাজার জামে মসজিদের খতিব ছিলেন ৷
একদিকে বাতিল অন্যায়ের বিরুদ্ধে তিনি ছিলেন বলিষ্ঠ কণ্ঠস্বর,অটল,অবিচল এক অসাধারণ ব্যক্তিত্ব ৷ অপরদিকে হক্ব কথা বলতে তিনি যেমন বিন্দুমাত্র দ্বিধাবোধ করতেন না, তেমনি বাতিলের রক্তচক্ষু তাকে হক্ব পথ থেকে একচুল পরিমাণও সরাতে পারেনি ৷ আকাবির উলামায়ে কেরামের শুরু করা ব্রিটিশ খেদাও সংগ্রামসহ প্রতিটি দ্বীনি আন্দোলনে হক্ব ও হক্বানিয়াতের জগতখ্যাত উলামায়ে কেরামের সংগঠন জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম সিলেট জেলা শাখার সাহিত্য সম্পাদকের দায়িত্বে ও খতমে নবুওয়ত আন্দোলন পরিষদের নেতা ছিলেন ৷ রাজনৈতিক ময়দানে তাঁর অপরিহার্যতা প্রমাণ করতে গিয়ে বাংলাদেশের প্রচলিত ইসলামী রাজনীতি সম্পর্কে তাঁর যে মনোভাব ছিল, তা প্রকাশ করতে মাসিক মঈনুল ইসলাম ( যা বাংলাদেশের সর্ব শ্রেষ্ঠ ইসলামী বিদ্যাপীঠ দারুল উলুম মঈনুল ইসলাম হাটহাজারী মাদ্রাসা থেকে প্রতিমাসে প্রকাশিত হয় ) বিগত ১৪১৫ হিজরী রজব ও রমজান সংখ্যাদ্বয়ে পৃথক পৃথক দুটি প্রবন্ধ লেখেন ৷ প্রথম প্রবন্ধ “ইসলামী রাষ্ট্র আদিষ্ট না প্রতিশ্রুত” এবং দ্বিতীয় প্রবন্ধ “ইসলামী আন্দোলন ও কিছু কথা” এবং মাসিক তৌহিদী পরিক্রমায় আরেকটি প্রবন্ধ দেখেছেন “ইসলামের নামে এত দলাদলি কেন” যা বর্তমান রাজনীতিবিদগণের জন্য চিন্তার নব দিগন্ত উন্মোচন করেছে নিঃসন্দেহে ৷ আধ্যাত্মিক সাধনার ব্যাপারে ও তাঁর সজাগ দৃষ্টি ছিল,তিনি আত্মশুদ্ধির জন্য অত্যন্ত সোচ্চার ছিলেন ৷ একদা তিনি শায়খুল ইসলাম সায়্যিদ হযরত হোসাইন আহমদ মাদানী রাহ. এর বিশিষ্ট খলীফা শায়খুল হাদীস আল্লামা আহমদ আলী বাঁশকান্দি রাহ. এর খেদমতে গিয়ে বায়আত হন ৷ শায়খ বাঁশকান্দির কাছ থেকে আধ্যাত্মিক সবক নিয়ে দেশে ফিরেন ৷ এবং তাঁর বাতানো অজিফা সমূহ আদায়ে অভ্যস্থ থাকেন ৷ তাঁর দৈনন্দিন চলাফেরা ও লেবাস-পোশাক ছিল জাকজমক বিহীন অতি সাদাসিদে,মামুলি পোশাক থাকতো তাঁর পরিধানে ৷ বিলাসিতা ছিল তাঁর নিকটে সম্পূর্ণ অপরিচিত ৷ ব্যবহারিক জীবনে তিনি ছিলেন সদালাপী অমায়িক ৷
মুফাক্কিরে ইসলাম আল্লামা শফিকুল হক আকুনী রাহ. তাঁর জীবদ্ধশাতেই এক প্রসঙ্গে বলেছিলেন, মরহুম মাওলানা ফয়েজ আহমদের বয়ান শুনার পর আমার অন্তরে প্রশান্তি লাভ হয় ৷ তাঁর বয়ানে জ্ঞান-গরিমায় অসাধারণ আধ্যাত্মিক শক্তির পরিচয় পাওয়া যেত ৷
গাছবাড়ি জামিউল উলুম কামিল মাদ্রাসার সাবেক মুহাদ্দিস আল্লামা ইদ্রীস আহমদ শেবনগরী রাহ. মরহুম মাওলানা ফয়েজ আহমদ সম্পর্কে বলেছিলেন,আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে হযরত সালেহ আঃ এর উটনীর মত ইলমের এক খাজানা দান করেছিলেন ৷ আমরা তাঁর যথাযথ মূল্যায়ন করতে পারিনি ৷
সাহিত্য কর্ম : নববই এর দশকে কওমি অঙ্গনে বাংলাভাষার তেমন চর্চা ছিল না ৷ সেসময়ে তিনি বাংলা,আরবি,উর্দু ও ইংরেজি ভাষায় সমানভাবে পারদর্শী ছিলেন ৷ তিনি মনে করতেন ব্যাপক ভাবে ইসলামী শিক্ষার প্রচার-প্রসার করতে হলে একান্ত প্রয়োজন মাতৃভাষার ওপর দক্ষতা অর্জন করা ৷ তিনি ছিলেন আলোড়ন সৃষ্টিকারী লেখক, সাহিত্যিক ও সাহিত্যের সব শাখায় ছিল তাঁর দীপ্ত প্রদচারণা ৷ প্রথিতযশা এ ব্যক্তিত্ব মাসিক মদীনা, মাসিক মঈনুল ইসলাম, মাসিক তৌহিদী পরিক্রমা ,মাসিক আত-তাওহীদ, সাপ্তাহিক মুসলিম জাহানসহ সম-সাময়িক নানা প্রসঙ্গ নিয়ে নিয়মিত গবেষণাধর্মী লেখা লিখতেন ৷ তিনি একজন পাঠক নন্দিত লেখক, প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট ছিলেন ৷ তাঁর লেখালেখির পদ্ধতিরর ছিল খুবই সুন্দর তথ্যবহুল ও সুনিপুণ ৷ তাঁর লেখায় থাকে প্রাঞ্জল ভাষা ও সাহিত্যের সমারোহ ৷ অমার্জিত ও অরুচিমূলক লেখা পরিহার করে নতুন-পুরাতন উৎস সমূহ উপর গবেষণা ও বিশ্লেষণ করে নিজের চিন্তার ফলাফলকে অত্যন্ত গুরুত্ব ও সতর্কতার সাথে পেশ করতেন ৷ তাঁর মার্জিত সাবলীল হৃদয়গ্রাহী লেখা সর্বমহলে সমাদৃত হয়েছিল ৷ এতে জাতি উপকৃত হয়েছে বলে সর্বজন স্বীকৃত ৷ ৷ তাঁর লিখিত রচনাবলীর মধ্যে রয়েছে- ১.মওদুদীবাদ ও সাহাবায়ে কেরাম ,২.উর্দু চৌথী কিতাবের বাংলা অনুবাদ ,৩.ইসলামী শিক্ষা ও আধুনিক,৪.খতমে নবুওয়াত ও কাদিয়ানী ধর্মমত,৫.কুরআন ও রমজানের ফজিলত ,৬.নারীর স্বাধীনতা ও অন্যান্য প্রসঙ্গ ৷ এছাড়া আরো প্রায় অর্ধশতাধিক প্রবন্ধ রয়েছে, যা প্রত্যেক প্রবন্ধ ছোট ছোট একেকটি পুস্তক হবে ৷ তিনি নিজেই বলেছেন,মাওলানা মুহিউদ্দীন খান সাহেব আমার নামের শেষে কানাইঘাটী সংযোগ করে দিয়েছিলেন ৷
হযরত মাওলানা ফয়েজ আহমদ কানাইঘাটী রাহ.এর ইন্তেকালের পর তাঁর জীবনালেখ্যর ওপর একটি স্মারক বের করার উদ্যোগ নেওয়া হয় ৷ কিন্তু অত্যন্ত দুঃখের বিষয় প্রায় লেখা সংগ্রহ করার পর তা আর প্রকাশিত হয়নি ৷ এ স্মারকে বিশ্ববরেণ্য ইসলামি ব্যক্তিত্ব,বাংলায় সীরাতের নববধূ,মাসিক মদীনার প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক আল্লামা মুহিউদ্দীন খান রাহ. যে লেখা দিয়েছিলেন,তা হুবহু তুলে ধরা হল,
“হযরত মাওলানা ফয়েজ আহমদ কানাইঘাটীর সাথে আমার সরাসরি সাক্ষাত হয়নি ৷ ৯০এর দশকের প্রথমাংশে মাসিক মদীনায় তিনি যে লেখা পাঠাতেন তা ছিল অগোছালো এলোমেলো ও ভাষার দিক দিয়ে নিম্নমানের ৷ লেখালেখি ব্যাপারে পত্রমাধ্যমে আমার দিক নির্দেশনার ফলে অল্পদিনের মধ্যে তাঁর লেখার মানমর্যাদা দেশের সেরা কয়েকজন লেখকের মধ্যে তিনি একজন গণ্য হন ৷ মাসিক মদীনার কোনো সংখ্যাতে তিনি লেখা না পাঠালে আমি পত্র দিয়ে তাকে লেখা দেওয়ার জন্য বারবার তাগিদ দিতাম ৷ কেননা তাঁর তত্ববহুল প্রবন্ধগুলো আমার কাছে ও পাঠক মহলে খুবই জনপ্রিয় ও ফলপ্রসু ছিলো ৷ আমার আশা ছিল আল্লামা মুশাহিদ বায়মপুরী রাহ. এর ওফাতে যে শূন্যতা হয়েছিল তিনি তাপূর্ণ করবেন ও তাঁর স্থলাভিষিক্ত হবেন ৷ আল্লাহ তাআলার মহিমা তিনি অল্পবয়সে আমাদের ছেড়ে পরকালে চলেগেলেন ৷ তাঁর মত আর দশ বারোজন লেখক হলে বাতিলের মোকাবেলা করা আর সহজ হত “৷ ৭০এর দশক থেকে গ্রামবাংলার প্রতিটি অঞ্চলে যেসকল প্রতিভাবান তরুণ লেখক আলেম সমাজ ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছিলেন অধিকাংশদেরকে প্রত্যক্ষভাবে অথবা পরোক্ষভাবে হাতে কলম তুলে দিয়ে লেখক,অনুবাদক,সম্পাদক বানিয়েছেন আল্লামা মুহিউদ্দীন খান সাবেহ রাহ. ৷ আল্লাহ তাআলা তাঁকে উত্তম বদলা দান করুন ও তাঁর কবরকে জান্নাতের বাগিচা বানিয়ে দিন,আমীন ৷
তাঁর ইন্তেকালের পর এলাকাবাসী তাঁর নামানুসারে “জামেয়া ফয়েজিয়া মাদানীয়া লক্ষীপ্রসাদ মাদরাসা” নামে একটি কওমি মাদরাসা প্রতিষ্ঠা করেন ৷ যা ৮ম শ্রেণি পর্যন্ত অত্যন্ত সুচারুরুরূপে পরিচালিত হচ্ছে ৷
পারিবারিক জীবনে তিনি ছিলেন ৩ সন্তানেক জনক ১.মোছা.রহিমা বেগম ২.মোছা.সুরাইয়া বেগম ( বিবাহিতা ) ৩.হাফেজ আসআদ আল-মাহমুদ ৷

Manual3 Ad Code

রোগ ও ইন্তেকাল : কি সুন্দর মৃত্যু ! খুব কম মানুষের হয় এমন সৌভাগ্যের মৃত্যু ৷ এমন একটি মৃত্যুর কামনায় সহস্ত্র জীবন ও যদি উৎসর্গ করতে হয় তবুও মানব জীবন ধন্য ৷ তার প্রিয় সাগরেদগণ (খাদেমগণ ) তাঁর মৃত্যুর আগমন এবং জীবনের নির্গমন খুব নিকট থেকে প্রত্যক্ষ করেছেন এরপর আমাদের কাছে তা বর্ণনা করেছেন প্রতিটি শব্দকে ফোটা ফোটা অশ্রুতে ভিজিয়ে ৷ তিনি প্রায় সময় অসুস্থ থাকতেন ৷ অসুস্থতার দরুণ ময়মনসিংহের বালিয়ার পীর সাহেব হযরত মাওলানা গিয়াস উদ্দিন সাহেব এর কাছে যান এবং পূর্বেও তাঁর চিকিৎসা পরামর্শে রোগ নিরাময় হয়েছিল ৷ সেখান থেকে ফেরার পথে রোগ বৃদ্ধি পেতে থাকে ৷ তাই সফর সাথীদেরকে সত্বর তাঁর নিজ কর্মস্থল কানাইঘাট দারুল উলুম মাদরাসার কুতুবখানা পৌঁছার বারবার তাগিদ দেন ৷ তিনি নিজেই প্রায় সময় বলতেন- আমার যখন রূপ বৃদ্ধি পায় তখন মাদরাসার কুতুবখানা যাওয়ার পর আমার অন্তরে যে আরাম ও প্রশান্তি হয়,আর কোথায়ও এধরনের শান্তি লাভ হয় না ৷ বালিয়া থেকে শুক্রবার সকাল ৬টায় মাদরাসার কুতুবখানা এসে পৌঁছেন ৷ কতুবখানাতে প্রবেশের কিছুক্ষণ পর সাথীদেরকে কুতুবখানা থেকে বের হয়ে যাওয়ার নির্দেশ দেন ৷ বাহির থেকে শুধু তাঁর সালামের শব্দ শোনা যাচ্ছে ৷ অথচ কুতুবখানায় কোন মানুষ নেই ৷ তিনি কাকে সালাম করেছেন একমাত্র তিনিই জানেন ৷ এঅবস্থায় ১১.৩০ মিনিটের সময় শুক্রবার ২৩ শে জুলাই ১৯৯৯ সালে কানাইঘাট দারুল উলুম মাদরাসার ঐতিহ্যবাহী মুহাম্মদীয়া কুতুবখানায় কিতাবাদীর চর্তুবেষ্টনীর মধ্যখানে অসংখ্য ছাত্র,ভক্ত,গুণগ্রাহী ও আত্মীয়স্বজনকে শোক সাগরে ভাসিয়ে মহান প্রভুর সান্নিধ্যে চলে যান ৷ ইন্নালিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন ৷ মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ৩৯ বছর ৷
ঐদিন বাদ আসর নিজ গ্রামের স্কুল মাঠে হাজার হাজার আলেম ওলামা ও সর্বস্তরের মানুষের অংশগ্রহণে তাঁর নামাজে জানাজা অনুষ্ঠিত হয় ৷ জানাযার ইমামতি করেন তাঁর প্রিয় উস্তাদ,পীরে কামেল আল্লামা মুশাহিদ বায়মপুরী রাহ. এর জামাতা শায়খুল হাদীস মাওলানা মুহাম্মদ বিন ইদ্রীস লক্ষ্মীপুর দা.বা. ৷ জানাযাপর তাঁর নিজ মহল্লার কবরস্থানে তাকে দাফন করা হয় ৷ পরিশেষে মহান আল্লাহ তাআলার দরবারে কায়মনোবাক্যে দোআ করি তিনি যেন তাঁর সারা জীবনের দ্বীনি খেদমতকে কবুল করুন ও মানুষ হিসেবে তাঁর জীবনের ভুলত্রুটিগুলো ক্ষমা করে দিয়ে জান্নাতের সর্বোচ্চ মাকাম দান করুন, আমীন ৷
——————

Manual5 Ad Code

Spread the love

Manual1 Ad Code
Manual2 Ad Code