সারা দেশের মাদ্রাসাসমূহ

মাওলানা শায়খ নজির আহমদ ঝিংগাবাড়ি (দা:বা:)’র জীবন ও কর্ম

November 20 2019, 03:58

Manual3 Ad Code

সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে কুরআন হাদিসের আলো ছড়িয়ে দিয়ে সত্যিকারের মানুষ গড়ার ক্ষেত্রে যেই মহান ব্যক্তিদের অবিস্মরণীয় ভুমিকা আমাদের ভারত উপমহাদেশকে আলোকিত করেছে , তাদের অন্যতম প্রতিচ্ছবি হলেন শাইখুল হাদিস আল্লামা নজির আহমদ ঝিংগাবাড়ি হুজুর (দা:বা:)। সিলেটের ঐতিহ্যবাহী জামেয়া তাওয়াক্কুলিয়া রেঙ্গাসহ অনেক মাদ্রাসায় যিনি অব্যাহত ভাবে ছহীহ বুখারী শরীফ ও অন্যান্য সিহাহ সিত্তাহের কিতাবাদীর অধ্যাপনা চালিয়ে যাচ্ছেন। সুন্নতে নববীর অনুসরণ ও আখলাকে নববীর আলোয় আলোকিত সালাফে সালেহীনের জীবন্ত প্রতিচ্ছবি এই মহান শায়খের সংক্ষিপ্ত জীবনালেখ্য কওমিপিডিয়ার পাঠকদের জন্য পেশ করা হলো। আশাকরি সবাই উপকৃত হবো ইনশাআল্লাহ।

নাম: নজির আহমদ

জন্মঃ বাংলাদেশের অাধ্যাত্নিক রাজধানী সিলেটের কানাইঘাট থানাধীন লামাঝিংগাবাড়ি গ্রামে এক সম্ভ্রান্ত দ্বীনদার ফ্যামেলিতে ৪ মে ১৯৪৩ ঈসায়ীতে তিনি জন্ম গ্রহণ করেন। তাঁর পিতা হলেন হযরত মাওলানা আজিজুর রহমান রাহ.। যিনি ছিলেন অনেক উঁচু মাপের আলেমে দীন। ছিলেন সমাজের সম্মানিত ব্যক্তিত্ব, অত্যন্ত আমলওয়ালা, সাধাসিধে জীবনের অধিকারি এক মহান মনিষা। দ্বীনি শিক্ষা বিস্তারে যার রয়েছে অসামান্য অবদান। লামা ঝিংগাবাড়ি মোহাম্মাদিয়া মাদ্রাসা তাঁরই প্রতিষ্ঠিত এক ঐতিহ্যবাহী বিদ্যাপীঠ। শিক্ষাজীবনঃ শায়খ নজির আহমদ ঝিঙ্গাবাড়ীর প্রাথমিক শিক্ষার হাতে খড়ি তার মায়ের কাছেই হয়েছে, অতপর কোরঅান শরিফ পড়েন ক্বারী মাওলানা আহছানুল্লাহ সাহেবের নিকট। ইবতেদায়ি ও ছাফেলা বিভাগ তার মুহতারাম পিতার তত্ত্বাবধানে ঝিঙ্গাবাড়ী মাদ্রাসায় সমাপ্ত করেন। আলিয়া আওয়াল ও আলিয়া দুওম গাছবাড়ি মুজাহিরুল উলুম দারুল হাদিস ক্বওমি মাদ্রাসায় হজরত মাওলানা ইসহাক্ব সাহেব রহ., হজরত মাওলানা হায়াতুল্লাহ সাহেব রহ.প্রমুখের নিকট অধ্যয়ন করেন। আলিয়া ছুওম থেকে কানাইঘাট দারুল উলুম মাদ্রাসায় লেখাপড়া করেন।

সেখানে মুখতাসারুল মা’আনী, তাফসীরে জালালাইন শরীফ, তাফসীরে বায়যাবী শরীফ, মিশকাত শরীফ, শরহে আকাইদ, তাফসীরে মাদারেক, মোসাল্লামুসসুবূত, সুল্লামুল উলূম ও সিহাহ সিত্তার কিতাবাদি শায়খুল হাদীস হযরত মাওলানা মোজাম্মিল সাহেব, শায়খুল হাদীস হযরত মাওলানা শহরুল্লাহ সাহেব, হযরত মাওলানা শফিকুল হক আকুনি সাহেব, হযরত মাওলানা আব্দুর রব ফিল্লাকান্দি সাহেব, হযরত মাওলানা ফয়জুল বারী মহিষপুরী সাহেব রাহি.সহ যুগশ্রেষ্ঠ আলেমদের নিকট অধ্যয়ন করেন। দাওরায়ে হাদীসে দুই বছর আল্লামা মুশাহিদ বায়মপুরী রহমতুল্লাহি আলাইহি এর নিকট পুরো বুখারী শরীফ অধ্যয়ন করেন। শেষ দিকে তিনি কঠিন ভাবে অসুস্থ হয়ে পড়ায় চিকিৎসার উদ্দেশ্যে ঢাকায় চলে যান এবং চিকিৎসা চলাকালীন সময়ে হযরত শামসুল হক ফরিদপুরী রহমতুল্লাহি আলাইহি প্রতিষ্ঠিত বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাহী প্রতিষ্ঠান লালবাগ মাদ্রাসায় দাওরায়ে হাদিসে আবার ভর্তি হন, এবং সেখানে উপমহাদেশের প্রখ্যাত শাইখুল হাদিস আল্লামা আজিজুল হক রহমতুল্লাহি আলাইহির নিকট পবিত্র বুখারী শরিফ দ্বিতীয়বার পড়েন।

Manual3 Ad Code

এছাড়াও আল্লামা হেদায়েত উল্লাহ সাহেব রাহ. আল্লামা মুহাম্মদ উল্লাহ হাফেজ্জী হুজুর রহ. সহ আরো অন্যান্য মুহাদ্দিসীনে কেরামের নিকট উলূমে হাদীসের উচ্চতর পড়াশোনা করেন। তিনি ঢাকায় অবস্থান করে দীর্ঘদিন চিকিৎসা গ্রহণ করার পরও শারীরিক অবস্থার উন্নতি না হওয়ায় অবশেষে ডাক্তারদের পরামর্শে আবার বাড়িতে চলে আসতে বাধ্য হন। অতপর মাওলানা হাফিজ জাওয়াদ সাহেব রহমতুল্লাহি আলাইহির কাছে হুজুরের মুহতারাম পিতা মাওলানা আজিজুর রহমান (রাহঃ) তার ছেলেকে হাদিস পড়ানোর অনুরোধ করলে তিনি তা গ্রহণ করেন এবং তাকে দেউলগ্রাম দারুল উলুম মাদ্রাসায় ভর্তি করেন। তারপর তিনি দেউলগ্রাম মাদরসায় হযরত জাওয়াদ সাহেবের কাছে বুখারী শরীফ সহ অন্যান্য হাদীসের কিতাবের তৃতীয়বারের মত দরস গ্রহণ করতঃ সেখান থেকেই আযাদ দ্বীনি এদারা বোর্ডের অধীনে ১৩৮৩ হিজরীতে দাওরায়ে হাদীসের চূড়ান্ত পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করেন এবং অত্যন্ত কৃতিত্বের সাথে উত্তীর্ণ হন।

কর্মজীবনঃ হযরত মাওলানা নেছার আলী রহ. এর প্রতিষ্ঠিত তালবাড়ি ফয়জে আম নেছারীয়া মাদ্রাসায় শিক্ষকতার মাধ্যমে তাঁর কর্মজীবনের সূচনা হয়। অতপর নিজ এলাকার মুরব্বিদের নির্দেশে হুজুরের পিতা কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত লামাঝিংগাবাড়ি মাদ্রাসায় চলে আসেন। এমতাবস্থায় খুসুসীভাবে তাফসীরুল কুরআন পড়ার প্রতি তার প্রবল আগ্রহ তৈরী হয়। তখন তিনি চারখাই আদিনাবাদ আতহারুল উলুম মাদ্রাসার শিক্ষক শায়খুল হাদীস মাওলানা শফিকুল হক আকুনি ও মাওলানা আব্দুর রব ফিল্লাকান্দির নিকট তাখাসসুস ফিত তাফসিরের পড়াশোনা শুরু করেন। পরবর্তী বছর তার ওস্তাদ মাওলানা জাওয়াদ সাহেব রহ. এর নির্দেশে বিয়ানীবাজার দেউলগ্রাম মাদ্রাসায় পুনরায় শিক্ষক নিয়োগ হন। এখানে হুজুর প্রায় আটবছর হাদিস,তাফসীর, ফেকাহ সহ বিভিন্ন ফনের কিতাবাদির দরস প্রদান করেন। সেইসঙ্গে মাদ্রাসার নাজিমে তা’লিমাতের দায়িত্বও আঞ্জাম দেন। এরই মধ্যে ১৯৭১ সালে দেশ স্বাধীন হয়। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর জামেয়া ক্বাসিমুল উলুম দরগাহ মাদ্রাসায় দারুল হাদীসের ইফতেতাহ হলে মুফতি রহমতউল্লাহ তালবাড়ি রহ. এর নির্দেশে সেখানে তিনি সিনিয়র উস্তাদ হিসেবে় নিয়োগ হন। এখানে প্রায় আটবছর হাদীস, তাফসীর, ও ফেকাহ সহ দরসে নেজামীর বিভিন্ন কিতাব অত্যন্ত সুনামের সাথে অধ্যাপনা করেন। পাশাপাশি মাদরাসার কুতুবখানা বিভাগের জিম্মাদারিও আদায় করেন।

Manual5 Ad Code

দরগাহ মাদ্রাসার মুহাদ্দিস থাকাকালীন সময়ে তিনি আম্বরখানা ফাজিল চিশত জামে মসজিদের ইমাম ও খতিবের দায়িত্বেও ছিলেন। অতপর তাঁর উস্তাদ শায়খুল হাদীস জাওয়াদ সাহেব রহ. এর নির্দেশে জামেয়া ইসলামিয়া রাজাগঞ্জের মুহতামিম ও নাজিমে তালিমাতের দায়িত্ব গ্রহণ করেন এবং সহিহ বুখারী শরীফ সানি ও দরসে নেজামির বিভিন্ন কিতাবাদি প্রায় আট বছর অধ্যাপনা করেন। পরে জামেয়া তাওয়াক্কুলিয়া রেংগার মুহতামিম হযরত মাওলানা শামসুল ইসলাম খলিল সাহেবের অনুরোধে জামেয়া রেঙ্গায় উস্তাদ হয়ে আসেন। বছর দেড়েক পরে বাড়িতে জরুরতের দরুন রেঙ্গা মাদ্রাসা থেকে চলে যেতে বাধ্য হন এবং বাড়ির কাছে চারখাই আদিনাবাদ আতহারুল উলুম মাদ্রাসায় দারুল হাদিসের শুভ সূচনা করেন। এখানে সহিহ বুখারী শরীফ সহ অন্যান্য হাদীসের কিতাবাদি অধ্যাপনা করেন।

পরবর্তীতে মাদ্রাসার আর্থিক প্রতিকুলতা ছাড়াও অন্যান্য কিছু কারণে দাওরায়ে হাদিসের জামাত বন্ধ হয়ে গেলে রামধা আসাদুল উলুম মাদ্রাসার মুহতামিম হযরত মাওলানা মুতাসিম বিল্লাহ সাহেবের অনুরোধে এখানে চলে আসেন এবং তিন বৎসর যাবত বুখারী শরীফসহ হাদিসের অন্যান্য কিতাবাদি পড়ান। তাছাড়া মাদ্রাসার শিক্ষা-সচিবের দায়িত্বও পালন করেন। পরবর্তীতে সিলেট শহরের বিশিষ্ট কিছু ব্যক্তিবর্গের অনুরোধে সিলেট দরগাহ জামে মসজিদের ইমাম ও খতিব নিয়োগ হন, কিন্তু দরসের প্রতি অস্বাভাবিক টান থাকায় অল্পদিনেই ইমামতির ইতি টেনে পুনরায় রামধা মাদ্রাসায় চলে যান, এবং সেখানে থাকাকালীন সময়ে কাজির বাজার মাদ্রাসার প্রিন্সিপাল মাওলানা হাবিবুর রহমান রহ.এর অনুরোধে শায়খুল হাদিস হিসেবে জামেয়া মাদানিয়া কাজির বাজার মাদ্রাসায়ও কিছুকাল খেদমত করেন। সর্বশেষ জামেয়া তাওয়াক্কুলিয়া রেংগার মুহতামিম মাওলানা শামসুল ইসলাম খলিল সাহেবের অনুরোধে পুনরায় সানী শায়খুল হাদীস হিসেবে চলে আসেন জামেয়া রেঙ্গায় এবং অদ্যাবধি এই জামেয়ায়ই হাদিস,তাফসীর ও অন্যান্য ফুনুনাতের কিতাবাদি অধ্যাপনায় নিয়োজিত আছেন।

Manual4 Ad Code

প্রথম কয়েক বছর বুখারী শরীফ সানির সঙ্গে তিরমিজি শরীফ প্রথম খন্ডও পড়ান। অসুস্থতার দরুন বর্তমানে শুধু বুখারী শরীফ সানি ও আরো দু’একটি কিতাবের দরস দিচ্ছেন। সাথে সাথে মুহতামিম সাহেবদের অনুরোধ ও দীনি প্রয়োজনের তাকিদে জামেয়া ইসলামিয়া রাজাগঞ্জ ও গাছবাড়ি মোজাহেরুল উলুম মাদ্রাসায় বোখারী শরীফ পড়ানোর পাশাপাশি এক বছর মুহতামিমও ছিলেন।

তাছাড়া হুজুরের এলাকায় নিজস্ব উদ্যোগে একটি মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করে তার মুহতামিমের দায়িত্বও পালন করছেন। এই মহান শায়খ দীর্ঘদিন যাবত পক্ষাঘাতজনিত অসুস্থতা নিয়েও জামেয়া তাওয়াক্কুলিয়া রেঙ্গাসহ একাধিক মাদ্রাসায় হাদীসের খেদমত নিরলস ভাবে চালিয়ে যাচ্ছেন। বাইয়াত ও খেলাফতঃ হযরত মাওলানা নজির আহমদ দা. বা. হযরত মাদানী রাহ. এর অন্যতম খলিফা হযরত মাওলানা আব্দুল জলিল বদরপুরী রহ. এর নিকট বায়াত হয়ে তাঁর খেলাফত ও এযাযত লাভ করেন।

লেখালেখি ও গ্রন্হরচনাঃ লেখালেখির মাধ্যমেও তিনি অনেক খেদমত আঞ্জাম দিয়েছেন এবং দিচ্ছেন। তাঁর উদ্যোমী প্রতিভার মধ্যে অনেক কিছু লেখার আগ্রহ ছিলো। কিন্তু শারিরিক অসুস্থতার দরুণ পুরোপুরিভাবে হস্তলিপিতে সক্ষম না হওয়ায় তাঁর অনেক গ্রন্হ প্রকাশনার মুখ দেখেনি। তাঁর লিখিত – (১) কুরবানির মাসাঈল ও ঐতিহাসিক পটভূমি। (২) শবেবরাতের তাৎপর্য। (৩) সহজ পদ্বতিতে হজ্জ, ইত্যাদি বই গুলো ইতিমধ্যে প্রকাশিত হয়ে যথেষ্ট পাঠক প্রিয়তা লাভ করেছে। তিনি পূর্ণ সুস্থতা লাভ করলে আরো অনেক বিষয়ে লেখার আশা পোষণ করছেন। মহান এই শায়খ উম্মতের বিরাট বড় নেয়ামত। আল্লাহ পাক যেন তাকে সুস্থতার সাথে দীর্ঘদিন আমাদের মাঝে রাখেন এবং এই নেয়ামতের কদর করার তাওফিক দান করেন। আমিন।

Manual6 Ad Code

লেখক: মুফতি আহমদ রফি জাকির উস্তাদ; জামেয়া ইসলামিয়া দারুল উলুম আজিমগন্জ, মৌলভীবাজার।

Spread the love

Manual1 Ad Code
Manual7 Ad Code