মাওলানা খলিলুর রহমান (রহ:)
May 06 2019, 05:00
লিখেছেন- নোমান মাহফুজ:
“প্রত্যেক প্রাণীকেই মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণ করতে হবে”। সিলেটের শাহপরান থানার দীপ্ত প্রদীপ মাওলানা খলিলুর রহমান হাজী সাব হুজুর (রহ:)। মহান রবের এ অমোঘ নিয়মেই তিনি আমাদের ছেড়ে পরপারে চলে গেছেন ১৮ ই জমাদিউস সানী ১৪৪০ হিজরী সনে।
জন্ম: মাওলানা খলিলুর রহমান হাজী সাব হুজুর (রহ:) বাংলাদেশের আত্মাধীক রাজধানী সিলেট, এই সিলেটের ঐতিহ্যবাহী শাহপরান থানার কল্লগ্রামে এক সম্ভ্রান্ত দ্বীনদার পরিবাওে ৩ মার্চ ১৯৫৭ ইংরেজী সনে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতার নাম আলহাজ¦ তাহির মিয়া উরফে বুলাই মিয়া রহঃ তিনি খাদিমপাড়া ইউনিয়নের তাবলীগের অন্যতম মুরব্বী ছিলেন। ( মৃত্যু ২০০৩ ঈসায়ী)
শিক্ষাজীবন: স্থানীয় কল্লগ্রাম সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ৫ম শ্রেণী পর্যন্ত কৃতিত্বের সাথে লেখাপড়া করেন। এরপর দক্ষিণকাছ হুসাইনিয়া ইসলামিয়া মাদরাসায় মক্তব দুওমে (২য় শ্রেণী) ভর্তি হন। সেখানে অল্প কয়েক বছর অধ্যয়নের পর ১৯৭৪ ইং সালে ইলমে দ্বীনের বিপুল পিপাসায় জামেয়া ক্বাসিমুল উলুম দরগা মাদরাসায় মুতাওয়াসসিতাহ ২য় বর্ষে ( ৭ম শ্রেণী) ভর্তি হন। তখন উক্ত মাদরাসায় শিক্ষাদানে নিয়োজিত ছিলেন দেশের কয়েকজন খ্যাতনামা ও পারদর্শী আলেম। আসাতিযায়ে কেরামের সার্বক্ষণিক তত্ত্বাবধান ও স্নেহের সুশীতল ছায়াতলে থেকে দরগা মাদরাসা থেকেই ১৪০২ হিজরী মোতাবেক ১৯৮২ ইংরেজীতে দাওরায়ে হাদীস সমাপ্ত করেন। দরগাহ মাদরাসায় আসাতিজায়ে কেরামের মধ্যে উল্লেখযোগ্য, আরিফবিল্লাহ মাওলানা আকবর আলী (ইমাম-সাব হুজুর) রহ., আল্লামা আব্দুল হান্নান (মুহাদ্দীস সাব হুজুর) রহ., শায়খুল হাদীস আল্লামা হুসাইন আহমদ বারকোটি রহ., আল্লামা আব্দুল জলিল নয়াসড়কী রহ., শায়খুল হাদিস আল্লামা কুতবুদ্দিন রহ., মুফতি রহমতুল্লাহ রহ., মুফতি আবুল কালাম জাকারিয়া রহ. আল্লামা নজীর হুসাইন প্রথমপাশী, মুফতি মুহিব্বুল হক গাছবাড়ি (মা. আ.) ছিলেন তাদের অন্যতম।
কর্মজীবন: মাওলানা খলিলুর রহমান হাজী সাব হুজুর রহঃ এর কর্মজীবন শুরু হয় ১৯৮২ সালে প্রিয় প্রতিষ্টান জামেয়া দরগায় শিক্ষকতার মাধ্যমে। সেখানে তিনি শিক্ষকতা করেন দুই মেয়াদে। দরগা মাদরাসায় শিক্ষকতাকালীন ১৯৯০ সালের মাঝামাঝিতে শ্রদ্ধেয় পিতার নির্দেশে পাড়ি জমান বাহরাইনে। ১৯৯৭ সাল পর্যন্ত অবস্থান করেন। সেখানে তিনি ইমাম, খতিব ও একজন সুদক্ষ লাইব্রেরীয়ান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৯৭ সালে দেশে ফিরে পুনরায় দরগা মাদরাসায় শিক্ষক নিযুক্ত হন। সেখানে তিনি আরবী ভাষাবিজ্ঞান হাদীস ফেক্বাহ তাফসিরের অধ্যাপনা করেন শেষ নিঃশ^াস পর্যন্ত। কর্মজীবনের শুরু থেকেই দেশে থাকাকালীন জীবনের শেষ সময় পর্যন্ত তিনি শাহপরান রহ. মাজার মসজিদের খতিব হিসেবে নিয়োজিত ছিলেন। ২০০৬ সালে প্রতিষ্টা করেন মাদরাসাহ খায়রুল উলূম শাহপরান, সিলেট। শ্রম মেধা ঘাম ঝরিয়ে গড়ে তুলা এ প্রতিষ্টানের মুহতামিমের দায়িত্ব নিষ্টার সাথে আঞ্জাম দেন আমরণ। এছাড়াও একাধিক মাদরাসা প্রতিষ্ঠা ও পরিচালনায় তার ভুমিকা ছিলো অবিস্মরনীয়।
অধ্যাপনা জীবনের কৃতিত্ব ও অবদান: অধ্যাপনা জীবনে বহু ইলম পিপাসু তার জ্ঞান সাগর থেকে অমীয় সুধা পান করে নিবৃত্ত করেছেন তাদের জ্ঞান তৃষ্ণা। তার ইলমী সরোবরে অবগাহন করে সিক্ত করেছেন নিজেদের হৃদয় মনকে। তার কাছ থেকে দীক্ষা গ্রহণকারী অনেকেই আজ দ্বীন ও মিল্লাতের উল্লেখযোগ্য খিদমাতে নিয়োজিত আছেন। নিম্নে তার কয়েকজন শাগরীদের নাম উল্লেখ করা গেল:- * মুফতি আবুল খায়ের বিথঙ্গলী।* মাওলানা মুঈনুল ইসলাম, শায়খুল হাদীস-ঢাকাদক্ষিন হুসাইনিয়া মাদরাসা * মাওলানা আছাদ উদ্দিন রানাপিঙ্গী, সহকারী মুহতামিম-দরগা মাদরাসা। * মাওলানা জয়নুল আবেদীন, মুহাদ্দীস- জামেয়া দারুল আরকাম বি-বাড়িয়া। * মাওলানা আনোয়ার হুসাইন, মুহতামিম তেঘরিয়া মাদরাসা সুনামগঞ্জসহ প্রমুখ উলামায়ে কেরাম।
চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য: তিনি ছিলেন সুন্নতে নববীর সঠিক উত্তরসুরী। তাক্বওয়া ও পরহেজগারী ছিল তার জীবনের অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট। তার তাক্বওয়া ও খোদাভীরুতা এবং বিচক্ষণতা ছিল সর্বজনস্বীকৃত। সহজ সরল জীবন যাপন ছিল তার জীবনের অন্যতম ভূষণ। দ্বীনী দাওয়াতের ক্ষেত্রে ইখলাস ও হিকমাহ ছিলো অনন্যগুণ। সব ঘরনার মানুষের সাথে তার সখ্যতা ও গ্রহণযোগ্যতা ছিলো ব্যাপক। নিয়মিত তাহাজ্জুদগোজার ছিলেন। শেষ রাতের রুনাজারী ও পুরো রমজান মাসের শেষ রাতের আমল ছিলো ঈর্ষনীয়। আর এটাই ছিল তার জীবনের বাস্তবচিত্র। রাজনীতির ময়দানে কোন সম্পৃক্ততা ছিলো না। তবে সব দলের নেতাকর্মীদের সাথেই ছিলো আন্তরিকতা। ছোট ছোট বাচ্ছাদের নিয়ে আনন্দঘন মূহুর্ত কাটানো তার স্বাভাবিক অভ্যাস ছিলো।
ইসলাহী মিশন: আধ্যাতিকতার জগতে তিনি ছিলেন আরিফ বিল্লাহ আকবর আলী রহ, এর খলিফা। থানবী ও মাদানী সিলসিলার বুজুর্গদের সাথে তার আত্মার বন্ধন। ইমাম সাব রহ. এর তার প্রতি নির্দেশ ছিলো বুজুর্গানে দ্বীনের কিতাবাদী সাধারণ মানুষকে নিয়ে তা’লীম করার, এর বাস্তবায়ন স্বরুপ তিনি একটি আত্মশুদ্ধিমূলক কর্মসূচী হাতে নেন এবং এ ধারারই ইসলাহী দরস হতো মাদরাসা খায়রুল উলূমে প্রতি ৪০ দিন পরপর। এবং নগরীর চৌহাট্টা ফিরোজ সেন্টার মসজিদে “দরসে আকবরী” হতো প্রতিমাসের প্রথম শনিবার। এছাড়াও বুজুর্গদের মাধ্যমে বিভিন্ন সময়ে মাদরাসাহ খায়রুল উলুম ও একাধিক জায়গায় ইসলাহী মজলিস হতো। মহিলাদের ইসলাহী দিক বিবেচনা করে তাদের জন্য বিশেষ মজলিস করতেন বিভিন্ন স্থানে। দ্বীন প্রচারের নিমিত্তে ওয়াজ মাহফিলে বয়ান পেশ করতেন। তার হৃদয়গ্রাহী বয়ান ও তেলাওয়াতে মুগ্ধ ছিলো উম্মাহ। প্রচলিত পদ্ধতির দাওয়াতে তাবলীগের কাজেও সচেষ্ট ছিলেন ।
সন্তানসন্ততি: মৃত্যুকালে তিনি রেখে যান স্ত্রী, ৪ ছেলে, ১ মেয়ে ও ৪ নাতিসহ অসংখ্য আত্মীয়স্বজন, শাগরীদ ও গুণগ্রাহী। ছেলেরা হলেন: *হাফিয মাওলানা হিববান খলিল * হুবাইবাহ খানম ( স্বামী: মুফতি আসআদ খান-ঝেরঝেরী পাড়া)* মাওলানা রুম্মান খলিল, বর্তমান মুহতামিম মাদরাসাহ খায়রুল উলূম খাদিমনগর, শাহপরান* হাফিজ আফফান খলিল * সোলওয়ান খলিল ।
মৃত্যু: ইলমে দ্বীনের এ মহান পুরুষ ১৮ ই জমাদিউস সানী ১৪৪০ হিজরী সনে স্বীয় মাওলার সাথে মিলিত হন। তার নামাজে জানাযার ইমামতি করেন স্বীয় উস্তাদ দরগা মাদরাসার মুহতামিম মুফতি আবুল কালাম জাকারিয়া রহ. সুনামগঞ্জী। কল্লগ্রামে পারিবারিক কবরস্থানে মা বাবার পাশেই তাকে সমাহিত করা হয়।