মাওলানা নসিব আলী কানাইঘাটী রহ. এর জীবনী
May 15 2019, 04:38
শায়খুল হাদীস আল্লামা নসিব আলী কানাইঘাটী রাহ. (১৯৫৯—২০১৮ ঈসায়ী )
হযরত মাওলানা নসিব আলী রাহ. একটি নাম,একটি চলন্ত কুতুব খানা,যে নামের সাথে একটি লাইব্রেরীর ছবি চোখের সামনে ভেসে ওঠে ৷ যখনই কারো মুখে তাঁর নাম শুনি,তখনই বিশাল একটি কুতুবখানার আমেজ উপলব্ধি করি ৷ যে সকল আহলে ইলমরা নিজের জীবনের সবকিছু বিলীন করে দিয়ে শুধুমাত্র দারস তাদরিস ও কিতাব মোতালায় নিজেকে ব্যস্ত রেখেছেন তাঁদের মধ্যে মাওলানা নসিব আলী রাহ.অন্যতম ৷ তিনি ১৯৫৯ সালের ৭ই জুলাই আলেম ওলামা জন্ম দেয়ার উর্বরভুমি সিলেট জেলার কানাইঘাট উপজেলার পৌর এলাকার কান্দেবপুর গ্রামে একধার্মিক পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন ৷ তাঁর পিতার নাম আবদুল আলী ও মাতার নাম আয়েশা বেগম ৷ ভাই-বোন চার জনের মধ্যে তিনি ছিলেন সবার ছোট ৷ শিক্ষা জীবন : মুখে ভাষা ফোটার পর জ্ঞানের সোনার চামচ মুখে দিয়ে বর্ণ পরিচয়ের শুরু হয় গ্রামের সাবাহী মক্তবে ও সাথে সাথে নিজ চাউরা সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে ৩য় শ্রেণী পর্যন্ত লেখাপড়া করেন ৷ কিন্তু তাঁর মমতাময়ী মাতা তাকে ইলমে ওহি শিক্ষা দেওয়ার জন্য সব সময় ছিলেন ব্যাকুল ৷ ঘটনাক্রমে একদিন তাঁর মাজননী হযরত মাওলানা আবদুল লতিফ শায়খে চাউরী রাহ.কে অনুরোধ করে বললেন “হযরত আমার ছেলেকে আপনি মাদরাসায় নিয়ে যান ৷
আপনার মত একজন আলেম বানান”৷ মায়ের কথা মত তিনি তাকে নিয়ে কানাইঘাট দারুল উলুম মাদরাসায় মক্তব ৪র্থ শ্রেণীতে ভর্তি করে দেন ৷ শায়খে চাউরী রাহ.ছিলেন একজন কিতাবের উইপোকা ,যার একমাত্র নেশা ও পেশা ছিল কিতাব মোতালা করা ৷ তাঁর তত্বাবধানে তিনি মক্তব ৪র্থ শ্রেণী থেকে মুখতার জামাত পর্যন্ত অত্যন্ত কৃতিত্বের সাথে লেখাপড়া করেন ৷ এরপর উচ্চ শিক্ষালাভের প্রবল বাসনা নিয়ে শায়খুল হাদিস আল্লামা নূর উদ্দীন গহরপুরী রাহ.এর প্রতিষ্টিত মাদরাসা জামিয়া হোসাইনিয়া গহরপুরে জালালাইন জামাতে ভর্তি হন ৷
সেখানেই তিনি হযরত গহরপুরীর তত্বাবধানে অত্যন্ত সুনাম ও কৃতিত্বের সাথে তাকমিল ফিল হাদিস পর্যন্ত লেখাপড়া করে বোর্ডের অধীনে ফাইনাল পরীক্ষায় স্কলারশীপ নম্বর পেয়ে প্রথমস্থান অধিকার করার গৌরব অর্জন করেন ৷ এমনকি প্রতিটি পরীক্ষাসহ বোর্ডের ক্লাসে ও তিনি প্রথম স্থান অধিকার করে সুনাম ও সুখ্যাতি অর্জন করেন ৷ তিনি যে সকল মহামনীষীর কাছ থেকে ইলমে দীন হাসিল করে ছিলেন তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ক’জন হলেন-শায়খুল হাদিস আল্লামা নূরউদ্দীন গরহপুরী রাহ.,শায়খুল হাদিস মুখলিছুর রহমান কিয়ামপুরী,শায়খুল হাদিস আব্দুল বাসিত বরকতপুরী রাহ.শায়খুল হাদিস গিয়াস উদ্দীন বালিয়া রাহ.শায়খুল হাদিস ফয়জুল বারী শায়খে মহেষপুরী রাহ.,শায়খুল হাদিস মুহাম্মদ বিন ইদ্রিস লক্ষিপুরী,শায়খুল হাদিস আল্লামা আলিমুদ্দীন দুর্লভপুরী প্রমুখ ৷
তাঁর ইলমের পন্ডিত্যের ব্যাপারে বড়দের মন্তব্য :
ক. জামিয়া হোসাইনিয়া গহরপুর মাদরাসা যাঁদেরকে নিয়ে গর্ব করতো;তিনি তাঁদেরই একজন।তেমনি হযরত গহরপুরী রহ. তাঁর মায়ার ও যোগ্য যেসকল ছাত্র নিয়ে নিজেকে গর্বিত মনে করতেন ; হযরত কানাইঘাটি হুজুর রহ. ছিলেন তাঁদের প্রথমসারির একজন। তাঁর ব্যাপারে আল্লামা নুরুদ্দীন গহরপুরি হুজুর রহ. গর্ব করে বলেছিলেন- ‘আমার জামেয়ার কুতুবখানা (গ্রন্থাগার) যদি আগুনে জ্বলেও যায়, আর আমার নসিব আলি থাকে, তাহলে কুতুবখানার সকল কিতাব আছে মনে করবো’।
খ.মাওলানা নসিব আলী রাহ.পরীক্ষায় সকল প্রশ্নেত্তোর আরবিতে লেখতেন ৷ মুখতসর জামাতে বোর্ডের পরীক্ষার আরবি ব্যাকরণের সর্বোচ্চ কিতাব “শরহে জামী” পেপার গাছবাড়ী মুযাহির উলুম কওমি মাদরাসার সুদীর্ঘ ৪৫বৎসরের মুহতামিম, খলিফায়ে আল্লামা বায়মপুরী রাহ.হযরত মাওলানা হাবীবুর রহমান রাহ.দেখে বলেন, আমার জীবনে কত পেপার দেখেছি কিন্তু তাঁর শরহে জামীর পেপার দেখে আমি আর্শ্চয্য হয়েগেছি যে এত সুন্দর আরবি এবারত যা একজন আরবী ভাষাবীদ লেখতে ও হিমশিম খাবে ৷ আমি তাকে ৫০ মার্কের স্থলে ৫২দিয়েছি ৷ এরপর তিনি তাঁর খোঁজখবর নিয়ে পরিচিত হন ৷
গ.তাঁর সহপাঠী গাছবাড়ী এলাকার দলইরকান্দি মাওলানা সিদ্দীকুর রহমান যখন দারুল উলুম দেওবন্দ মাদরাসায় উচ্চ শিক্ষার উদ্দেশ্যে চলেগেলেন ৷ তখন তিনি মাওলানা সিদ্দীকুর রহমান সাহেবের কাছে প্রায় আরবিতে পত্র লিখেন ৷ সেকালে দারুল উলুম দেওবন্দের কৃতি ছাত্র,আরবি সাহিত্যিক মাওলানা তালহা ফতেহপুরী হাফি.যিনি আরবিস্থান থেকে দেওবন্দে কোনো মেহমান সুভাগমন করলে তিনি দেওবন্দের মুল মাকসুদ ইতিহাস ঐতিহ্য তুলে দরতেন ৷এতে আরবের শায়েখ,ডক্তর,সাংবাদিক ও কলামিষ্টগণ তাঁর আরবি সাহিত্যের পান্ডিত্য দেখে আজমি বলে মনে করতেন না ৷ একবার মাওলানা ফতেহপুরী তাঁর আরবি পত্র দেখে বলেন, তিনি কোন আরবি বিশ্ববিদ্যিলয়ের আরবি প্রভাষক,তখন মাওলানা সিদ্দীকুর রহমান বলেন, তিনি কোনো আরবি ইউনিভার্সিটির প্রভাষক নয় বরং তিনি হলেন বাংলার একজন কওমি মাদরাসার ছাত্র ও আমার সহপাঠী ৷ সাথে সাথে মাওলানা ফতেহপুরী বলেন আমি বহু আরবি সাংবাদিক,কলামিষ্ট ও ডক্তরগণের পত্র পড়েছি ও উত্তর দিয়েছি কিন্তু এতো উচ্চ মানের সাহিত্য ও ভাষা জীবনের প্রথম এই দেখলাম ৷ এই হলো তাঁর জ্ঞানের অবস্থা ৷
ঘ. তাঁর মেধা ও স্মৃতি শক্তি ছিলো অতুলনীয় ৷ জীবনে মেধার সঙ্গে মুতালাআর অপরূপ সমন্বয় ছিলো। তিনি কঠোর পরিশ্রমী ও নিবিষ্টমনে একাগ্রতার সঙ্গে প্রচুর মুতালাআহ করতেন। ফলে যেকোনো মাসআলার দলীল-প্রমাণ, আইম্মায়ে মাযাহিবের মতামত, নির্ভরযোগ্য শরাহ-শুরূহাতের রেফারেন্স এবং সংশ্লিষ্ট বিষয়াদি মনে হতো তাঁর ঠোঁটস্থ ছিলো।তেমনি শরহুল হাদীসের ক্ষেত্রেও তাঁর অগাধ পাণ্ডিত্য ছিলো। শারিহীনে হাদীসের আরবী ভাষ্য ও মতামত যেকোনো মজলিসে যেকোনো মুহূর্তে নির্দিধায় বলতে পারতেন।
কর্মজীবন : জ্ঞানের সাগর ইলম ও আমলের এ বীরডুবুরী সতৃষ্ণ এ ভ্রমন কর্মজীবনের শুভ সূচনা করেন শিক্ষকতার মাধ্যমে ৷ তাকমিল ফিল হাদিসের পরীক্ষার পর পরই তাঁর প্রিয় উস্তাদ ও মুর্শিদের নির্দেশে জামিয়া হোসাইনিয়া গহরপুর মাদরাসায় শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন ৷ শিক্ষকতার প্রথম জীবনেই সম্মানীত শিক্ষকগণের সাথে তিনি সিহাহ সিত্তাহসহ দরসে নেজামির গুরুত্বপূর্ণ কিতাবাসমূহ সিংহ সাবকের ন্যায় পাঠ দান করেন ৷
তাঁর পাঠ দানের সুনিপুণ দেখে আল্লামা গহরপুরী রাহ. স্বয়ংতাকে বুখারী শরীফের দরস দিতে নির্দেশ করেন ৷ গহরপুর মাদরাসায় দেড় যুগের বেশি সময় বুখারী শরীফসহ সিহাহ সিত্তাহের কিতার দারস প্রদানে দেশের একজন প্রথম সারির শায়খুল হাদিস হিসেবে সুপরিচিতি ও সুখ্যাতি লাভ করেন ৷ মরহুম নসিব আলী সাহেব তাঁর জীবদ্ধশায় একাধিক মাদরাসায় কালা হাদদাছানা কালা হাদদাছানা বলে শায়খুল হাদীসের আসন অলঙ্কৃত করেছেন ৷
যথাক্রমে- রাজাগঞ্জ মাদরাসা কানাইঘাট,বাহরুল উলুম বালিঙ্গা মাদরাসা বিয়ানী বাজার,হাড়িকান্দী মাদরাসা জকিগঞ্জ,আজিমগঞ্জ মাদরাসা বড়লেখা,কুলিয়াচর মাদরাসা কিশোরগঞ্জ,শ্রীরামপুর মাদরাসা সিলেট,মৃত্যুর পূর্বমূহুর্ত বরুণা মাদরাসায় ৷ সুদীর্ঘ সময় দীনের খেদমত করে তাঁর কাছ থেকে হাজার হাজার ছাত্র জ্ঞান আহরণ করে আজ দেশে-বিদেশে দীনের খেদমতে নিয়োজিত আছেন তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন- হযরত মাওলানা নূরুল ইসলাম আহমদাবাদী,বিশিষ্ট সাহিত্যিক,কলামিষ্ট,গবেষক হযরত মাওলানা শাহ নজরুল ইসলাম,বিশিষ্ট মুফাসসিরে কোরআন যুবের আহমদ আনসারী, হযরত মাওলানা জামিল আহমদ সাহেব সাহেবজাদায়ে আল্লামা বায়মপুরী রাহ., হাফেজ মাওলানা মুসলেহ উদ্দীন রাজু মুহতামিম গহরপুর মাদরাসা প্রমুখ ৷ আকাবিরদের প্রতি হযরতের ভালোবাসা ,পাঠদানের পদ্ধতি ও রচনাবলী : ক.মুহাদ্দিস হযরাতগণ হাদীস পড়ানোর সময় সাধারণত বর্ণনাকারীদের সর্বপ্রথম বর্ণনাকারী কোনো সাহাবীর নাম উচ্চারণের সময় ‘রাজিয়াল্লাহু আনহু’ পড়ে থাকেন।
কিন্তু সাহাবীর পরের বর্ণনাকারী যেমন তাবেয়ী বা তবে তাবেয়ীদের জন্য দোআমুলক কিছু পাঠ করেন না। এটাই সাধারণ নিয়ম। কিন্তু এখানে হুজুরের বৈশিষ্ট ছিল, প্রত্যেক হাদীস পাঠের পর বলতেন ‘রাজিয়াল্লাহু আনহু ওয়া আনহুম’। অর্থাত: বর্ণনাকারী সকলকে তিনি দোআয় শরীক রাখতেন। যদি কোনো ছাত্র এবারত পড়ার সময় ‘ওয়া আনহুম’ বলেনি, এতে হুজুর মারাত্মক রাগান্বিত হয়ে বলতেন “যাদের অক্লান্ত পরিশ্রমে আমরা হাদীস পেলাম তাদেরকে দোয়া না দেয়া অকৃতজ্ঞতার পরিচয়”।
তাই হযরতের দরসে যারাই এবারত পড়তেন খুব সতর্ক হয়ে পড়তেন। এটা ছিল পূর্বসূরীদের প্রতি হুজুরের আন্তরিক মহব্বতের বহি:প্রকাশ।
খ.দরসে নেজামির কঠিন থেকে কঠিনতর কিতাবাদী এমনভাবে দারস প্রদান করেন যে সকল শ্রেণির ছাত্ররা সমানভাবে বুঝতে সক্ষম হতো ৷ যারা তাঁর দরসে বসার সৌভাগ্য হয়েছে তারা অপকটে তা স্বীকার করেন ৷
গ. দারস ও তাদরীস, কিতাব মুতালাআহ এবং নিষ্ঠার সঙ্গে ইলমে হাদীসের খেদমত করাই ছিল তাঁর জীবনের মূল পেশা এবং নেশা। শিক্ষকতা এবং কিতাব মুতালাআহ ছাড়া তাঁর আর কোনো কাজ ছিল না। ছাত্রদের তারবিয়াত,শিক্ষা-দীক্ষার উন্নতি এবং প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার গুণগত মাণ উন্নয়ন ও সুস্থ পরিবেশ সৃষ্টির পেছনে তিনি থাকতেন সদা তৎপর। তিনি সবসময় ছাত্র-শিক্ষক, কিতাব এবং মুতালাআকেই নিজের পরিবার মনে করেন। যারাই তার খেদমতে থাকে, ধনী হোক গরীব হোক, তাদের তৈল-সাবানের টাকা থেকে নিয়ে অধিকাংশ পড়ালেখার খরচ নিজের তানহা থেকে প্রদান করেন। তিনি মনে করতেন আমার এই সামান্য প্রচেষ্টায় একজন ছাত্র আলেম হলে আমার নাজাতের ওসিলা হবে ৷ ঘ. আল্লাহ তাআলার পক্ষ থেকে কলমের সাহায্যে তা’লিমপ্রাপ্ত জাতির সুযোগ্য ইলমে হাদিসের এ মুখলিছ খাদেম দারস ও তাদরিসের পাশাপাশি কয়েকখানা গুরুত্বপূর্ণ কিতাব ও রচনা করেছেন ৷ তাঁর প্রকাশিত রচিত গ্রন্থের মধ্যে রয়েছে “ইফাদাতুল আহাদিসিয়া” যা ইলমে হাদিসের ওপর এক দুর্লভ কিতাব ৷
এ ছাড়া তিনি আরো মূল্যবান তিন চারটি গ্রন্থ রচনা করেছেন,কোনো এক সুহৃয়বান ব্যাক্তি তা প্রকাশ করার জন্য তাঁর কাছ থেকে নিয়ে ছিলেন কিন্তু দুর্ভাগ্য সে ব্যাক্তি আর তা প্রকাশ করেননি তিনিও তার খোঁজখবর নেননি ৷ * তিনি ছাত্রদের উদ্দেশ্যে প্রায় সময় বলতেন দুনিয়ার মোহে পড়ে তোমরা নিজের ইলম ও আমলকে বরবাদ করে দিও না ৷ * আমাদের আকাবিরদের যিন্দেগীতেই আমাদের সমস্যার সমাধান নিহিত ৷ তাই আমাদের আকাবিরদের জীবনী বেশি করে মোতালাআ করা একান্ত জরুরী ৷ দুনিয়া বিমুখ গুমনাম এক আল্লাহর ওলি : যুগে যুগে এমন কিছু আল্লাহর নেক বান্দারা অতিবাহিত হয়েছেন, যারা ইলম ও আমলকে সবকিছুর উপর প্রাধান্য দিয়েছেন। তাদের কেউ কেউ ছিলেন, চিরকুমার। এমন কিছু ওলামায়ে কেরামকে নিয়ে শায়েখ আবদুল ফাত্তাহ আবু গুদ্দা রাহিমাহুল্লাহ কিতাবও রচনা করেছে। নাম দিয়েছেন- আলউলামুল উযযাব আল্লাযিনা কাদ আছারুল ইলমা আলায যাওয়াজ’। আজবধি এধারা অব্যাহত আছে। সেসব মনিষীরা আমাদের মাঝে আজ ও আছেন।
বছর এক আগে আমাদের থেকে বিদায় নেন, ভারতের শায়খুশ শুয়ুখ আমিরুল মুমিনিনা ফিল হাদিস, শায়খ ইউনুস রাহিমাহুল্লাহ। যাকে মাওলানা যাকারিয়া কান্দলবি রহ. সম্বোধন করে বলেছিলেন- তুমি কি বুখারি পড়াতে চাও নাকি আমার মেয়েকে বিবাহ করতে চাও? দু’টোর একটি তোমাকে চয়ন করতে হবে। তিনি বুখারি অধ্যয়নকেই চয়ন করেছিলেন। তারপর আর কখনো বিয়ে করেন নি। আমাদের চোখের সামনে, বর্তমানেও দারুল দেওবন্দ’র প্রতিটা ইটপাথর যার কাছে ঋণী; তিনি হলেন, আরেক চিরকুমার আলেম, দেওবন্দের ভাইস প্রিন্সিপাল মাও. আব্দুল খালিক মাদরাসি হাফিজাহুল্লাহ।এধারায় মাওলানা নসিব আলি রাহ. ছিলেন এক চিরকুমার চলন্ত কুতবখানা ৷ তিনি প্রাতিষ্টানিক লেখাপড়া সমাপ্ত করার পর তার স্নেহময়ী মাতা তাকে বিবাহের জন্য অনেক পিড়াপিড়ি করলে তিনি বলেন, বর্তমানে মেয়েদের মাঝে দীন ও পর্দাপুশিদা নেই বলে চলে আমি কোনো মেয়েকে বিবাহ করবো ! এরপর ও সুন্নাতে নববী ও আপনাদের নির্দেশে বিবাহে রাজি আছি ৷ কিন্তু বিবাহের ৩দিনের মাথায় বেখালে স্ত্রীরির সামান্য হাতের পর্দা খোলা দেখে মাকে বলেন আমি বার বার বলেছি বিবাহ করবো না ৷ যে মেয়ের পর্দার প্রতি খেয়াল নেই সে মেয়েকে আমি আর রাখতে চাইনা ৷ তাই তিনি তালাক দিয়ে সারাটি জীবন চির কুমারিত্ব গ্রহণ করে দীনের খেদমত করে চলেগেছেন ৷ তিনি ছিলেন দুনিয়া বিমুখ গুমনাম এক আল্লাহর ওলি ৷ বাড়ি ঘর সবকিছু আত্মীয় স্বজনকে দান করে দিয়ে নিজে মাথা গোছানোর জন্য ও একটি ঘর তৈরি করেননি ৷ তাঁর জীবনটি ছিলো একবিতা বাস্তব নমুনা “ওয়াতন ছে হাম করেঙ্গে কিয়া মাদ্রাসা হো ওয়াতন আপনা – মরেঙ্গে হাম কিতাবো পর ওয়ারক্ব হোগা কাপন আপনা”। ঘর বাড়ি দিয়ে আমি কি করবো,মাদরাসা হবে আমার ঘর,মৃত্যুবরণ করবো কিতাবের ওপর কাপন হবে কিতাবের পাতা ৷ বায়আত ও খেলাফত লাভ : তিনি ছিলেন সুন্নাতে নববীর একমূর্তপ্রতীক ৷ যেভাবে সুন্নাতের ওপর আলম করতেন তেমনি ভাবে মুস্তাহাবের ও প্রতি ছিলেন খুবই যত্নশীল।যে নামাযে বড় আওয়াজে ক্বেরাত পড়া হয় সেসব নামাজে ইমাম সাহেব যদি মাসনুন ক্বেরাত দিয়ে নামাজ না পড়ান তাহলে তিনি খুব মনোক্ষুন্ন হতেন।যেভাবে ইলমে জাহিরী শায়খুল হাদীস আল্লামা নূর উদ্দীন গহরপুরী রাহ. র কাছ থেকে হাসিল করেছিলেন,তেমনিভাবে ইলমে বাতিনী তথা আত্মশুদ্ধির জন্য হযরত গহরপুরীর হাতে বায়আত গ্রহণ করলে আল্লামা গহরপুরী তাঁর মাঝে ইলমে মারিফতে ও ভরপুর দেখে অতি অল্প দিনে তাকে খেলাফত ও ইজাজত প্রদান করেন ৷
প্রচার বিমুখ এ আল্লাহর ওলি সবসময় নিজেকে গোপন রাখতেন ৷ তাই তাঁর কাছে আত্মশুদ্ধির জন্য অনেক লোক বায়আত গ্রহণ করার আগ্রহ প্রকাশ করলে তিন মোটেই রাজি হতেননা, বরং অন্যের কাছে বাআতের কথা বলতেন ৷ এরপর ও অনেক পিড়াপিড়ি পর একেবারে হাতেগুনা কয়েকজনকে বায়আত গ্রহণ করেন ৷ আমাদের জানামতে একমাত্র মাওলানা শাহ নেওয়াজ সাহেবকে ইজাজত প্রদান করেছেন ৷ ইন্তেকাল : মানুষ মরণশীল তাই সবাই একদিন না একদিন মৃত্যুর স্বাদ আস্বাদন গ্রহণ করতে হবে ৷ কিছু কিছু মানুষ চলে যাওয়ার পর আলেম সমাজ ও ইলমি পরিমন্ডলে যে ক্ষতি হয় তা সহজে পূর্ণ হওয়ার মত নয় ৷ হযরত কানাইঘাটী রাহ.প্রায় বছর দু,এক ধরে বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হয়ে পড়লেও চলছে বুখারী শরীফের দারস নির্ধারিতভাবে ৷ তাঁর দারস তাদরিসে কোনো প্রকার ব্যাঘাত ঘটনি ! বিগত ২৮ জানুয়ারী শারীরিক অবস্থা অবনতি দেখা দিলেও বুখারী শরীফের দারস শেষ করে চলে যান ডাক্তারের কাছে ৷ কে জানে এ দারস ছিলো তাঁর জীবনের শেষ দারস ও মহান প্রভুর সান্নিধ্যে চলে যাওয়ার প্রারম্ভিকতা ৷
ডাক্তারের পরামর্শে তাকে ভর্তি করা হয় সিলেট ইবনে সীনা হাসপাতালে ৷ দিন দিন তাঁর শরীরের অবস্থা অবনতি দেখা দিলে সাপ্তাহ খানেক সেখানে থাকার পর ডাক্তদের নির্দেশে সিলেট উসমানী হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার পর সেখানে সাড়ে ৩ঘন্টা অতিবাহিত হয়ার পর ৬ই জানুয়ারী রাত ১.৩০ মিনিটে তাঁর অসংখ্য শিষ্য-শাগরিদ,ভক্ত-অনুরক্ত ও আত্মীয় -স্বজনকে শোকসাগরে ভাসিয়ে আল্লাহ তাআলার সান্নিধ্যে চলে গেছেন ৷ ইন্নালিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন ৷ পরদিন বাদ আসর তাঁর দীনি শিক্ষা জীবনের প্রথম সোপান কানাইঘাট দারুল উলুম মাদরাসা মাঠে হাজার হাজার আলেম উলামা ও জনসাধারনের অংশগ্রহণে নামাযে জানাযা অনুষ্টিত হয় ৷ জানাযার নামায পড়ান তাঁরই উস্তাদ কানাইঘাট মাদরাসার শায়খুল হাদীস ও মুহতামিম আল্লামা মুহাম্মদ বিন ইদ্রিস লক্ষিপুরী হাফিজাহুল্লাহ ৷ পরে তাঁর নিজ গ্রাম কান্দেবপুর মসজিদের গোরস্থানে তাকে সমাহিত করা হয় ৷ আল্লাহ তাআলা তাঁর দীনি খেদমতগুলো কবুল করুন এবং মানুষ হিসেবে তাঁর জীবনের ভুল-ত্রুটিগুলো ক্ষমা করে দিয়ে জান্নাতের উচ্চ মাকাম নসীব করুন ,আমিন ৷
মাওলানা মুতাসিম বিল্লাহ সাদী