সারা দেশের মাদ্রাসাসমূহ

শাইখুল ইসলাম ইমাম ইবনে তাইমিয়া (র)-এর সংক্ষিপ্ত জীবনী

November 12 2018, 04:03

Manual2 Ad Code

মুসলিম জাতিকে অনুকূল প্রতিকূল উভয় অবস্থার মধ্যদিয়েই সামনে এগিয়ে আসতে হয়েছে। খৃষ্টীয় তের এবং চৌদ্দ শতকের মুসলিম দুনিয়ার ইতিহাস ছিল বড় করুণ ও মর্মান্তিক। সর্বত্র অশান্তি, অস্থিরতা ও ভাঙনের জোয়ার দেখা দিয়েছিল। তাদের সকল ঐতিহাসিক বীরত্বের কাহিনী যেন আরব্য উপন্যাসের কাহিনীতে পরিণত হয়েছিল। ভীরুতা,নিষ্ক্রিয়তা মুসলমানদের আষ্টে পৃষ্ঠে বেঁধে ফেলেছিল।

ঠিক সে সময় অর্থাৎ তের শতকের প্রারম্ভে মঙ্গোলিয়ার মরুচারী তাতারিয়া গোষ্ঠী প্রগৈতিহাসিক যুগের অসভ্য বর্বরদের অনুকরণে তাদের দলপতি চেংগীজ খানের নেতৃত্বে মুলসিম জাহানের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। সর্বপ্রথম আজকের রুশ অধিকৃত বুখারার তৎকালীন শাসনকর্তা সুলতান মুহাম্মদের সাথে সংঘর্ষে লিপ্ত হয়। জীহুন নদীর উত্তরে এক বিশাল প্রান্তরে সুলতানের চার লাখ আট হাজার সৈন্য চেংগীজ বাহিনীকে আক্রমণ করে এবং প্রথম দিনের যুদ্ধেই এক লাখ ৬০ হাজার সৈন্য নিহত হয়। এভাবে পরবর্তী যুদ্ধে সুলতান মুহাম্মদের সৈন্যরা নির্মমভাবে পরাজিত ও নিহত হয়। এরপর মঙ্গোলীয় তাতার সৈন্যরা মুসলিম রাজ্যগুলো একের পর এক ধ্বংস করে সামনে অগ্রসর হতে থাকে। জ্ঞান-বিজ্ঞান ও অন্য দিক থেকে সুসমৃদ্ধ দামেশক ও তৎকালীন মুসলিম দুনিয়ার রাজধানী বাগদাদ নগরীও তাতারীদের অত্যাচার ও ধ্বংসের লীলাভূমিতে পরিণত হয়।

রাজনৈতিক এ পতনের সাথে সাথে মুসলমানরা ধর্মীয় চিন্তা-চেতনা ও চরিত্রেও অধঃপতনের শেষ প্রান্তে গিয়ে উপনীত হয়। তৎকালীন সময় শিক্ষিত বলতে সমাজের আলিমদেরকেই বুঝাতো। আলিমগণের মধ্যে ইখতিলাফ ও মতবিরোধ চরমে উঠে। সাধারণ বিষয়কে কেন্দ্র করেও একদল মুসলমান আরেক দলকে নির্মমভাবে হত্যা করতে ও তিরস্কারবানে জর্জরিত করতে দ্বিধা করতো না। আলিমদের পারস্পরিক হিংসা-বিদ্বেষ দলাদলির ফলে মুসলিম সমাজ শতধাবিভক্ত ও দুর্বল হয়ে পড়ে। মুসলমানদের সেই অনৈক্যের সুযোগে দুশমনরা এ জাতির সব তছনছ করে ফেলে।

অপরদিকে ইসলামের প্রাণসত্তাকে নিঃশেষকারী বিদ’আত, শিরক,পীর পূজা, কবর পূজা ইত্যাদি কুসংস্কার মারাত্মকরূপে বিস্তার লাভ করে। তাওহীদের বাস্তব সংজ্ঞা এক রকম বিলুপ্ত হবার পথে। কুরআন, সুন্নাহ্*র শিক্ষা অনুসরণের চাইতে বিদ’আতী পীর-মাশায়েখের বক্তব্যকে অধিক গুরুত্ব দেয়া হতে থাকে। ইসলামের বিশুদ্ধ ধারণা ও এর নির্মল জ্যোতি প্রায় বিলুপ্তির পথে। অজ্ঞতার অন্ধকার যখন এভাবে মুসলমানের ঈমানী জ্যোতিকে প্রায় নিষ্প্রভ করে দিচ্ছিল, ঠিক তখনই দামেশকের আকাশে এক উজ্জ্বল সূর্যের উদয় ঘটলো। তিনিই হলেন আল্লামা তাকিউদ্দীন আবুল আব্বাস আহমদ ইবনে আবদুল হালীম ইবনে আবদুস সালাম ইবনে আবদুল্লাহ ইবনে ইবনে কাসিম শায়খুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়া আল হাওয়ানী আল দামেশকী।

আল্লামা ইবনে তাইমিয়া ইতিহাসের এই ক্রান্তিলগ্নে আবির্ভূত হয়ে বাতিল আকীদা-বিশ্বাসের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়ে উঠেন। তিনি এ সবের বিরুদ্ধে এক রকম জিহাদ ঘোষণা করেন। জিহাদী প্রেরণাদিপ্ত তাঁর এই সংস্কারধর্মী আন্দোলন ছিল বহুমুখী। লেখা, বক্তৃতা ও আগ্রাসী শক্তির বিরুদ্ধে রণাঙ্গনে সশস্ত্র লড়াইয়ে অংশ গ্রহণ সকল উপায়ে তাঁর এই প্রতিরোধ চলে। সকল প্রকার বিরোধিতা ও অজ্ঞতার মধ্যেই তিনি তাঁর অনুসারীদের নিয়ে নির্ভীকভাবে কাজ করে যান। ন্যায় এবং সত্যের বাণীকে সমুন্নত রাখতে গিয়ে তাঁকে অনেক দুঃখ কষ্টেরই সম্মুখীন হতে হয়। তিনি বন্দী জীবন যাপন করেন। কারা-জীবনের দুঃসহ যন্ত্রণা তিনি ঈমানী শক্তি বলে সহ্য করেন।

শাসকবৃন্দ রাজা-বাদশাহ, আমীর-উমারাদের অনৈসলামিক ভূমিকার প্রতিবাদ ও বিরোধিতার কারণেই তিনি তাদের রোষানলে পড়েন। ইমাম ইবনে তাইমিয়া (র) সততা, নিঃস্বার্থতা ও আল্লাহ্*র পথে ঈমানী দৃঢ়তার পরিচয় দিতে গিয়ে যেই জুলুম-নিপীড়ন ও ভ্রুকুটি সহ্য করেছেন, তার নজির অতি বিরল । দীনের জন্যে আত্মত্যাগের কঠিন অগ্নি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে তিনি যদি “আফজালুল জিহাদ” তথা “অত্যাচারী শাসকের সামনে ন্যায় ও সত্য কথা বলা উত্তম জিহাদ”-এর চেতনায় উদ্ধুদ্ধ হয়ে সংগ্রামের পথ দেখিয়ে না যেতেন, তাহলে পরবর্তী যুগে বিভ্রান্ত অত্যাচারী মুসলিম শাসক ও কুসংস্কারাচ্ছন্ন মারমুখো ব্যক্তিদের সামনে হক কথা বলার লোকের অভাব দেখা দিত। সংগ্রামী ইমাম ইবনে তাইমিয়া (র)-এর গোটা কর্ম জীবনের প্রতি তাকালে তাঁর সম্পর্কিত এ সকল বক্তব্যকে অতিশয়োক্তি বলার কোন উপায় নেই। প্রায় আটশ বছর অতীত হয়ে যাবার পরেও তাঁর লিখিত মূল্যবান গ্রন্থসমূহের চাহিদা ও জনপ্রিয়তা হ্রাস পায়নি। মিসর,হেজাজ, ইরান প্রভৃতি দেশের অসংখ্য লাইব্রেরীতে ইবনে তাইমিয়া (র)-এর গ্রন্থাবলী সংশ্লিষ্ট সমাজের জ্ঞানভাণ্ডারকে সমৃদ্ধ করে আছে। বার্লিন, লন্ডন, ফ্রান্স ও রোমের বহু পাঠাগারের শোভাবর্ধন করছে এ সংগ্রামী মনীষীর জ্ঞানগর্ভ গ্রন্থাবলী।

তিনি তাঁর ক্ষুরধার লেখনী দ্বারা একদিকে ইসলামের “সীরাতুল মুস্তাকীম”কে যাবতীয় আবিলতা মুক্ত করার চেষ্টা করেছেন, অপরদিকে সকলকে যাবতীয় বিভ্রান্তির পথ পরিহার করে আল্লাহ্*র শাসন ব্যবস্থার দিকে এগিয়ে আসার আহ্বান জানিয়েছেন। তাঁর যুগে যে তাগুতী শক্তি ইসলাম এবং মুসলমানদের চলার পথকে অবরোধ করে এগিয়ে এসেছিল, তিনি তার বিরুদ্ধে তরবারীও ধারণ করেন। ফলে চেংগীজী বর্বরদের পাশবিক বিক্রমকেও এর সামনে প্রতিরুদ্ধ হতে হয়েছিল। বলাবাহুল্য, ইসলামকে পুনঃপ্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে আল্লামা ইবনে তাইমিয়া (র) যেভাবে সর্বাত্মক সংগ্রাম করে গেছেন, পরবর্তী যুগে সঠিকভাবে প্রতিটি মুসলিম দেশের ইসলামী নেতৃত্ব যদি সেই জিহাদী ভাবধারা অনুসরণ করতে পারতেন, তাহলে মুসলিম দুনিয়ার ইতিহাস অন্যভাবে গড়ে উঠতো। তা না হওয়াতেই মুসলমানরা আজ সর্বত্র তাগুতী শক্তির করুণার পাত্র।

জন্ম 

৬৬১ হিজরী সালে রবিউল আউয়াল মাসের দশ তারিখ হাররান নামক এক শহরে ইবনে তাইমিয়া (র)-এর জন্ম হয়। তাঁর সাত বছর বয়সে যখন এ শহরটি তাতারীদের আক্রমণের শিকার হয়, তিনি তখন তাঁর পিতার সাথে জন্মভূমি ত্যাগ করে দামেশকে চলে যান। কুরআন হিফজসহ অন্যান্য প্রাথমিক শিক্ষা তিনি ঘরেই লাভ করেন। অতঃপর ইসলামী জ্ঞান-বিজ্ঞানের তৎকালীন প্রাণকেন্দ্র দামেশকের বড় বড় সুদক্ষ উস্তাদদের কাছে তিনি ইসলামী শিক্ষা সমাপ্ত করেন।

তাঁর জ্ঞান,বুদ্ধিমত্তা ও কর্ম-কৌশলের কথা অল্পদিনেই সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে। হাদীসশাস্ত্রে তাঁর পান্ডিত্ব এতই বৃদ্ধি পেয়েছিল যে, জনগণ এই বলে বলাবলি করতো, “ইমাম তাইমিয়া যে হাদীসকে হাদীস বলে জানেনা, তা আদৌ হাদীস নয়”। ইবনে তাইমিয়া সকল সমস্যার সমাধান কুরআনের আয়াতের আলোকে পেশ করতেন। তিনি পূর্ববর্তী যুগের তাফসীরকারকদের কোন ভ্রান্তি থাকলে, তা পরিস্কার ভাষায় তুলে ধরতেন। মাত্র বিশ বছর বয়সে, তিনি এই জ্ঞান বৈদগ্ধ ও দক্ষতা অর্জন করেন। তাঁর কণ্ঠস্বর ছিল গম্ভীর, সরস ও মিষ্ট; ঐতিহাসিক ইবনে কাসীরের মতে “ইবনে তাইমিয়া (র)-এর উপদেশপূর্ণ অপূর্ব ও জ্ঞানগর্ভ বক্তৃতা শুনে অনেক বড় বড় পাপী, আল্লাহ্*দ্রোহীও তওবা করে সৎপথের অনুসারী হয়েছে”। শেখ সালেহ তাজুদ্দীন বলেনঃ আমি ইবনে তাইমিয়া (র)-এর অধ্যাপনা কক্ষে রীতিমতো হাযির হতাম। তিনি বন্যার গতিতে ছুটতেন, খরস্রোতা নদীর মত প্রবাহিত হতেন। শ্রোতামন্ডলী চোখ মুদে স্তব্ধ বসে থাকতো। অধ্যাপনা শেষে তাঁকে অধিক গম্ভীর ও ভয়ঙ্কর মনে হতো অথচ তিনি ছাত্রদের সাথে স্নিগ্ধ হাসি ও খোশ মিজাযে কথা বলতেন। অধ্যাপনার সময় তাঁকে মনে হতো, তিনি এক অদৃশ্য জগতে বিচরণ করেছেন এবং পর মুহূর্তে দুনিয়ার বাস্তব জগতে ফিরে এসেছেন। জীবনের অধিকাংশ সময় কারা-প্রকোষ্ঠে অতিবাহিত করলেও তাঁর স্বল্পকালীন শিক্ষকতার যুগে ছাত্রদের সংখ্যা কয়েক হাজারে দাঁড়িয়েছিল। তাঁর কয়েকজন ছাত্র যারা ছিলেন বিদ্যায়, জ্ঞানে,প্রতিভায়, কর্মদক্ষতায় ও চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যে তৎকালীন বিশ্বের সর্বশ্রেষ্ঠ ব্যক্তিত্ব। যেমন, আল্লামা ইবনে কাইয়্যেম,আল্লামা যাহবী, হাফিজ ইবনে কাসীর, হাফিজ ইবনে কুদামাহ, কাযী শরফুদ্দীন, শায়খ শরফুদ্দীন প্রমুখ মনীষীর নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।

আরবী ভাষায় গ্রীক দর্শনের অনুবাদ শুরু হয় হিজরী দ্বিতীয় শতকে। তখন থেকে মুসলিম সমাজের উপর গ্রীক দর্শনের বস্তুবাদী মর্মবাদের প্রভাব পড়ে। ফলে মানুষ খাঁটি ইসলামী জীবন দর্শনের দৃষ্টিভঙ্গি হারিয়ে বস্তুবাদী দৃষ্টিভঙ্গির আলোকে সকল কিছু চিন্তা করতে শুরু করে। আব্বাসীয় রাজত্বের শুরুতে এ যুক্তিবাদী আন্দোলন অন্ধ আবেগের রূপ নেয়। এই মু’তাযিলাবাদ “খালকে কুরআনের” ন্যায় তুমুল ঝগড়ার উৎপত্তি করে। মুতাযিলাবাদ কুরআন পন্থীদেরকে গ্রীক দর্শনের দুর্জয় প্রভাবে পরাজিত করেছিল। “কালাম শাস্ত্র” মুসলিম সমাজকে সূক্ষ্ম মানতিকী আলোচনায় ব্যস্ত রেখে বাস্তব কর্মজগত থেকে একেবারে গাফিল করে দিচ্ছিল।

ইমাম ইবনে তাইমিয়া (র) মুসলিম দুনিয়াকে এ অবাঞ্ছনীয় অর্থহীন গুমরাহীর পথে ধাবিত হতে দেখে এর বিরুদ্ধে কলম ধারণ করেন। ৬৯৮ হিজরীতে তিনি একটি কিতাব লিখে “মুতাকাল্লেমীন”-এর আকীদা ও ধ্যান-ধারণার তীব্র সমালোচনা করেন এবং একে বাতিল প্রমাণ করে কুরআন ও সুন্নাহর নির্ভেজাল আদর্শকে অকাট্য যুক্তি-প্রমাণ দ্বারা প্রতিষ্ঠিত করেন। এ গ্রন্থ ভ্রান্ত মতাবলম্বীদের বুকে তীরের আঘাত হানে। এ কিতাবের দ্বারা তিনি চিন্তা জগতে এক নতুন বিপ্লব নিয়ে আসেন। এর কারণেই তাঁর নির্যাতনমূলক জীবনের সূচনা ঘটে।

ইমামের মতবাদ সম্পর্কে মিসরের শাসনকর্তা নাসের শাহের নিকট বিভিন্ন অভিযোগ উত্থাপিত হলে ৭০৫ হিজরীতে তিনি দামেশকের গভর্নরকে স্থানীয় আলিমদের একটি মজলিস ডাকার ও ইমামের মতবাদ পরীক্ষা করে দেখার নির্দেশ দেন। একাধিক বৈঠকে ইমামের মতই প্রাধান্য লাভ করে।

সূফীদের নাম ভাঙ্গিয়ে ভন্ডপীর-ফকীর-দরবেশের পেশাধারী একশ্রেণীর লোক যেমন আজকাল অর্থোপার্জন করে এবং তাদের কাছে অসংখ্য মানুষ ভিড় জমায়, তৎকালেও মুসলিম সমাজ এ ফিত্*নায় কম ভারাক্রান্ত ছিল না। আহ্*মদিয়া ও নিসারিয়া ফকীর সম্প্রদায় দুটির একটি যুক্ত দল ইমাম ইবনে তাইমিয়া (র)-এর বিরুদ্ধে দামেশকের গভর্নরের কাছে তিক্ত সমালোচনা করলে, তিনি তাঁকে ডেকে পাঠান। ইমাম অকুতভয়ে জবাব দেন, এ ফকীরদের দু’তি দল রয়েছে- (১) একটি পরহিযগারী, সাধুতা, নৈতিকতা ও দারিদ্র্যের কারণে প্রশংসার যোগ্য। তবে এদের অধিকাংশই ভন্ড ফকীর। শিরক, বিদ’আত ও কুফুরী ধারণার পংকিলতায় নিমজ্জিত। ইসলামের মৌল শিক্ষা কুরআন-হাদীসকে পরিত্যাগ করে মিথ্যা ও প্রতারণাকেই জীবনের সম্বল করে নিয়েছে। এরা দুনিয়ার মূর্খ মানুষগুলোকে ধোঁকা দিয়ে নানা প্রকার বিদ’আত, শিরকের জালে জড়িত করে। নিজেদের পকেট ভর্তির জন্য সদাসর্বদা সাধুতার ভান করে থাকে। নিজেদের চারি পাশে এমন এক বিষাক্ত পরিবেশের সৃষ্টি করে নেয় যে, যারাই তাদের সংস্পর্শে যেতো, তাদের মানসিক গোলামে পরিণত হতো। নিজেদের পকেট উজাড় করে সেই বিদ’আতী ফকীরদের পদমূলে সর্বস্ব ঢেলে দিত।

ইমামকে মিসরে তলব

ইমামদের সত্য ভাষণে গভর্নর নিরব থাকলেও অন্যদের পক্ষ থেকে গোপনে তাঁর বিরুদ্ধে ভীষণ চক্রান্ত চলে। নাসরুল্লাহ মুঞ্জী মিসরের রাজন্যবর্গকে ইমামের বিরুদ্ধে ক্ষেপিয়ে তোলে। তাঁরা দামেশকের গভর্নরের কাছে লিখে পাঠায় যেন ইমামকে মিসরে পাঠানো হয়। গভর্নর জবাবে বললেনঃ তাঁর সাথে দু’বার আমার সাক্ষাৎ ঘটেছে কিন্তু তাঁর মতবাদে কোন দোষ পাইনি। অবশ্য পরবর্তীতে তাঁর প্রতি নির্দেশ এলো, “ভালো চাওতো শাহী ফরমান অনুযায়ী কাজ করতে দ্বিধা করো না”। গভর্নর মজবূর হয়ে ইমামকে মিসর পাঠান।

৭০৫ হিজরীতে ১২ই রমযান সোমবার ইমাম ইবনে তাইমিয়া (র) দামেশক থেকে বের হলে শহরবাসী তাঁর পেছনে পেছনে তিন মাইল পর্যন্ত গিয়েছিল। বিদায় সম্বর্ধনা আগত অশ্রুসিক্ত নয়নে ইমামের প্রতি তাকিয়ে থাকে।

মিসরে পৌঁছে তিনি কায়রো শহরে শুক্রবার দিন একটি কেল্লার অভ্যন্তরে প্রধান বিচারপতি ও রাজদরবারীদের এক সমাবেশে তাঁর মতামত নির্ভীকচিত্তে বর্ণনা করেন। কিন্তু তারপরও তিনি রেহাই পাননি। অন্য মিথ্যা অভিযোগে তাঁকে আটক রাখা হয়। ৭০৭ হিজরীতে তিনি মুক্তি পান। অতঃপর তিনি জামেয়াতুল হিকাম-এর মসজিদে জুমার নামায পড়ান এবং প্রায় ৪ ঘন্টা- ‘ইয়্যাকা না’বুদু ওয়া ইয়্যাকা নাস্তাঈন’- (অর্থাৎ “একমাত্র তোমারই দাসত্ব করি আর একমাত্র তোমার কাছেই সাহায্য কামনা করি”।) আয়াতের তাফসীর বর্ণনা করেন। এভাবে মিসরে কিছু দিন থেকে তিনি তাঁর মতাদর্শ (ইসলাম) প্রচার করতে থাকেন এবং যাবতীয় ভ্রান্ত মতবাদের সমালোচনা ও প্রতিবাদ করতে লাগলেন। মুহীউদ্দীন ইবনে আরাবীর অদ্বৈতবাদের ভ্রান্তি স্বপ্রমাণ তুলে ধরতে লাগলেন। কিন্তু বিরুদ্ধাবাদীদের জন্যে এটা ছিল অসহ্য। সূফী তাজুদ্দীন সাধারণ মানুষকে সভা-সমিতির মাধ্যমে ক্ষেপিয়ে তুলে তাঁর বিরুদ্ধে কতিপয় অভিযোগ আনেন এবং সরকারের নিকট তাঁর শাস্তি বিধানের দাবী তোলেন। সরকার তখন তাঁকে প্রথমে নজরবন্দী এবং পরে কারাগারেই আবদ্ধ করে রাখেন। কারা-জীবনেও তিনি বসে থাকেননি। নানান প্রকার অবৈধ খেল-তামাশা ও লক্ষ্যহীন জীবনবোধে লিপ্ত কয়েদীদের মধ্যে তিনি ইসলামের শিক্ষা দান কাজ শুরু করেন। তাদের নামাযী ও চরিত্রবান করে তোলেন। এতে জেলখানার পথহারা মানুষগুলো মনুষ্যত্বের সন্ধান পায়।

কারা প্রকোষ্ঠে ইমাম ইবনে তাইমিয়া

শত্রুরা ইমাম ইবনে তাইমিয়া (র)-এর এ কাজের টের পেয়ে ষড়যন্ত্র করে তাঁকে আলেকজান্দ্রিয়ার জেলে স্থানান্তর করে। এখানে একটি দুর্গে ১৮ মাস থাকাকালে একাধিকবার তাঁর মৃত্যুর গুজব ছড়িয়ে পড়ে, যাতে মুসলিম জাহানের লোকেরা কেঁদে কেঁদে অস্থির হতো। ৭০৯ হিজরীতে বাদশাহর হুকুমে তিনি মুক্তি পেয়ে আলেকজান্দ্রিয়া থেকে কায়রো রওনা দিলে স্থানীয় জনগন এক বিরাট মিছিল করে তাঁকে অনেক দূর পর্যন্ত এগিয়ে দেন এবং তাঁর জন্য দোয়া করেন। কায়রোর মাশহাদ-এ তিনি অবস্থান কালে কুরআন-হাদীস ও ইসলামী জ্ঞান-বিজ্ঞান প্রচারে আত্মনিয়োগ করেন।

এ সময় (৭১১ হিঃ) জামে মসজিদে প্রতিপক্ষীয় একদল লোক এসে ইমামের উপর হামলা করে এবং তাঁকে এক নির্জন ঘরে আটক করে নির্মমভাবে প্রহার করে। শহরে এ খবর ছড়িয়ে পড়লে তাঁর নিকট লোকজন দলে দলে দৌড়ে আসে এবং অভিপ্রায় ব্যক্ত করে যে, হুযূর অনুমতি দিলে গোটা মিশর সহর জ্বালিয়ে দেব। কিন্তু তিনি কোনরূপ প্রতিশোধ না নিয়ে বরং বললেনঃ আমি তাদের ক্ষমা করে দিলাম। এরপরও তিনি অনেক দিন মিসরে থেকে পরে বায়তুল মুকাদ্দাস সফর করে স্বদেশ ভূমি দামেশকে ফিরে আসেন। জনগণ আনন্দে মিছিল করে তাঁর আগমন সম্বর্ধনা জানায়।

Manual2 Ad Code

স্বদেশ ভূমি দামেশকে প্রত্যাবর্তন

দামেশকে আসার পর তিনি দীনী শিক্ষা বিস্তার, গ্রন্থ প্রণয়ন ও মানব সেবামূলক কাজে হাত দেন। তাঁর নির্ভীক কর্মতৎপরতা ও স্পষ্ট ভাষণে কায়েমী স্বার্থবাদী কুসংস্কারাচ্ছন্ন লোকদের গা-জ্বালার সৃষ্টি হয়। তারা আবার সরকারের কাছে অভিযোগ আনলে এ মর্মে সরকারী ফরমান জারী হয় যে, ইবনে তাইমিয়া আর কোন ফতোয়া জারী করতে পারবেন না।

Manual7 Ad Code

কিন্তু ইমাম বললেন, “ সত্য গোপন করা আমার পক্ষে সম্ভব নয়”। তাঁর পক্ষ থেকে সরকারী ফরমানের এহেন বিরুদ্ধাচরণে ৭২০ হিজরীতে ‘দারুস্* সাদাত’ –এ অনুষ্ঠিত এক অধিবেশনে ইমামকে পুনরায় বন্দী করার সরকারী ফরমান জারী হয়। তখন তিনি পাঁচ মাস আঠার দিন পর্যন্ত দুর্গে বন্দী ছিলেন। এক বছর পর তাঁকে মুক্তি দেয়া হলে তিনি সেই পুরাতন কাজ শুরু করেন। ইমাম জ্ঞান প্রসারের কাজে নিমগ্ন হন। তিনি দেখলেন, বহু বুযুর্গের কবর পূজা হচ্ছে। মকসূদ হাসিলের জন্য হাজার হাজার মানুষ কবরে শায়িত বুযুর্গদের কাছে প্রার্থনা জানাবার জন্যে দলে দলে ছুটে আসছে। ইমাম ইবনে তাইমিয়া ৭২৬ সনে ফতোয়া জারী করলেন যে, “ কবর যিয়ারত করার নিয়তে দূর দেশ সফর করা জায়েয নয়। এ ফতোয়া জারীর পর তাঁর বিরুদ্ধে দেশব্যাপী উত্তেজনার সৃষ্টি হয়। বিরুদ্ধবাদীরা বড় বড় সভা করে তাঁর বিরুদ্ধে আগুন ঝরা বক্তৃতা দেয়। মানুষকে ক্ষেপিয়ে তোলে। কেউ বলে জিহ্বা কেটে দিতে হবে, কেউ বলে চাবুক মারতে হবে। কারও মত হলো যাবজ্জীবন কারারুদ্ধ করে রাখতে হবে। একদল মিসরের বাদশাহ্*র কাছে দাবী তুলল, তাঁকে যেন কতল করা হয়। পরে সরকার তাঁকে কারারুদ্ধ করার সিদ্ধান্ত নেয়। গ্রেফতারকারি পুলিশ তাঁর নিকট গেলে তিনি সহাস্যে তাদের সাথে কারাগারে চলে যান। বাগদাদে এ খবর পৌঁছুলে সেখানকার তদানীন্তন শ্রেষ্ঠ আলিমগণ ইমামের ফতোয়াকে ইসলামের মূল ভাবধারার সাথে সামঞ্জস্যশীল বলে তাঁর প্রতি সমর্থন জানায়। তাঁরা বাদশাহর কাছে দু’খানা চিঠি পাঠান। ঐ সকল চিঠির সারমর্ম হলোঃ ইমাম ইবনে তাইমিয়া যুগশ্রেষ্ঠ শতাব্দীর মুজতাহিদ ইসলামী মিল্লাতের নেতা, পৃথিবীর সাত একলীমের ধনভান্ডারও তাঁর মূল্য দিতে অক্ষম। আশ্চর্যের বিষয় যে, জাতির এ কর্ণধার যেখানে রাজপ্রাসাদের থাকার কথা, তাঁকে রাখা হয়েছে কারাগারে। তাঁর প্রতি ভিত্তিহীন দোষারোপ করা হয়েছে। তাঁকে আশু মুক্তি দেয়া উচিত।

Manual6 Ad Code

ইরাকীরা ইমামের কারা-নির্যাতনের কথা শুনলে সারা দেশে অন্তর্বেদনার প্রচন্ড আগুন জ্বলে উঠে। আলিমদের সম্মিলিত এক ঘোষণায় বলা হয়, ইমাম ইবনে তাইমিয়ার বক্তব্য সন্দেহাতীতভাবে সত্য। সুতরাং শায়খুল ইসলামকে দীনের খিদমতের জন্য মুক্তি দেয়া হোক। তাতে বিশ্ব-মুসলিমের প্রতি বিরাট অনুগ্রহ করা হবে। বাগদাদের শ্রেষ্ঠ ওলামা-এ-কিরামের এ চিঠি মিসর বাদশাহ্*র দরবার পর্যন্ত পৌঁছতে পারেনি কিংবা পৌঁছুলেও তা এমন সময় যে, তখন ইসলামী দুনিয়ার শতাব্দীর এ উজ্জ্বল সূর্য অস্তমিত হয়ে গেছে। ইসলামের জন্য নিবেদিত প্রাণ মর্দে মুজাহিদ শায়খুল ইসলাম ইমাম ইবনে তাইমিয়া চিরদিনের তরে এ দুনিয়া থেকে বিদায় নিয়ে গেলেন।

শায়খুল ইসলাম ইমাম ইবনে তাইমিয়া (র) জীবনের শেষ দিনগুলো কারাগারে ইবাদত বন্দেগী, কুরআন তিলাওয়াত ও এর গবেষণাইতেই কাটাতেন। শেষবারে ইমাম দীর্ঘ তিন বছর তিন মাস কালেরও বেশি দিন কারারুদ্ধ ছিলেন। কারাগারের এ নিষ্ঠুর বন্দী জীবনও কেটেছে তাঁর অসংখ্য মৌলিক ও মূল্যবান গ্রন্থ রচনায়।

 

ইসলামের শিক্ষা আদর্শ থেকে বিচ্যুতির ফলে সপ্তম ও অষ্টম শতাব্দীতে মুসলমানদের উপর আল্লাহ্*র গযব রূপে তাতারীদের যেই হামলা আসে, তখনও মুসলিম বিশ্বে অসংখ্য আলিম ছিলেন, পীর-মাশায়েখ ছিলেন। কিন্তু আরাম-আয়েশ বাদ দিয়ে এ মহাবিপিওদের মুকাবিলা করা এবং মুসলিম জনতাকে সংগঠিত করার মতো লোক খুব কমই ছিল। উদ্ভাবনী জ্ঞান দিয়ে সে দায়িত্ব পালন করেছিলেন একমাত্র ইমাম ইবনে তাইমিয়া (র)। ইসলাম মানব জীবনের সকল ক্ষেত্রে একটি বিপ্লবের আহ্বান নিয়ে এসেছে- বাতিলের সাথে মিতালি করে চলার জন্যে নয়, ইমাম ইবনে তাইমিয়া অসহ্য কষ্ট-নির্যাতনের মধ্যদিয়ে তারই প্রমাণ রেখে গেছেন। আল্লাহ্*র দীন প্রতিষ্ঠাকল্পে বাতিলের বিরুদ্ধে লেখা, বক্তৃতা ও প্রয়োজনে অস্ত্রধারণ করেছেন এবং কষ্ট ত্যাগের মধ্যদিয়েও কি করে ঈমানী পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে হয়, ইমাম ইবনে তাইমিয়ার সংগ্রামী জীবন উন্মুক্ত গ্রন্থতুল্য এরই এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত।

Manual8 Ad Code

Spread the love

Manual1 Ad Code
Manual5 Ad Code