সারা দেশের মাদ্রাসাসমূহ

শায়খুল হাদীস আল্লামা তাফাজ্জুল হক হবিগঞ্জী রাহ. এর সংক্ষিপ্ত জীবন ও কর্ম

January 06 2020, 09:54

Manual2 Ad Code

মাওলানা এহতেশামুল হক ক্বাসিমী

অসংখ্য মনীষার পদচারণায় ধন্য হয়েছে সিলেটের মাটি। অজস্র রাহবারের পদধূলিতে পুলকিত হয়েছে চা-পাতার দেশ সিলেট অঞ্চল। যুগে যুগে পূন্যাত্মাদের পরশ পেয়ে এ জনপদ সভ্যতা ও সংস্কৃতির এমন এক উঁচু মাকাম অর্জন করেছে, যা অন্যান্য অঞ্চলের জন্য ঈর্ষণীয়।
হযরত শাহজালাল মুজাররাদে ইয়ামানী রাহ. ও তাঁর ত্রিশতাধিক সহচরের আগমনের মধ্য দিয়ে সবুজ বাংলার আধ্যাত্মিক রাজধানী সিলেটের গোড়াপত্তন হয়। দ্বীনী জ্ঞান-বিজ্ঞানের মারকায হিসেবে তখন থেকেই আত্মপ্রকাশ করে সিলেট অঞ্চল। তাদের পরবর্তীতে আরো উর্বর হয়ে উঠে সিলেটের মাটি। ফলে যুগে যুগে জন্ম নেন অনেক মহামানব। শুভাগমন করেন শাহজালালে সানী আল্লামা হুসাইন আহমদ মাদানী সহ আরো কত ধর্মবিদ। তারা অগণন বেশুমার। সিলেটের আপামর মানুষ তাদের যথাযথ মূলায়ন করেছে। ফলে তারা সফল হয়েছেন নিজেদের উদ্দেশ্যে ও টার্গেটে, দ্বীনের প্রচার ও প্রসারে। বাস্তবতার নিরিখে একটি কথা বলতে হচ্ছে যে, এই আহলে ইলম পীর-মাশায়েখের কদর করার কারণেই এ অঞ্চলের মানুষ দ্বীন-দুনিয়ার হর লাইনে উন্নতি ও সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে চলেছে। এই আদর্শ অব্যাহত থাকলে সিলেটবাসীর তারাক্কির গতি কোথায় গিয়ে যে ঠেকবে, তা একমাত্র আল্লাহই মালূম!
যেসব মনীষির পদভারে ধন্য হয়েছে সিলেট অঞ্চল, তাদের অন্যতম একজন হলেন খলীফায়ে হযরত শায়খে রেঙ্গা আল্লামা তাফাজ্জুল হক হবিগঞ্জী রাহ.। তিনি ‘হবিগঞ্জী হুজুর’ নামে সারা দেশে ছিলেন ব্যাপক পরিচিত ও সমাদৃত। বহুমুখী গুণের অধিকারী এই কীর্তিমান পুরুষ একদিকে যেমন তাঁর তাফসীরে মুক্তা ঝরতো। অন্যদিকে বাতিলের বিরুদ্ধে সৎসাহসী-বজ্রকণ্ঠের অধিকারী এক মহান ব্যক্তিত্ব ছিলেন। অধ্যাপনার জগতে যেমন ছিলেন হাদীস শাস্ত্রের সর্বাপেক্ষা বিশুদ্ধ কিতাব সহীহ বুখারির উস্তায। অপরদিকে আধ্যাত্মিক পরিম-লে তিনি অনুসন্ধিৎসু পথহারাদের পথপ্রদর্শক হযরত শায়খে রেঙ্গা রাহ.’র অন্যতম খলীফা।
কুরআন-সুন্নাহর গভীর জ্ঞানে পারদর্শী যে কয়জন বুযুর্গ আলেম ওয়াজ-নসিহতের মাধ্যমে জাতিকে সহীহ রাহনুমায়ী করতে দেশ বিদেশের সর্বত্র চষে বেড়িয়েছেন তন্মধ্যে তিনি ছিলেন শীর্ষতম। তিনি জামেয়া তাওয়াক্কুলিয়া রেঙ্গার চতুর্থ শায়খুল হাদীস। সামগ্রিক গুণের অধিকারী ব্যক্তিত্ব ও ব্যাপকতায় তিনি ছিলেন এক বিরল দৃষ্টান্ত। সুলুক ও এহসানের এক অতুলনীয় রাহবার।

Manual5 Ad Code

জন্ম ও বংশ: তিনি ১৩৫৯ হিজরী মোতাবেক ১৯৩৮ সালে হবিগঞ্জের কাঠাখালি গ্রামে এক সম্ভ্রান্ত বংশের দ্বীনদার পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম মাওলানা শায়খ আব্দুন নূর রাহ.। নানা মাওলানা আসাদুল্লাহ রাহ. ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনে প্রথম সারির এক মর্দে মুজাহিদ ছিলেন।

শিক্ষাজীবন: পিতা-মাতার কাছেই তিনি পড়ালেখা শুরু করেন। প্রাথমিক শিক্ষা গ্রহণ করেন আপন পিতার প্রতিষ্ঠিত কাটাখালী মাদরাসায়। এরপর তিনি হবিগঞ্জের জামেয়া সাদিয়া রায়ধর মাদরাসায় তাঁর মামা হযরত মাওলানা মুখলিসুর রাহমান রাহ.’র কাছে আরবী ব্যাকরণ ও আরবী ভাষা রপ্ত করেন। তাঁর মামা ছিলেন শায়খুল ইসলাম হুসাইন আহমদ মাদানী রাহ.’র শিষ্য। প্রাথমিক স্তরের পড়াশোনা শেষ করে তিনি দারুল উলূম মুঈনুল ইসলাম হাটহাজারীতে ভর্তি হন। সেখানে তিনি মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষা অর্জন করেন। ১৯৬০-৬১ ঈসায়ী সালে ‘দাওরায়ে হাদীস’ সম্পন্ন করেন। অতঃপর পাড়ি জমান তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তানে। সেখানে ‘জামেয়া আশরাফিয়া লাহোর’ এ পুনরায় দাওরায়ে হাদীসে ভর্তি হন। এরপর তিনি কানপুর মাদরাসায় হাফিযুল হাদীস আব্দুল্লাহ দরখাস্তী রাহ.’র কাছে তাফসীরের বিশেষ পাঠ গ্রহণ করেন। তারপর ‘জামিয়াতুল উলূমিল ইসলামিয়া বানূরী টাউন করাচী’ মাদরাসায় শায়খুল হাদীস ইউসূফ বানূরী রাহ.’র কাছে সাহীহুল বুখারী, হুজ্জাতুল্লাহিল বালিগা অধ্যয়নের পাশাপাশি তাফসীরুল কুরআন বিষয়েও বিশেষ কোর্স সম্পন্ন করেন।

Manual5 Ad Code

দারুল উলুম দেওবন্দ গমণ: পাকিস্তান থেকে তিনি ভারতের দারুল উলূম দেওবন্দে পাড়ি জমান। ভারত-পাকিস্তান ডিভাইডের ফলে দারুল উলূম দেওবন্দে তখন পাকিস্তানী ছাত্র ভর্তি বন্ধ ছিলো। তাছাড়া তিনি যখন দেওবন্দ পৌঁছেন, তখন ভর্তির সময়ও শেষ হয়ে গিয়েছিল। ফলে তিনি দারুল উলূমের নিয়মিত ছাত্র হিসেবে ভর্তি হতে পারেননি; তবে তৎকালীন মুহতামিম আল্লামা কারী তায়্যিব রাহ.’র অনুমতিতে দারুল উলূম দেওবন্দে ‘খুসুসী দারস’ (বিশেষ পাঠ) গ্রহণ করেন এবং তৎকালীন শায়খুল হাদীস আল্লামা ফখরুদ্দীন মুরাদাবাদী রাহ.’র কাছে সহীহুল বুখারী, শায়খ ইবরাহীম বলিয়াভী রাহ.’র কাছে জামে তিরমিযী, মাওলানা ফখরুল হাসান রাহ.’র কাছে তাফসীরে বায়যাবী ও আল্লামা কারী তায়্যিব রাহ.’র কাছে হুজ্জাতুল্লাহিল বালিগা অধ্যয়ন করেন।

সহীহ বুখারীর সনদ: শায়খুল হাদীস হবিগঞ্জী রাহ. যুগশ্রেষ্ট পাঁচজন প্রথিতযশা শায়খুল হাদীসের কাছ থেকে বুখারী শরীফের দারস প্রদানের অনুমতি পেয়েছেন। তারা হলেন, হাটহাজারী মাদরাসায় শায়খ আব্দুল কাইয়্যূম রাহ. ও মুফতিয়ে আযম শায়খ ফায়যুল্লাহ রাহ., লাহোরের মাওলানা শায়খ ইদরিস কান্ধলভী রাহ., করাচীতে শায়খ ইউসুফ বানূরী রাহ. এবং দারুল উলূম দেওবন্দের শায়খ ফখরুদ্দীন আহমদ মুরাদাবাদী রাহ.। সাহারানপুরের শায়খুল হাদীস যাকারিয়া রাহ.’র কাছ থেকেও বুখারির প্রথামাংশের অনুমতি পেয়েছেন।

Manual4 Ad Code

কর্মজীবন: ১৯৬৪ সালে কুমিল্লার দারুল উলূম বরুড়া মাদরাসায় শিক্ষকতার মধ্য দিয়ে তার কর্মজীবনের সূচনা হয়। তিন বছর এ মাদরাসায় হাদীস, তাফসীরসহ বিভিন্ন শাস্ত্রের দারস প্রদান করেন। ১৯৬৬ সালের শেষ দিকে দারুল উলূম মঈনুল ইসলাম হাটহাজারীর মুহতামিম হযরত মাওলানা আব্দুল ওয়াহাব রাহ.’র নির্দেশে ময়মনসিংহের আশরাফুল উলুম বালিয়া মাদরাসায় শায়খুল হাদীস হিসেবে যোগদান করেন। ১৯৬৯ সাল পর্যন্ত তিন বছর বালিয়া মাদরাসায় হাদীসের খেদমতে নিয়োজিত ছিলেন। ১৯৬৯-৭১ সালের ১৬ ডিসম্বরের পূর্ব পর্যন্ত ময়মনসিংহের জামিয়া ইসলামিয়ায় দারসে হাদীসের খেদমত আঞ্জাম দেন। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর হবিগঞ্জে আসেন। এলাকাবাসীর অনুরোধ ও হযরত শায়খে রেঙ্গা রাহ.’র নির্দেশে হবিগঞ্জের জামিয়া আরাবিয়া উমেদনগর মাদরাসায় যোগদান করেন। গতকাল অবধি এ মাদরাসাতেই মুহতামিম ও শায়খুল হাদীসের দায়িত্ব আঞ্জাম দিয়েছেন। অপরদিকে ১৪৪০ হিজরির ২৮ রমজান তিনি জামেয়া তাওয়াক্কুলিয়া রেঙ্গার শায়খুল হাদীস হিসেবে নিয়োগ লাভ করেছিলেন। ১৮ জুলাই ২০১৯ বৃহস্পতিবার তিনি জামেয়া তাওয়াক্কুলিয়া রেঙ্গায় বুখারীর প্রথম দারস প্রদান করেন। গতকাল পর্যন্ত তিনি জামেয়ার শায়খুল হাদীস হিসেবে দারসে হাদীসের মসনদে সমাসীন ছিলেন।

তাযকিয়ায়ে নাফস: শায়খুল হাদীস হবিগঞ্জী রাহ. জীবনের দীর্ঘ সময় বিভিন্ন শায়খের সান্নিধ্যে থেকে আধ্যাত্মিক ফয়েয ও বরকত লাভ করেন। প্রথমে তিনি মুফতিয়ে আযম আল্লামা ফায়যুল্লাহ রাহ.-’র কাছে বায়আত হন। অবশেষে শায়খুল ইসলাম মাদানী রাহ.’র কয়েকজন খলীফার সাথে পরামর্শ, ইস্তেখারা ও দিলের রুজহানের কারণে হযরত শায়খে রেঙ্গা রাহ.’র কাছে বাইয়াত হন। শায়খুল হাদীস হবিগঞ্জী রাহ. তাসাউফের উপর দীর্ঘদিন রিয়াযত ও মুজাহাদা করেন। এরপর এক সময় হযরত শায়খে রেঙ্গা রাহ. তাঁকে বায়আত ও সুলূকের ইজাযত প্রদান করেন।

রাজনৈতিক জীবন: শুধু দারস-তাদরীস ও তাযকিয়ায়ে নাফস নিয়ে তিনি ব্যস্ত ছিলেন না। তিনি রাজনীতির ময়দানেও সরব ছিলেন। সমান অবদান রেখেছেন হর ময়দানে। তিনি জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় সহ-সভাপতি ও হবিগঞ্জ জেলার সভাপতির দায়িত্বে নিযুক্ত ছিলেন। তাছাড়া হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় সহ-সভাপতি হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন। ইসলামী আন্দোলনের এক অগ্রজপুরুষ হিসেবে তিনি সারা দেশে ছিলেন নন্দিত ও অনুসৃত। ইসলাম ও মুসলিম জাতির স্বার্থে তাঁর নেতৃস্থানীয় ভূমিকা সুবিদিত।

Manual5 Ad Code

পারিবারিক জীবন: শায়খুল হাদীস হবিগঞ্জী দা.বা. ময়মনসিংহের বিখ্যাত আলিম হযরত মাওলানা আরিফ রব্বানী রাহ.’র ৪র্থ কন্যার সাথে ১৯৬৭ সালে পরিণয়সূত্রে আবদ্ধ হন। শায়খের ৬ ছেলে ও ৪ মেয়ে। এক ছেলে শৈশবেই ইন্তেকাল করেন। বাকি সবাই যোগ্য আলিম ও আলিমা হয়ে দ্বীনের বহুমুখী খিদমাত আঞ্জাম দিয়ে যাচ্ছেন।

ইন্তেকালঃ তিনি বিগত কয়েক মাস থেকে বয়োবৃদ্ধজনিত রোগে আক্রান্ত ছিলেন। শ্বাসকষ্টজনিত কারণে ৫ জানুয়ারী ২০২০ ইং রবিবার বাদ আছর হবিগঞ্জ থেকে সিলেট নিয়ে আসার জন্য বের হন। পথিমধ্যেই তিনি মাওলানার ডাকে সাড়া দিয়ে চলে যান লাখলাখ আশেক, মুতাআল্লিকীন, মুরীদীন, মুহিব্বীন ও তালেবানকে ইয়াতীম বানিয়ে। ইন্নালিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ৮২ বছর। আল্লাহ পাক তাকে জান্নাতের সুউচ্চ মাকাম দান করুন। আমীন।

লেখক: সিনিয়র মুহাদ্দিস, জামেয়া দারুল কুরআন, ইমাম ও খতীব, শিবগঞ্জ বাজার জামে মসজিদ।

Spread the love