খলীফায়ে মাদানী মাওলানা আব্দুল গফফার শাইখে মামরখানী রহ.
November 11 2019, 04:08
জন্ম ও বাল্যকাল:
১৯০৮ মতান্তরে ১৯১৪ খ্রিস্টাব্দ, মোতাবেক ১৩১৫ বা ১৩২১ বাংলা সনের কোন এক শুভক্ষণে সিলেটের জকিগঞ্জ উপজেলার নিভৃত পল্লী এলাকা মুন্সীবাজারের মামরখানী গ্রামে এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে তিনি জন্মগ্রহণ করেন।তাঁর পিতা মরহুম ক্বারী আব্দুল মজিদ ও মাতা রহিমা খাতুন ছিলেন অত্যন্ত ধর্মভীরু ও পরহেজগার। বাল্যকালে তিনি অত্যন্ত নম্র, ভদ্র ও খোশ মেজাজী ছিলেন। মাতা পিতার অনুগত ও লেখাপড়ায় মনযোগ ছিল অত্যাধিক।১৯১৬ সালে আট বছর বয়সে তাঁর পিতা বাড়ির পাশে নিজের প্রতিষ্ঠিত মক্তবে তাঁকে ভর্তি করান। মাত্র তিন বছরের মধ্যে তিনি ইসলামের বুনিয়াদী শিক্ষায় সমৃদ্ধ হন। ১৯১৯ সালে ১১ বছর বয়সে তাঁকে মুন্সীবাজার সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ে তৃতীয় শ্রেণীতে ভর্তি করা হয়। এরপর তিনি ৫ম শ্রেণী পর্যন্ত ১ম স্থান অধিকার করে প্রাথমিক শিক্ষা সমাপ্ত করেন।
পিতার ইন্তেকাল ও দ্বীনি শিক্ষার সূচনা:
১৯২০ সালে তাঁর জীবনে নেমে আসে পিতৃ হারানোর বেদনা বিদুর অধ্যায়। কিন্তু বড় ভাই ক্বারী আব্দুস সামাদ সাহেবের স্নেহমমতায় ও মা জননীর আদরের ফলে তিনি পিতৃশোক সাময়িকভাবে ভুলে যান।ছোট ভাইয়ের লেখাপড়ায় যাতে ক্ষতি না হয় সে দিকে অবশ্যই তাঁর বড় ভাইয়ের সযত্ন চেষ্টা ছিল। মায়ের পরম আগ্রহে তাঁর বড় ভাই তাঁকে মুন্সীবাজার মাদ্রাসায় ভর্তি করে দেন।এখানে মাত্র চার বছরের অধ্যয়নে তিনি আরবী,বাংলা,উর্দু ও ফার্সি ভাষার উপর বিশেষ পান্ডিত্য অর্জন করেন।
উচ্চ শিক্ষার উদ্দ্যেশ্যে সফর:
ইসলামী শিক্ষায় ব্যাপক বুৎপত্তি অর্জনের উদ্দ্যেশ্যে ১৯২৬ সালে তিনি ভারতের আসাম প্রদেশের হাইলাকান্দি মাদ্রাসায় ভর্তি হন। ১৯২৭ সালে সিলেটের প্রাচীনতম শিক্ষাগার জামিউল উলূম গাছবাড়ী মাদ্রাসায় চলে আসেন এবং দীর্ঘ আট বছরের ব্যবধানে এখানে তিনি নাহু,সরফ,বালাগাত,মানতিক,আকাঈদ, ফিকহ,তাফসীর,উসূলে ফিকহ,হাদীস ও উসূলে হাদীসের উপর বিশেষ দক্ষতা অর্জন করেন।
গাছবাড়ীতে অধ্যয়নরত অবস্থায় তিনি মাদ্রাসা ছাত্র সংসদের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন।১৯৩৫ সালে উচ্চতর শিক্ষা অর্জনের উদ্দেশ্যে তিনি বিশ্বের অন্যতম শ্রেষ্ঠ বিদ্যাপীঠ দারুল উলুম দেওবন্দে ভর্তি হন।সেখানে তিনি দাওরায়ে হাদীস পাশসহ হাদীস,তাফসির,ও ফিকাহর উপর গবেষণা করেন। দেওবন্দে যাদের সাহচর্য লাভে ধন্য হয়েছিলেন,তাঁদের মধ্যে কুতবে আলম হজরত মাওলানা সায়্যিদ হুসাইন আহমদ মাদানী রহ. হজরত মাওলানা সায়্যিদ আসগর হুসাইন দেওবন্দী রহ. শাইখুল আদব হজরত মাওলানা এজায আলী রহ. এবং হজরত মাওলানা মুফতী মুহাম্মদ শফী রহ. সহ তৎকালীন জগদ্বিখ্যাত মনিষীদের কথা উল্লেখযোগ্য।
শিক্ষকতা ও আধ্যাত্মিক সাধনা:
১৯৩৮ সালে তিনি দারুল উলুম দেওবন্দে উচ্চতর ডিগ্রি লাভ করে উপমহাদেশের অন্যতম শিক্ষাগুরু আল্লামা সায়্যিদ হুসাইন আহমদ মাদানী (রহঃ) এর হাতে তাসাউফের বাইয়াত গ্রহণ করে দেশে প্রত্যাবর্তন করেন।মুর্শিদের নির্দেশে তিনি দ্বীনি শিক্ষার প্রচার,আধ্যাত্মিক সাধনা ও দ্বীন প্রতিষ্টার সংগ্রামে আত্মনিয়োগ করেন।সিলেট বিভাগের প্রাচীনতম ইসলামী বিদ্যাপীঠ ঢাকা উত্তর রানাপিং আরাবিয়া হুসাইনিয়া টাইটেল মাদ্রাসায় শিক্ষকতার মাধ্যমে তাঁর কর্ম জীবনের শুরু। এখানে প্রায় দুই বছর শিক্ষকতার পর স্বীয় মুর্শিদ আল্লামা সায়্যিদ হুসাইন আহমদ মাদানী (রহঃ) এর নির্দেশে ১৯৪১ সালে ভারতের আসাম প্রদেশের ভাংগা ইসলামিয়া মাদ্রাসায় শিক্ষকতা করেন। তারপর তিনি ১৯৪৩ খ্রিস্টাব্দে ভারতের হাইলাকান্দি টাইটেল মাদ্রাসায় শিক্ষা পরিচালক হিসেবে যোগদান করেন। ১৯৪৭ সালের পাক-ভারত বিভক্তির সময় তিনি চলে আসেন নিজ মাতৃভূমি বাংলাদেশের জকিগঞ্জে। স্থানীয় গঙ্গাজল হাসানিয়া সিনিয়র মাদ্রাসায় সুদীর্ঘ নয় বছরকাল শিক্ষকতার পাশাপাশি শিক্ষা পরিচালকের ও দায়িত্ব পালন করেন।
এদিকে জকিগঞ্জের মুন্সীবাজার মাদ্রাসায় দীর্ঘদিন যাবৎ একজন যোগ্য পরিচালকের অভাবে অচলাবস্থা সৃষ্টি হলে স্থানীয় জনতার অনুরোধে ১৯৫৭ সালে তিনি সে মাদ্রাসার মুহতামিমের দায়িত্বভার গ্রহন করেন এবং মৃত্যু অবধি এ পদে অধিষ্ঠিত থেকে মাদ্রাসাকে বিন্দু থেকে সিন্ধুতে পরিণত করেন। আজকের সুবিশাল জামেয়া ইসলামীয়া ফয়জে আম মুন্সীবাজার তাঁরই কঠোর সাধনার ফসল।কিন্তু এতসব দায়িত্ব ও কর্ম তাঁকে তাঁর সৃষ্টিকর্তাকে এক মুহূর্তের জন্য ভুলতে দেয়নি। সিলেটের নয়াসড়ক মসজিদে শাইখুল ইসলাম আল্লামা হুসাইন আহমদ মাদানী রহ. এর সাথে আধ্যাত্মিক সাধনায় সুদীর্ঘ ১৩ বছরকাল পুরো রমজান মাস অতিবাহিত করেন। এভাবে তিনি আধ্যাত্মিক জ্ঞানে সমৃদ্ধ হয়ে স্বীয় মুর্শিদের অনুমতি প্রাপ্ত হয়ে মানুষকে আধ্যাত্মিক দীক্ষা ও আম জনতার মাঝে দ্বীনের দাওয়াত চালাতে থাকেন। বিভিন্ন এলাকায় ওয়াজ- নসিহত,মানুষের প্রাত্যহিক সমস্যার শরয়ী ব্যাখ্যা প্রদান ও মানুষকে হেদায়েতের পথে আহবান জানানোর মধ্য দিয়ে তিনি গোটা জীবন অতিবাহিত করেন।সিলেট বিভাগের সব উপজেলাতেই তিনি সফর করেছেন এবং বিভিন্ন স্থানে লোকজনকে বাইয়াত করানোর মাধ্যমে হেদায়েতের পথ প্রদর্শন করেছেন।
খানকাহ প্রতিষ্ঠা:
উম্মতের হেদায়াত,মুরিদানের আত্মিক প্রশিক্ষণ ও দিক নির্দেশনার জন্য সুদীর্ঘ আঠারো বছর খানকাহ পরিচালনা করেন।এর পূর্বে প্রায় বার বছর জকিগঞ্জের বালাউট মসজিদে মুরিদান সহ রমজানের শেষ দশ দিন এতেকাফ করতেন।এ সব প্রচেষ্টার ফলে সিলেটের প্রত্যন্ত অঞ্চলে শতশত আলেম ও হাজার হাজার মানুষ আত্মিক উৎকর্ষতা সাধনের সুযোগ পেয়েছেন। আজও মুনশী বাজারের খানকায়ে মাদানিয়া সিলেটের ধর্মপ্রাণ মানুষের আকর্ষণের কেন্দ্র হয়ে আছে।
খলিফাবৃন্দ
হজরত শাইখের সংস্পর্শে আত্ম সাধনায় যারা নিজেদের জীবনকে করেছেন ধন্য,হয়েছেন উম্মতের রাহবার, তাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকজন হলেন:
১/ হজরত মাওলানা উবায়দুল হক রহ. ,সাবেক এমপি
২/ হজরত মাওলানা জমসেদ আলী লালারচকী রহ.
৩/ হজরত মাওলানা সিকন্দর আলী,টিকরপাড়া, গোলাপগঞ্জ
৪/ হজরত মাওলানা আনোয়ার সাহেব রহ.,টিকরপাড়া
৫/ হজরত মাওলানা ফজলে হক ঝিংগাবাড়ী
৬/ বিশিষ্ট শিল্পপতি হাসান চৌধুরী,সিলেট
৭/ হজরত মাওলানা আব্দুল লতিফ সাহেব,দারুল উলুম কানাইঘাট।
সমাজ সংস্কার ও রাজনৈতিক অঙ্গনে ভূমিকা পালন:
হজরত শাইখে মামরখানী রহ. সামাজিক অবক্ষয় রোধ,কুসংস্কার দূরীকরণ এবং মানুষকে আল্লাহর প্রতি আহবান জানানোর জন্যে সিলেটের সর্বত্রই ওয়াজ মাহফিল,সভা-সেমিনার ও সমাবেশে আজীবন জাতিকে দিকনির্দেশনা দিয়ে গেছেন। দেশ ও জাতীর ভাগ্যন্নোয়ন ও আর্থসামাজিক উন্নয়নে সেই ছাত্র জীনন থেকেই তিনি রাজনীতির সাথে জড়িত ছিলেন। দারুল উলুম দেওবন্দে পড়াশোনা অবস্থায় তিনি তৎকালীন সময়ে আসাম প্রাদেশিক ছাত্র সংগঠনের জেনারেল সেক্রেটারির দায়িত্ব পালন করেন। ব্রিটিশ খেদাও আন্দোলনে তিনি হজরত মাদানী রহ. এর সাথে ভারতের বিভিন্ন অঞ্চল সফর করেন। সেসময় তিনি জমিয়তে উলামায়ে হিন্দের একজন ডাকসাইটে নেতা ছিলেন। ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান প্রতিষ্টার পর তিনি হজরত শিব্বির আহমদ উসমানী রহ. মুফতি মাহমুদ রহ. প্রমুখের নেতৃত্বে জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম সিলেট জেলায় সংগঠকের দায়িত্ব পালন করেন। এ সময় তিনি আইয়ুব শাহীর বিরুদ্ধে তীব্র আন্দোলনে ঝাপিয়ে পড়েন।
বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পর হজরত হাফেজ্জী হুজুর রহ. তাওবার রাজনীতির ডাক দিলে তিনি তাঁর নেতৃত্বে গঠিত খেলাফত আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন।১৯৮৪ সাল থেকে ১৯৮৯ সাল পর্যন্ত খেলাফত আন্দোলনের ব্যানারে তৎকালীন সামরিক জান্তার বিরুদ্ধে সোচ্চার ভূমিকা পালন করেন। ১৯৮৯ সালে শাইখুল হাদীস আল্লামা আজিজুল হক রহ.’র নেতৃত্বে ওলামা মাশায়েখ ও দ্বীনদার বুদ্ধিজীবীদের সমন্বয়ে বাংলাদেশ খেলাফত মজলিস গঠিত হলে তিনি তাতে সক্রিয় অংশগ্রহণ করেন এবং প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকেই এ সংগঠনের কেন্দ্রীয় অবিভাবক পরিষদ সদস্য ও সিলেট জেলা সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন। ইন্তেকাল পর্যন্ত তিনি এ পদেই অধিষ্ঠিত ছিলেন। তাঁর রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি ছিল শুধু আলেম কিংবা শুধু আধুনিক শিক্ষিতদের আন্দোলন নয়,বরং উভয় ধারার সমন্বিত আন্দোলনের মাধ্যমে খিলাফাহ আলা মিনহাজিন নবুওয়াহর আদলে ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে সবাইকে ঝাপিয়ে পড়তে হবে।
আন্যায়-অসত্যের বিরুদ্ধে সংগ্রাম:
জাতীয়,আন্তর্জাতিক ও স্থানীয়ভাবে সংগঠিত সকল অন্যায়ের বিরুদ্ধে হজরত শায়েখ সব সময় সোচ্চার ছিলেন। কুখ্যাত দাউদ হায়দারের অপলাপ,১৯৭৯ সালে সরদার আলাউদ্দিন কর্তৃক আল কুরআনের বিরুদ্ধে কটুক্তি,১৯৯২-৯৩ সালে বাবরি মসজিদ আন্দোলন, আগ্রাসী ভারত কতৃক সুরমা-কুশিয়ারার উজানে বরাক ড্যাম নির্মাণ বিরোধী আন্দোলন ও ১৯৯৪ সালে তসলিমা নাসরিন বিরোধী আন্দোলনে আশীতিপর বয়োবৃদ্ধ শায়েখের অগ্রণী ভূমিকা সাধারণ জনতা ও ছাত্র-যুবা তারুন্যের মনে নবচেতনার সৃষ্টি করে।
একবার গঙ্গাজল ঘেছুয়া এলাকায় গান ও নাচের আসর বসার সংবাদ পেলে তা বন্ধ করতে মাওলানা ফয়জুল হাসান রহ. ও শায়েখ সাথে সাথে রওয়ানা হয়ে যান।পথিমধ্যে প্রতিপক্ষের আক্রমণে মাওলানা ফয়জুল হাসান রহ. এর হাত ভেঙ্গে গেলেও তিনি পিছপা হননি। গানের আসর ভেঙ্গেই ঘরে ফিরেছিলেন। অন্যায়-অসত্য আর ইসলাম বিরোধী ষড়যন্ত্রের জবাবে তিনি বৃদ্ধ বয়সেও মানসিকভাবে একজন টগবগে তরুণের মত সক্রিয়ভাবে আন্দোলনের অগ্রভাগে থাকতেন।
এসব আন্দোলনে তার দরদভরা বলিষ্ঠ ভাষণ কর্মীদেরকে অনুপ্রাণিত করত। ১৯৯৪ সালে সিলেট সিটি পয়েন্টে নাস্তিক-মুরতাদ বিরোধী এক মহাসমাবেশে সভাপতির বক্তব্যে তাঁর সারগর্ভ বক্তব্য এভাবে সংক্ষেপে উপস্থাপন করেনঃ
‘ভাইসব! সংক্ষিপ্ত একটি কথা সবাই মনযোগ দিয়ে শুনুন!রাসুল সা. মায়াজ ইবনে জাবাল এবং হুজায়ফা আল হিজাযী রাজি. কে দুটি স্থানে গভর্ণর করে পাঠানোর সময় নসিহত করলেন,পরস্পরে দেখা সাক্ষাৎ করবে। একদিন হুজাইফা রাজি. মায়াজ ইবনে জাবালকে দেখতে গেলেন, মায়াজের আঙ্গিনায় গিয়ে দেখলেন মায়াজ রাজি. কোষমুক্ত তরবারি হাতে ঘোড়ায় সওয়ার। হুজাইফা সালাম বিনিময়ের পর জিজ্ঞেস করলেন,হে মায়াজ!এ অবস্থায় কেন?হজরত মায়াজ রাজি. সামনে খুটির সাথে বাধা একটি লোককে দেখিয়ে বললেন,এই লোকটি মুরতাদ হয়ে গেছে। আল্লাহর কসম! এই লোকটিকে হত্যা করা ছাড়া আমি ঘোড়ার উপর থেকে নামবোনা। ভাইসব আসুন!নাস্তিক-মুরতাদ ও ইসলামের দুশমনদের বিরুদ্ধে আমরা সাহাবায়ে কেরামের মত আন্দোলনে ঝাপিয়ে পড়ি।’
তাঁর এ বক্তব্যের পর গোটা মহাসমাবেশ উর্মি মালার মত তরঙ্গায়িত হতে থাকে।ইতিহাস নির্ভর সংক্ষিপ্ত ভাষণ একটি মহা-সমাবেশেকে কিরুপ আন্দোলিত করতে পারে, তার নজির শ্রুতা হিসাবে সেদিন প্রত্যক্ষ করেছিলাম।
আধ্যাত্মিক উচ্চমার্গে আসন:
হজরত শায়েখ আমাদের মধ্য থেকে চলে গেছেন। কিন্তু এমনসব ঘটনাপঞ্জি তিনি রেখে গেছেন যা দেশবাসীর মনে যোগ যোগ ধরে স্মরণীয় হয়ে থাকবে। তাঁর এমন কিছু কারামাত রয়েছে যা নিয়ে স্বতন্ত্র একটি পুস্তক রচনা করা যায়। কিন্তু কলেবর বৃদ্ধির আশংকায় সংক্ষিপ্তাকারে তাঁর কিছুটা আলোকপাত করছি।
বাস দুর্ঘটনা থেকে যাত্রীদের রেহাইঃ
একদিন হযরত সিলেটের উদ্দেশ্যে বাসে চড়ে বসেছেন।বাস আটগ্রাম স্টেশনের কাছে যেতেই দুটি চাকা খসে পড়ে যায়। যাত্রীদের মাঝে আতংকে হৈচৈ পড়ে যায়। হযরত কিন্তু ঘাবড়ালেননা। তিনি কি যেন পড়লেন। অতঃপর গাড়ি আপন গতিতে চলতে লাগল। যাত্রীরা চালকের কাছে কি ঘটেছিল জানতে চাইলে চালক বললেন,আমি দেখতে পেলাম গাড়িটি খাদে পড়ে গেল। তৎক্ষনাৎ দুজন লোক এসে গাড়িটি সড়কে উঠিয়ে দিল। নিশ্চয় কোনো ওলির দোয়ায় আল্লাহ এবার সবাইকে বাচিয়েছেন। চালক কথা শেষ করে পেছনে তাকাতেই দেখেন হজরত শাইখে মামরখানী ভাবলেশহীন অবস্থায় গাড়ীতে বসে আছেন।
অনুরুপভাবে বোবা লোককে কথা বলানো,দুরারোগ্য ক্যান্সার ব্যাধি থেকে আরোগ্য লাভ,জ্বীন-ভূত,বিষাক্ত সর্প বিতাড়ন,পাগলামী থেকে পরিত্রান ইত্যাদি ক্ষেত্রে হজরত শাইখে মামরখানী রহ. এর দোয়ার কার্যকারিতা ও কারামাত সম্পর্কে লোক মুখে বহু জনশ্রুতি রয়েছে।
এসব কারামাত ও ঘটনাবলীতে আধ্যাত্মিক জগতে তাঁর উচ্চ অবস্থানের প্রমাণ মেলে। আর হবেইনা কেন? যিনি তাঁর জীবনকে আল্লাহর রঙ্গে রাঙ্গিয়েছন,রাসুলের সুন্নাহর আলোকে জীবন সাজিয়েছেন, তাঁর তো এমনই হবার কথা।
একবার মাইজকান্দি মাদ্রাসার বার্ষিক মাহফিলে তিনি আমাদের বাড়ীতে মেহমান হয়েছিলেন।রাতের খানার পর হুজুরকে একটি পৃথক কামরায় আরাম করার ব্যবস্থা করে দিয়ে আমি জলসায় চলে যাই।প্রায় ঘন্টা খানেক পর আবার হুজুরের খোজ নিতে আসি।দেখলাম এখনো হুজুর এপাশ ওপাশ করছেন।ঘুম আসছেনা।খাদেমকে জিজ্ঞেস করলাম,কি আজ হুজুরের তবিয়ত ভাল নেই?খাদেম বললেন,না শরীর তো ভালই। আমার মনে হয় এই রুমের কোথাও কোনো প্রাণীর ছবি থাকায় হুজুরের ঘুম আসছেনা। গোটা রুম খুজে কোনো প্রাণীর ছবি পাওয়া গেলনা। অবশেষে খাদেম আবিষ্কার করলেন,হজরতের শিয়রের পাশে রাখা হারিকেনটির গায়ে একটি প্রাণীর ছবি। তখন হারিকেনটি পাশের রুমে নিয়ে রেখে এসে দেখি হুজুর গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন।
আল্লাহর ওলীরা ফেরেশতাদের আনাগোনা দিব্যি চোখে প্রত্যক্ষ করেন। আর হাদীসে এসেছে,যে ঘরে প্রাণীর ছবি থাকবে সে ঘরে রহমতের ফেরেশতা প্রবেশ করেননা।
তিনিতো সে মাপের ওলী ছিলেন। রাসুলের এমন কোনো সুন্নত বাদ যায়নি, যা তিনি আমল করেন নি। তাই কখনো তাকে দেখতে পাই একজন বিজ্ঞ শিক্ষক হিসাবে দারস দিচ্ছেন। কখনো দেখা যায় একজন সফল ব্যবসায়ী হিসাবে বাজারে সওদাপাতি নিয়ে উপস্থিত। কখনো দেখা যায় কাস্তে কোদাল হাতে একজন গেঁয়ো কৃষকের বেশে,আবার কখনো গৃহকর্তা হিসাবে বাজারের ফর্দ নিয়ে কেনাকাটা করছেন পরিবারের জন্য। কখনো বিচারেকের আসনে,কখনো রাজনীতির মঞ্চে,আবার কখনো বা একজন দরদী সমাজসেবী হিসাবে জনগণের দোয়ারে।বস্তুত রাসুলে কারীম সা. এর জীবনে যেরুপ আমরা সার্বজনীন কর্মপ্রয়াসের সন্ধান পাই। তদ্রূপ হজরত মামরখানী রহ.’র জীবনেও রাসুলের সুন্নাহর পদাঙ্ক অনুসরণের প্রমাণ পাই। এমন পূর্ণাঙ্গ চরিত্রের সন্ধান সত্যিই বিরল।
পারিবারিক জীবন:
আল্লামা আব্দুল গফফার শাইখে মামরখানী (রহঃ) জীবনে চারটি বিবাহ করেন।স্ত্রীদের অধিকারের ব্যাপারে তিনি ছিলেন খুবই সচেতন।জীবদ্দশায় তিনি কখনো কোনো স্ত্রীর হক ও অধিকার নষ্ট করেন নি।প্রথম স্ত্রীর গর্ভে ২ ছেলে ও ৫ মেয়ে জন্মলাভ করেন।দ্বিতীয় স্ত্রীর গর্ভে ৪ ছেলে ও ২ মেয়ে এবং তৃতীয় স্ত্রীর গর্ভে ৪ ছেলে ও ১ মেয়ে জন্মলাভ করেন।নীচে স্ত্রী ও ছেলেমেয়েদের নামের তালিকা দেওয়া হল:
স্ত্রীদের নামের তালিকা
১/ হাবিবা খানম
২/ রহমতুন্নেছা
৩/ আয়েশা খানম
৪/ রোকিয়া খানম
ছেলেদের নামের তালিকা
১/ মাওলানা আব্দুস সত্তার
২/ ক্বারী মাওলানা আব্দুল জলিল
৩/ মাওলানা আব্দুল জব্বার
৪/ মাওলানা আব্দুর রহিম
৫/ মাওলানা আব্দুল করিম
৬/ জনাব এম এ হালিম
৭/ হাফিজ মাওলানা মুফতি আব্দুর রাজ্জাক
৮/ মাওলানা আব্দুল কাহির
৯/ হাফিজ মাওলানা আব্দুল হান্নান কাসেমী
১০/ হাফিজ মাওলানা ইয়াকুব হুসাইন জাকির
মেয়েদের নামের তালিকা
১/ খালেদা খানম
২/ আছিয়া খানম
৩/ খাদিজা খানম
৪/ রাজিয়া খানম
৫/ ফাতিমা খানম
৬/ রাকিয়া খানম
৭/ সালেহা খানম
৮/ তাহেরা খানম
ইন্তেকাল:
২০০২ ঈসায়ী সালের ১৮ জুন,৫ আষাঢ় ১৪০৯ বাংলা,৬ রবিউস সানী ১৪২৩ হিজরী মঙ্গলবার দুপুর ১.১৫ মিনিটে সিলেট ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে এ কীর্তিমান মনীষী সবাইকে শোক সাগরে ভাসিয়ে তাঁর পরম প্রভুর সান্নিধ্যে চলে যান।ইন্নালিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন। পরদিন বেলা ২ ঘটিকার সময় মুনশী বাজার মাদ্রাসা মাঠে লাখো জনতার অংশগ্রহণে তাঁর নামাজে জানায় অনুষ্ঠিত হয়। হযরতের জ্যেষ্ঠ ছাহেবজাদা মাওলানা শায়খ আবদুস সাত্তার সাহেব জানাজার জামাতের ইমামতি করেন। মুনশী বাজার মাদ্রাসা মসজিদের সামনে তাঁকে সমাহিত করা হয়।
মহান আল্লাহ তায়ালা আল্লামা আব্দুল গফফার শাইখে মামরখানী (রহঃ) কে জান্নাতুল ফিরদাউসের সর্বোচ্চ মাক্বাম দান করুন।আমিন।
লিখেছেন-
মাওলানা মুখলিছুর রহমান
সাহিত্যিক-গবেষক,জয়েন্ট সেক্রেটারি,আল্লামা আব্দুল গফফার (রহঃ) ফাউন্ডেশন।