মুফতি মাওলানা গোলাম মোস্তফা ইলাইগঞ্জী দা.বা. এর সংক্ষিপ্ত জীবনী

July 14 2020, 09:37

qowmipedia.com,

লিখেছেন- মুফতি আহমাদ রাফি জাকির

জন্ম: আধ্যাত্মিক নগরী সিলেটের গোলাপগঞ্জ থানার দক্ষিণ মদনগৌরি গ্রামের দীনদার সম্ভান্ত পরিবারে মরহুম মৌলভী আব্দুল আহাদের ঔরসে ১৯৪৭সালের ০৭ মার্চ শুক্রবার দিনে জন্মগ্রহণ করেন মুফতি গোলাম মোস্তফা সাহেব হাফিজাহুল্লাহ। শিক্ষাজীবনের শুরু: তাঁর প্রাথমিক পড়ালেখা শুরু হয় নিজ বাড়িতেই পিতামাতার নিকট।

পিতা ছিলেন নিজ এলাকার সম্মানীয় ব্যক্তি, তাঁর কাছে নজরানা থেকে শুরু করে কুরআন শরীফ পর্যন্ত পড়েন। তারপর ০৬ বছর বয়সে ইলাইগঞ্জ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার মাধ্যমে তার প্রাতিষ্ঠানিক লেখাপড়ার সূচনা হয়।

এখানে ৫ম শ্রেণী পর্যন্ত সুনামের সাথে পড়াশুনা করেন। এরপর রাখালগঞ্জ দারুল কুরআন আলিয়া মাদরাসায় ভর্তি হন, তখন এটি একটি প্রসিদ্ধ কওমি মাদরাসা ছিল। হযরত শায়খ মোফাজ্জল আলী সিকন্দরপুরী রাহ. ছিলেন মুহতামিম। রাখালগঞ্জে ০৩ বছর পড়ালেখা করে ১৩৮০ হিজরীতে ঐতিহ্যবাহী জামিয়া তাওয়াক্কুলিয়া রেঙ্গায় সাফেলা তৃতীয় বর্ষে ভর্তি হোন।

লেখাপড়ায় মনোযোগিতা ও মেধার কারণে অল্পদিনেই আসাতেযায়ে কেরামের আস্তাভাজন হয়ে যান। ১৩৮৮ হিজরীতে জামেয়া তাওয়াক্কুলিয়া রেঙ্গায় দাওরায়ে হাদিসের জামাত খোলা হলে তিনি ও জামেয়া রেঙ্গার মুহতামিম [সরপরস্ত] হযরত মাও. শামসুল ইসলাম খলিল হাফি.-সহ আরও অনেকে প্রথম ব্যাচের বিদায়ী কাফেলার সৌভাগ্যবান সাথী হওয়ার গৌরব অর্জন করেন। অধ্যাপনাজীবনের সূচনা ও ইলম অর্জনে দূরগমন: দাওরায়ে হাদীস সম্পন্ন করার পর তার প্রিয় উস্তায ও মুর্শিদ হযরত শায়খে রেঙ্গা রাহ.-‘র নির্দেশে ১৩৮৮-১৩৮৯ হিজরীতে তিনি জামেয়া তাওয়াক্কুলিয়া রেঙ্গার শিক্ষক নিযুক্ত হোন।

এক বছর শিক্ষকতার পর নিজ উস্তাদবৃন্দের পরামর্শক্রমে উচ্চশিক্ষা লাভের উদ্দেশ্যে জামেয়া আল-উলূম আল-ইসলামিয়া আল্লামা বানুরী টাউন করাচি পাকিস্তানের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হন। করাচিতে প্রথম বছর দাওরায়ে হাদিসে ভর্তি হন এবং খাতিমাতুল মুহাদ্দিসীন আল্লামা ইউসুফ বানুরী রাহ.-‘র কাছে সমগ্র বুখারী শরীফ অধ্যয়ন করেন।

আল্লামা ইদ্রিস মিরাঠির কাছে মুসলিম শরীফ, মাও. ওলী হাসান টুঙ্কী রাহ.-‘র নিকট তিরমীযী শরীফ, হযরত মাও. ফজল মুহাম্মদ রাহ.-‘র কাছে আবু দাউদ শরীফ এবং আরও খ্যাতিমান মুহাদ্দিসীনে কেরামদের নিকট কৃতিত্বের সাথে হাদীস অধ্যয়ন করেন। ইফতায় দাখেলা ও জামিয়া করাচির কাসুন্দি: সেখানকার সময় করাচি বানূরী টাউনে ইফতা বিভাগ বা উচ্চতর ইসলামি আইন শাস্ত্রে ভর্তি হওয়া খানিক দুরূহ ছিল। অধিকতরো যোগ্য ও মেধাবীরা পরিশ্রম ও প্রচুর কিতাব অধ্যয়নের মাধ্যমে সেই চান্স গ্রহণ করতে পারতো। হুজুরও এই নিয়মের বাইরে ছিলেন না।

ভর্তি পরিক্ষার প্রস্তুতির জন্য তাঁকে বলা হয়েছিল, মাযহাবের কিতাবাদি অধ্যয়ন করে যেসব মাসআলায় ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল ও ইমাম আবু হানিফা রাহ.’র মাযহাবের সাথে মিল রয়েছে ওই মতগুলো দলিলসহ সংকলন করে সবিস্তারে একটি মুয়াফাকাত (প্রবন্ধ) তৈরি করার জন্য। তিনি প্রায় চার’শ পৃষ্ঠার একটি মুয়াফাকাত রচনা করেন। আপন মেধার দ্যূতি ও মহান রবের ফজলে ঈর্ষনীয় ফলাফল অর্জিত হয় এবং জামিয়া করাচির কুল্লিয়াতে ফাতাওয়ায় দাখেলা নেন। তখন করাচি জামেয়া আল-উলূম আল-ইসলামিয়ার প্রধান মুফতি ও মুশরীফ ছিলেন শায়খুল ইসলাম হুসাইন আহমদ মাদানি রাহ.-‘র অন্যতম শাগিরদ আল্লামা মুফতি ওয়ালী হাসান টুঙ্কী রাহ.।

তিনি খ্যাতির সঙ্গে সেখানে দু’বছর ইফতায় পড়ালেখা করেন। কর্মজীবনের ধুরন্ধর গলিঘুপচি: করাচি পাকিস্তান থেকে শিক্ষা সমাপন করে ১৩৯৩ হিজরীর রমজানে দেশে ফিরেন। রমজানের পর পুনরায় নিজ আসাতেযায়ে কেরামের নির্দেশে জামিয়া তাওয়াক্কুলিয়া রেঙ্গার শিক্ষক হিসাবে নিয়োগ পান। জামেয়া রেঙ্গায় এ যাবত মুসলিম শরীফ আউয়াল, তিরমিযি শরীফ সানী, আবু দাউদ শরীফ ও সিরাজীসহ আরও মু’তাবার কিতাবাদি দরস দিয়ে যাচ্ছেন।

আল্লামা আনওয়ার শাহ কাশমিরি রাহ.-‘র ইলিম ও মাআরিফের আমিন, যিম্মাদার আল্লামা ইউসুফ বানুরি রাহ.-‘র হাতেগড়া শাগিরদ মুফতি গোলাম মোস্তফা হাফি. অধ্যাপনাজীবনের সূচনা থেকে প্রায় চার যুগের বেশি সময় ধরে ধারাবাহিকভাবে ঐতিহ্যবাহী জামেয়া তাওয়াক্কুলিয়া রেঙ্গায় সহীহ মুসলিম শরীফের দরস দিয়ে যাচ্ছেন। তার পাঠদান পদ্ধতি তুলাবা-আসাতিযা সর্বমহলে প্রশংসিত হয়ে আসছে। শিক্ষাদানের পাশাপাশি বিখণ্ড সময় উক্ত জামিয়ার গুরুত্ববহ অনেক দায়িত্ব আঞ্জাম দেন। প্রথমে জামেয়ার কুতুবখানার নাজিম হিসেবে তার দায়িত্বপালনের সূচনা হয়।

পরবর্তীতে নাজিমে দারুল ইকামা এবং ক্রমান্বয়ে ১৩৯৯ হিজরীতে সহকারী নাজিমে তা’লিমাতের দায়িত্ব ও পরবর্তিতে ১৪০৪ হিজরী থেকে বর্তমান পর্যন্ত নাজিমে তা’লীমাতের দায়িত্ব সুপরিকল্পনা, পরিপাটি ও দূরদর্শিতার সাথে পালন করে আসছেন। চারিত্রিক হাল-হকিকত ও সংসার-জীবনের জানালা: সাংসারিক জীবনে হযরত মুফতি সাহেব পাঁচ ছেলে ও দু’মেয়ে সন্তানের জনক। দীনঘনিষ্ঠ এ পরিবারের চার ছেলে হাফেজ, একজন শিক্ষারত বাকি তিনজনই আলেম হয়ে দীনের খেদমতে নিয়োজিত। চতুর্থ ছেলে মাওলানা যাকী আহমাদ জামেয়া রেঙ্গায়ই শিক্ষকতা করছেন। বর্তমানে তিনি বয়সজনিত বিভিন্ন রোগে ভোগছেন।

শারিরীক দুর্বলতার দরুন চলাফেরায়ও সতর্কতা রাখতে হয়। এরপরও সর্বদা মুতা’লাআ ও অধ্যয়নের কাজে মনোনিবেশরত থাকেন। তিনি সহজ-সরল ও দরবেশি জীবন যাপনে অভ্যস্ত। দুনিয়ার শান- শওকত, যশ-খ্যাতি-বিমুখ ও অমায়িক ব্যবহারের অধিকারি। আকাবির-আসলাফের আদর্শকে লালন করেন জীবনের বিখণ্ড ক্ষেত্রে তিনি উস্ওয়ায়ে হাসানাহ ও সীরাতে রাসুলের এক বাস্তব নমুনা। জামেয়ার ফারিগিন ফুযালায়ে কেরামদের প্রায়ই নসীহা করে থাকেন, শামায়েলে তিরমিযি মুতালাআ করে রাসূলে আরাবি সা.-‘র সুন্নাত জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে বাস্তবায়নের জন্য। আল্লাহ তাঁকে ইহ ও পরকালে সম্মানিত করুন, খায়ের ও মঙ্গলের বিবিধ পুরস্কারে ঝলসিত করুন, আমিন। লেখক: মুহাদ্দিস, জামিয়া আবু হুরায়রা রাযি., সিলেট।