হজ্জ ও উমরাহ প্রসঙ্গে কিছু গুরুত্বপূর্ণ অভিজ্ঞতা

October 26 2019, 03:41

qowmipedia.com,
  

ইহরাম প্রসঙ্গ ঃ

অনেককে দেখা যায় অজ্ঞতা কিংবা অসাবধানতাবশতঃ ইহরামের কাপড় বড় লাগেজে দিয়ে দেয়। ফলে ইহরামের কাপড় সাথে না থাকায় তারা বিমানবন্দরে বা মীকাত অতিক্রম করার আগে ইহরাম বাঁধে না। যদ্দরুণ তাদের উপর ‘দম’ ওয়াজিব হয়ে যায়।

তারা মনে করে ইহরামের কাপড় ছাড়া ইহরাম বাঁধা যায় না, অথচ ইহরাম সহীহ হওয়ার জন্য ইহরামের কাপড় পরিধান করা কোনো শর্ত নয়; বরং ইহরামের জন্য অত্যাবশ্যকীয় বিষয় কেবল দু’টি: এক. উমরাহ বা হজের নিয়ত করা। দুই. তালবিয়া পড়া। হ্যাঁ, এটা ঠিক যে, ইহরাম অবস্থায় শরীরের গঠনে কাপড় পরিধান করা নিষেধ।

কাজেই যারা এ ধরণের সমস্যায় পড়বে, তারা সাধারণ কাপড় পরিহিত অবস্থায় বিমান, মীকাত অতিক্রম করার ঘোষণা দেয়ার পূর্বমূহুর্তে উমরার নিয়ত করে তালবিয়া পড়ে নিবে। এর দ্বারাই ইহরাম হয়ে যাবে। তারপর জেদ্দা বিমানবন্দরে লাগেজ হাতে পাওয়ার পর সাধারণ পোশাক খুলে ইহরামের সিলাইবিহীন লেবাস পরে নিবে।

বিমানে ইহরাম বাঁধার পর জিদ্দায় অবতরণপূর্বক লাগেজ হাতে পেয়ে পরিহিত সিলাইযুক্ত কাপড় খুলে ফেলতে যতটুকু সময় অতিবাহিত হয়, তাতে দম ওয়াজিব হবে না। কেননা, ইহরাম বাঁধার পর বার ঘণ্টার কম সময় সাধারণ সিলাইকৃত কাপড়ে থাকলে দম ওয়াজিব হয় না। (রদ্দুল মুহতার ৩/৫৭৭ যাকারিয়া)

ঢাকা থেকে সরাসরি মক্কাগামী হাজীদের বিমান সাধারণত জিদ্দায় অবতরণের ২০-২৫ মি. আগে মীকাত অতিক্রম করে থাকে। অনেক বিমানে ঘোষণাও করা হয় যে, বিমান আর দশমিনিট পর মীকাত অতিক্রম করবে। এটাই ইহরাম ছাড়া মীকাত অতিক্রম করার দম থেকে বাঁচার শেষ সময়। তখনও যদি কেউ ইহরাম বেঁধে নেয় তাহলে তাকে দম দিতে হবে না।

সফর প্রসঙ্গ

১. মনে রাখতে হবে যে, বিমানের মধ্যে এবং  লাগেজ হাতে পাওয়ার আগ পর্যন্ত যে-সব জিনিষ প্রয়োজন হবে (যেমন: গামছা, জায়নামায, ঔষধ, কিছু শুকনা খাবার ইত্যাদি) সেগুলো নিজের সাথে রাখবে অর্থাৎ হাত ব্যাগে রাখবে। যাতে পথে কোনো অসুবিধা না হয়।

২. জিদ্দায় পৌঁছার পর প্রথমে ইমিগ্রেশন পার হতে হয়। ইমিগ্রেশনের পর সামান্য একটু সামনে এগুলেই সামানপত্র বুঝে নেওয়ার স্থান। কর্তৃপক্ষ বিমান থেকে লাগেজ নামিয়ে সেখানে জমা করতে থাকে। সেখান থেকে নিজের লাগেজ বুঝে নিতে হবে।  তারপর একটু সামনে অগ্রসর হলেই কাস্টম চেকইন। সেখানে মেশিনে চেক করানোর পর দরজার কাছে গেলে কুলিরা লাগেজ তাদের গাড়িতে তুলে নিবে। অপরদিকে মুআল্লিমের লোকেরা পাসপোর্টে বাস ভ্রমণের টিকিট লাগিয়ে দিবে। টাকা পয়সা টিকিট ইত্যাদি নিজের গলায় ঝুলানো ব্যাগে রাখবেন। এ পর্যন্ত বিমানবন্দরের কাজ শেষ।

৩. এখন বাসে চড়ে গন্তব্যস্থলে যাওয়ার জন্য আপনাকে পায়ে হেঁটে সামান্য দূরে বাংলাদেশ হজ্জমিশনের স্থানে (দরজা থেকে বের হয়ে ডান দিকে) পৌঁছতে হবে এবং কুলিরা মাল আনার পর নিজের লাগেজ বুঝে নিতে হবে। তারপর বাসে উঠার আগ পর্যন্ত নিজের দেশের জন্য নির্ধারিত স্থানে অপেক্ষা করতে হবে। বিশাল তাবুসদৃশ অপেক্ষার ঐ জায়গাকে ‘হজ্জ ক্যাম্প’ বলে। সেখানে উযূ ইস্তিঞ্জা ও নামাযের সুব্যবস্থা আছে।

৪. আশে-পাশে সৌদির বিভিন্ন মোবাইল কোম্পানির সীম পাওয়া যায় এবং প্রত্যেকটি সীমে মূল্যের সমপরিমাণ ফ্রি কথা বলার সুযোগ থাকে। সেখানে বিভিন্ন রকমের খাবারও পাওয়া যায়।

৫. ইমিগ্রেশন থেকে নিয়ে বাসে উঠা পর্যন্ত দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করতে হতে পারে। এ কারণে কেউ যেন অধৈর্য না হয়। প্রত্যেকের চিন্তা করা দরকার যে, বিমান আবিস্কার হওয়ার আগে মানুষ কত কষ্ট করে হজ্জ করতো। হজ্জের সফরে কয়েক মাস সময় লেগে যেত। পথে হাজারো বালা-মুসীবত ও বিপদ-আপদের সম্মুখীন হতে হত। আর এখন আল্লাহ তাআলা কতো সহজ করে দিয়েছেন। মাত্র কয়েক ঘণ্টার মধ্যে হজ্জ যাত্রী সুদূর বাংলাদেশ থেকে মক্কায় পৌঁছে যাচ্ছে। এরপর সামান্য দেরির কারণে অধৈর্য হওয়া মোটেই সাজে না। অপেক্ষার সময়ে অধৈর্য না হয়ে যিকির আযকার করতে থাকবে। ইহরামের অবস্থায় থাকলে বেশি-বেশি তালবিয়া পড়তে থাকবে, তবে তালবিয়া দলবদ্ধভাবে পড়া ঠিক নয়।

৬. বাসে উঠার পূর্বে লাইনে দাঁড়াতে হয়। মুআল্লিমের লোকেরা বার বার লোক সংখ্যা গুনে এবং পাসপোর্ট নিয়ে নেয়। এরপর দেশে ফেরার জন্য জেদ্দায় আসা পর্যন্ত পাসপোর্ট মুআল্লিমের লোকদের কাছে থাকে। আর বাস ভ্রমনের সময় পাসপোর্ট ড্রাইভারের দায়িত্বে থাকে। হজ্জ শেষে যখন দেশে ফেরার জন্য জেদ্দায় পৌঁছে তখন পাসপোর্ট ফেরত দেওয়া হয়। এর আগে পাসপোর্ট দেওয়া হয় না।

৭. মক্কায় পৌঁছার পর প্রথমে মুআল্লিমের অফিসে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখান থেকে বিভিন্ন পরিচয়পত্র দেওয়া হয় যা গলায় ঝুলিয়ে রাখতে হয় এবং হাতে পরতে হয়। এসব পরিচয়পত্র যত্নের সাথে গলায় ঝুলিয়ে রাখতে হবে এবং হাতে পরতে হবে।

৮. এরপর হাজীদেরকে তাদের জন্য ভাড়াকৃত বাসা বা হোটেলে নিয়ে যাওয়া হয়। বাসা বা হোটেলে গ্রুপ লিডার যে কামরা দিবে, সেখানে নিজের সিট নিবে।

৯. সিট পাওয়ার পর উমরার জন্য তাড়াহুড়া করবে না বরং ধীরে সুস্থে নিজেকে উমরার জন্য প্রস্তুত করবে। কিছুক্ষন বিশ্রাম নিবে। সম্ভব হলে গোসল করবে। কাপড় পরিবর্তন করে প্রয়োজনে কিছু খেয়ে নিবে। এরপর খোঁজ-খবর নিয়ে যখন ভিড় কম মনে হবে তখন উমরার নিয়তে বাইতুল্লায় রওনা হবে।

তাওয়াফ প্রসঙ্গ

১. ভিড়ের মধ্যে হাজরে আসওয়াদ বরাবর আসতে পেরেছে কি না, তা বুঝার সহজ উপায় হল, মসজিদে হারামের এক দিকে শুধু একটি মিনার আছে (অন্য সকল দিকে জোড়া মিনার।) সেই মিনার থেকে একটু সামনে অগ্রসর হবে। কিংবা ঐ দিকেই মসজিদে হারামের দ্বিতীয় তলায় সবুজ বাতি জ্বলে থাকতে দেখবে, ঐ বাতি বরাবর দাঁড়িয়ে বাইতুল্লাহমুখী হলেই হাজরে আসওয়াদ বরাবর হয়ে যাবে।

২. হাজরে আসওয়াদ বরাবর এসে কয়েকটি কাজ করবে :

  • প্রথমত তাওয়াফের নিয়ত করবে। অর্থাৎ এভাবে বলবে- হে আল্লাহ! আমি উমরার তাওয়াফ করছি। আমার জন্য তা সহজ করে দিন এবং কবুল করে নিন।
  • এরপর নামাযে তাকবীরে তাহরীমা বলার সময় যেভাবে হাত উঠানো হয় সেভাবে উভয় হাতের তালু হাজরে আসওয়াদ ও বাইতুল্লাহর দিকে ফিরিয়ে বলবে-

بسم الله الله اكبر، لااله الاالله و لله الحمد، والصلاة والسلام على رسول الله ـ

শুধু بسم الله الله اكبر বললেও চলবে। (মানাসিক-১৩০)

আজকাল ভিড়ের কারণে যেহেতু হাজরে আসওয়াদের কাছে যাওয়া যায় না, তাছাড়া ওখানে খোশবু লাগানো থাকে তাই ইশারায় হাজরে আসওয়াদ চুমু খাওয়াই ভালো। হাজরে আসওয়াদ বরাবর দাঁড়িয়ে উভয় হাতের তালু হাজরে আসওয়াদের উপর রাখার মতো করে ইশারা করবে। অত:পর তালুতে শব্দ করা ছাড়া চুমু খাবে। কেউ যদি কখনো হাজরে আসওয়াদকে সরাসরি চুমু খাওয়ার সুযোগ পায় তাহলে হাজরে আসওয়াদের উপর দুই হাত রেখে দুই হাতের মাঝে পাথরের উপর নি:শব্দে চুমু খাবে। যদি এভাবে চুমু খেতে না পারে তাহলে সম্ভব হলে হাতদিয়ে স্পর্ষ করে হাতে চুমু খাবে। (মানাসিক-১৩১)

তাওয়াফের সময় যিকির প্রসঙ্গ

১. এমন কিছু যিকির আছে যেগুলো তাওয়াফের সময় আদায় করলে যিকিরের আমলও হয়ে যাবে, সাথে সাথে কত চক্কর হল এবং এখন কততম চক্কর চলছে তাও মনে থাকবে ইনশাআল্লাহ। তবে এগুলোকে সুন্নাত মনে করবে না, শুধু বৈধ মনে করবে। যিকিরগুলোর বিবরণ নিম্মরূপ:

  • ১ম চক্করে سبحان الله পড়তে থাকা।
  • ২য় চক্করে الحمد لله পড়তে থাকা।
  • ৩য় চক্করে لااله الاالله পড়তে থাকা।
  • ৪র্থ চক্করে الله اكبر পড়তে থাকা।
  • ৫ম চক্করে سبحان الله و بحمده سبحان الله العظيم পড়তে থাকা।
  • ৬ষ্ঠ চক্করে যে কোনো সহীহ দুরূদ শরীফ পড়তে থাকা।
  • ৭ম চক্করে যে কোনো ইস্তিগফার পড়তে থাকা।

তবে মনে রাখতে হবে যে, উল্লিখিত যিকিরসমূহ হাজরে আসওয়াদ এবং রুকনে ইয়ামানী-এর মধ্যবর্তী স্থান ব্যতিত বাইতুল্লাহর অন্য তিন দিকে পড়বে। কেননা, রুকনে ইয়ামানি এবং হাজরে আসওয়াদ-এর মধ্যবর্তি স্থানে পড়ার নিমিত্তে নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে বর্ণিত একটি দু‘আ রয়েছে। আর তা হলো :

ربنا اتنا فى الدنيا حسنة وفى الأخرة حسنة وقنا عذاب النار

২.স্মরণ রাখতে হবে যে, তাওয়াফ অবস্থায় কুরআন তিলাওয়াত করা থেকে যিকির করা উত্তম। (আনওয়ারে মানাসেক পৃ.৩৮২)

যমযমের পানি পান প্রসঙ্গ

মাতাফের বিভিন্ন জায়গায় যমযমের পানির ট্যাংক রাখা আছে। কিছু ট্যাংকের গায়ে ‘নট কোল্ড’ লেখা আছে। সেগুলো স্বাভাবিক পানি। আর অধিকাংশ ট্যাংকের গায়ে কিছু লেখা নেই। সেগুলো ঠান্ডা পানি। যেটা স্বাস্থ্যের অনুকূলে হবে সেটা তৃপ্তিসহ পান করবে। তাওয়াফ থেকে ফারেগ হওয়ার পর স্বাভাবিকভাবেই পানির চাহিদা সৃষ্টি হয়। তখন আল্লাহ তা‘আলার হুকুমও পানি পান করা। এভাবে পরম করুণাময় আল্লাহ বান্দার স্বভাবের চাহিদাকে ইবাদাত বানিয়ে দিয়েছেন।

মুলতাযাম প্রসঙ্গ

হাজরে আসওয়াদ এবং বাইতুল্লাহর দরজার মধ্যবর্তি দেয়ালকে ‘মুলতাযাম’ বলা হয়। এ স্থানটিতে দু‘আ কবুল হওয়ার বিষয়টি হাদীসে পাকে এসেছে।

তবে আজকাল প্রচণ্ড ভিড়ের কারণে অন্যকে কষ্ট না দিয়ে মুলতাযামে উপস্থিত হওয়া সম্ভব হয় না। আর অন্যকে কষ্ট দেওয়া যেহেতু হারাম, সুতরাং ভিড়ের মধ্যে অন্যকে কষ্ট দিয়ে মূলতাযামে উপস্থিত হওয়া আদৌ সঙ্গত নয়। তাছাড়া আজকাল কে বা কারা কাবা ঘরের দেয়ালের চতুর্দিকে মানুষের উচ্চতা পরিমাণ আতর লাগিয়ে রাখে। ফলে দেয়াল স্পর্ষ করলেই শরীরে বা কাপড়ে আতর লেগে যায়। অথচ ইহরাম অবস্থায় শরীর বা কাপড়ে যে কোনো ধরণের খোশবু লাগানো নিষেধ। তাই এই আশংকার কারণে বর্তমানে ইহরাম অবস্থায় বাইতুল্লাহ শরীফ স্পর্ষ করা থেকে বেঁচে থাকা উচিত। আর মূলতাযামে উপস্থিত হওয়া এবং বাইতুল্লাহ শরীফ স্পর্ষ করা যেহেতু মুস্তাহাব আমল, তাই উল্লিখিত সমস্যার কারণে তা আদায় করতে না পারলে কোনো ক্ষতি নেই।

সাঈ প্রসঙ্গ

১. তাওয়াফের সাত চক্করে যে সাত ধরণের যিকিরের কথা বলা হয়েছিল, সা‘ঈর সাত চক্করেও সেগুলো আদায় করতে পারেন। এতে যিকির করাও হবে, আবার চক্করের নাম্বারও মনে থাকবে। কোনো ধরণের যিকির না করলেও সা‘ঈ সহীহ হবে।

২. অনেকে সাফা থেকে মারওয়া এবং মারওয়া থেকে সাফা যাওয়াকে এক চক্কর মনে করে, এ ধারণা ভুল। সা‘ঈ করার স্থানটা চার তলা। প্রত্যেক তলায়ই সা‘ঈ করা যায়। তাই বেশি ভীড়ের মধ্যে সা‘ঈ না করে যেখানে ভীড় কম সেখানে সা‘ঈ করা ভালো। সা‘ঈর স্থানে সাফা পাহাড় সংলগ্ন দক্ষিণ দিকে চলন্ত সিঁড়ি আছে, সুতরাং তৃতীয় বা চতুর্থ তলায় উঠতেও কোনো কষ্ট হবে না।

চুল কাটা প্রসঙ্গ

যখন দলের কয়েক জনের সা‘ঈ শেষ হয়ে যাবে, তখন হাজী সাহেবানরা সেলুনে না গিয়ে একজন অন্যজনের চুল কেটে দিতে পারে। অনেকে মনে করে, ‘প্রথমে একজনের সেলুন থেকে চুল কেটে আসতে হবে অত:পর সে অন্যদের চুল কাটতে পারবে!’ এ ধারণা সম্পূর্ণ ভুল ও ভিত্তিহীন। মক্কার বাজারে ১৫০-২০০ রিয়ালে চুল কাটার উন্নত মানের মেশিন পাওয়া যায়, একা কিনতে না পারলে কয়েকজনে মিলে একটা কিনে নিবে। মেশিন কিনে বাসায় বসে চুল কাটবে। এতে খরচও বাঁচবে, আর চুল কাটার সুন্নাতও আদায় করা সম্ভব হবে। তাছাড়া অন্য ভাইকে ইকরামও করা যাবে। চুল কাটার সুন্নত হলো, কেবলামুখী হয়ে বসা, ডান দিক থেকে কাটতে শুরু করা।

মিনায় অবস্থান প্রসঙ্গ

১. বর্তমানে হাজীদের সংখ্যা বেড়ে যাওয়ায় একসাথে সকল হাজীর জন্য মিনায় স্থান সংকুলান হয় না। এ কারণে অনেক হাজীর তাবু মিনা ছাড়িয়ে মুযদালিফার সীমানায় পড়ে যায়। তো এ ক্ষেত্রে মূলকথা হলো, কারো তাবু যদি মুযদালিফার সীমানায় পড়ে যায় তাতেও তার মিনায় অবস্থানের সুন্নাত আদায় হয়ে যাবে। আবার উকূফে মুযদালিফাও ঐ তাবুতে করলেই চলবে। এছাড়া ১০ই যিলহজ্জ সকালে মিনায় যেতে হয় সেক্ষেত্রেও ঐ তাবুতে থাকলেই চলবে। তবে কংকর মারার সময় অবশ্যই মিনায় যেতে হবে।

২. মিনায় প্রায় তিন/ চার বেলা খেতে হয়। এই খাবারের ব্যবস্থা তিনভাবে হতে পারে-

ক. মুআল্লিমকে টাকা দিলে মুআল্লিম খাবার সরবরাহ করে।

খ. কখনো গ্রুপ লিডার খাবারের ব্যবস্থা করে।

গ. মিনায় রাস্তার পাশে অনেক রকমের খাবার কিনতে পাওয়া যায় সেখান থেকে নিজেও খাবার সংগ্রহ করা যায়।

যদি মুআল্লিমের মাধ্যমে খাবারের ব্যবস্থা করতে চায়, তাহলে প্রত্যেক তিনজনে দুইটা খাবারের অর্ডার দিবে। এতে খাবার অপচয় হবে না। আর কম হলে কিনে নিতে পারবে। মুআল্লিমের সরবরাহকৃত খানা পরিমাণে অনেক বেশি হয়ে থাকে, এছাড়া ওখানের খাবার তেমন সুস্বাদু নয়, তাই বেশি খাওয়া যায় না।

মুযদালিফায় অবস্থান প্রসঙ্গ

১. মুযদালিফা আরাফা থেকে ৩/৪ মাইল দূরে। আরাফা থেকে গাড়িতে ও পায়ে হেঁটে উভয়ভাবে মুযদালিফায় যাওয়া যায়। তবে গাড়িযোগে গেলে পথ কম হওয়া সত্ত্বেও প্রচণ্ড ভিড়ের কারণে পথে ইশার ওয়াক্ত শেষ হয়ে যাওয়ার আশংকা থাকে। তাই যাদের হাঁটার ক্ষমতা আছে, তাদের জন্য হেঁটে যাওয়াই ভালো।

২. আরাফা ও মুযদালিফার মাঝে প্রায় পাঁচ কিলোমিটার প্রশস্থ একটা ময়দান আছে। সেখানে অনেক টয়লেট ও গাছপালা আছে।  যারা আরাফা থেকে হেঁটে মুযদালিফায় যায় তাদের অনেকে এই মাঠকে মুযদালিফা মনে করে এখানে অবস্থান নেয়। আর এখানেই মাগরিব-ইশা একত্রে আদায় করে। অথচ এখানে মাগরিব-ইশা একত্রে আদায় করা জায়িয নেই। আর ফজরের পরে এখানে উকূফ করলে মুযদালিফায় উকূফ করার ওয়াজিবও আদায় হবে না। যারা এই ভুলের শিকার হবে তাদের উপর দম ওয়াজিব হবে।

জামারাতে কংকর নিক্ষেপ প্রসঙ্গ

১. খোঁজ-খবর নিয়ে যখন ভিড় কম থাকে , তখন পাথর মারতে যাবে। পুরুষরা দিনে পাথর মারা শেষ করতে চেষ্টা করবে। সাধারণত রাতের বেলা ভিড় কম হয়, তাই মহিলাদেরকে রাতের বেলা পাথর মারতে নিয়ে যাবে। বর্তমানে ভিড়ের যে অবস্থা, তাতে দুর্বল, মাযূর বয়স্ক পুরুষরাও যদি আসরের পরে বা রাতে পাথর মারতে যায় তাহলে পরিস্থিতির কারণে ইনশাআল্লাহ মাকরূহ হবে না।

২. পাথর মারার স্থানটা কয়েক তলাবিশিষ্ট। একেকটা রাস্তা একেক তলায় চলে গেছে। যে তলা থেকে পাথর মারার ইচ্ছা আগে থেকে চিন্তা-ভাবনা করে সে তলার রাস্তা ধরবে। যে তলায় ভিড় কম হবে বলে মনে হবে, সে তলা থেকে পাথর মারবে। অনেকে প্রতীকী শয়তানের (খুঁটির) গায়ে জুতা, ছাতি ইত্যাদি নিক্ষেপ করে, এটা জায়েয নেই। (ফাতাওয়া হিন্দিয়া ১/২৫৭)

৩. শয়তানের খুঁটির চতুর্পার্শ্বে যে দেয়াল আছে, ভিড় এড়িয়ে এ দেয়ালের পশ্চিম পার্শ্বে চলে গেলে ভিড় অনেক কম হয়। এ সুযোগ নেওয়া যেতে পারে।

কুরবানী প্রসঙ্গ

১. কুরবানী দুইভাবে করা যেতে পারে-

এক. মিনার উত্তর পাশে ‘মুআইসীম’ নামক একটা ক্যাম্প আছে। যে কেউ ওখানে গিয়ে বকরী কিনে নিজ হাতে জবাই করতে পারে। অথবা ওখানে যারা পশু বিক্রি করে তাদের বললে তারা সামনেই বকরী জবাই করে দেবে।

দুই. মক্কায় বাইতুল্লাহ শরীফের দক্ষিণে তিন মাইল দূরে ‘হালাকা’ ও ‘নাক্কাসা’ নামক পশু বিক্রির দুইটি বাজার আছে। কেউ চাইলে ঐ বাজারে গিয়ে পশু কিনে কুরবানী করতে পারে, আবার এমনও করা যেতে পারে যে, পুরা কাফেলার পক্ষ থেকে নির্ভরযোগ্য ৪/৫ জন লোক বাজারে যাবে। তারা পশু কিনে প্রত্যেকের জন্য ভিন্ন-ভিন্ন নিয়ত করে জবাই করবে।

২. বর্তমানে অনেকে ব্যাংকের মাধ্যমে কুরবানী করায়। অথচ ব্যাংকের মাধ্যমে কুরবানী করানো সতর্কতার পরিপন্থী। কেননা ব্যাংক কর্তৃপক্ষ যে সময়ে কুরবানী করার কথা বলে, সাধারণত সে সময়ের মধ্যে কুরবানী করতে পারে না। তো যদি তাদের দেওয়া সময় পর্যন্ত অপেক্ষা করে মাথা মুন্ডানো হয় বা চুল ছাঁটা হয়, আর কুরবানীর পশু তখন পর্যন্ত জবাই করা না হয়, তাহলে কুরবানীর আগে মাথা মুন্ডানোর অপরাধে দম ওয়াজিব হবে। অথচ সে জানতেই পারবে না যে, তার উপর দম ওয়াজিব হয়েছে। কারণ, তামাত্তু ও কিরান হজ্জকারীর জন্য কুরবানী করার আগে মাথা মুন্ডানো বা চুল ছাঁটা নিষেধ। তাই যথাসম্ভব ব্যাংকের মাধ্যমে কুরবানী করাবে না।

তবে, কেউ যদি কোনো উপায়ে নিশ্চিত হতে পারে যে, ব্যাংক কর্তৃপক্ষ তার কুরবানী করে দিয়েছে, তাহলে তখন হলক করতে কোনো সমস্যা নেই। এবং সেক্ষেত্রে ব্যাংকের মাধ্যমে কুরবানী করাতেও কোনো অসুবিধা নেই। তবে বাস্তবতা হল, এটা জানা সম্ভব হয় না। তাই এই ঝুঁকি নেয়া বুদ্ধিমানের কাজ হবে না।

১০ ই যিলহজ্জ এর আমল প্রসঙ্গ

মিনা থেকে কংকর মেরে মক্কায় যাওয়ার দুটি পদ্ধতি হতে পারে- এক. পদব্রজে যাওয়া। বড় শয়তান থেকে সামান্য পশ্চিমে অগ্রসর হয়ে বাম দিকের টিনশেড এর রাস্তা ধরে টানেলের ভিতর দিয়ে মক্কায় চলে যাওয়া। এখান দিয়ে হেঁটে মক্কায় পৌঁছতে এক ঘণ্টার মতো সময় লাগে। দুই. গাড়িযোগে যাওয়া। যারা গাড়িতে যেতে চায় তারা ‘আযিযিয়া’ কিংবা ‘বিন দাউদ’ নামক স্থান থেকে গাড়িতে উঠতে পারে। জামারায় আকাবা থেকে সামনের দিকে কিছু দূর গিয়ে বাম দিকের রাস্তায় সামান্য এগুলেই আযীযিয়া। আর টিনশেডে না ঢুকে সামান্য আগে বাড়লেই বিন দাঊদ।

যারা হাঁটতে পারে তাদের জন্য মিনা থেকে মক্কায় যাওয়ার সহজ উপায় হলো, টিনশেড টানেলের পথে পদব্রজে যাওয়া। কেননা, গাড়িতে উঠার আগে ও গাড়ি থেকে নেমে বাসায় পৌঁছতে যতটুকু হাঁটতে হয়, টিনশেডের পথে আনুমানিক ততোটুকু হাঁটলেই মক্কায় পৌঁছে যাবে। তাছাড়া গাড়ির পথে প্রচণ্ড ভিড় থাকায় মিনা থেকে মক্কায় যেতে প্রায় ২-৩ ঘণ্টা লেগে যায়, যা খুবই বিরক্তিকর ও কষ্টকর। তাই সক্ষম হাজীদের হেঁটে যাওয়াই ভালো। তবে কখনো উভয় দিকে টানেলের মুখে প্রচণ্ড ভিড় দেখা গেলে জানের হেফাজতের জন্য টানেলে ঢোকার ঝুঁকি নিবে না। যেমন ১২ তারিখ হাজীরা টানেল দিয়ে মক্কা যায়। সেদিন যোহর থেকে ইশা পর্যন্ত মক্কার দিক থেকে টানেলে ঢুকতে চেষ্টা করবে না। গাড়ীতে মিনায় যাবে। ফেরার পথে আশা করা যায় সহজেই টানেল দিয়ে ফিরতে পারবে।

রিয়াযুল জান্নাহ প্রসঙ্গ

মসজিদে নববীর বর্তমান মেম্বরের পূর্বপার্শ্ব থেকে নবীজী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর রওযার দেয়াল বা জালি পর্যন্ত স্থানকে ‘রিয়াযুল জান্নাহ’ (জান্নাতের বাগান) বলে। মসজিদে নববীতে লাল রঙের কার্পেট বিছানো আছে। আর রিয়াযুল জান্নাতে ছাই ও সাদা রঙ মিশ্রিত কার্পেট বিছানো আছে। ঐ কার্পেট দেখেই রিয়াযুল জান্নাত শনাক্ত করতে পারবে। এই স্থানে সবসময় ভিড় থাকে। তবুও সুযোগ মতো ওখানে প্রবেশ করে কমপক্ষে দুই রাকাআত নামায পড়ার চেষ্টা করবে।

রওযা’ যিয়ারত প্রসঙ্গ

অনেকে সালাম পেশের সময় রওযার দেয়ালে এক জায়গায় (প্রথম জালির উপর)

ما كان محمد ابا احد من رجالكم

এই আয়াত লেখা দেখে ওখানেই সালাম পেশ করে। অথচ এটা সালাম পেশের স্থান নয়। বরং সালাম পেশের সঠিক স্থান হলো দ্বিতীয় জালি। এর ঠিক উপরে রওযার দেয়ালে এই আয়াত লেখা আছে-

ان الذين يغضون اصواتهم عند رسول الله اولئك الذين امتحن الله قلوبهم للتقوى…

আর এই আয়াতের নিচে ياخير من دفنت بالقاع اعظمه….. চার লাইনের আরবী কবিতা লেখা আছে। এর নিচে চাকতিতে লেখা আছে هنا السلام على محمد رسول الله صلى الله عليه وسلم এটা হলো সালাম দেয়ার সঠিক স্থান। এখানে পৌঁছার পর সালাম দিবে। এরপর একটু সামনে বেড়ে আরেকটি চাকতিতে লেখা আছে-

هنا السلام على ابى بكر الصديق رضى الله عنه এখানে হযরত আবূ বকর রা. এর উপর সালাম পেশ করবে। এরপর কয়েক কদম এগুলে আরেকটি চাকতিতে লেখা আছে- هنا السلام على عمر الفاروق

এখানে হযরত উমর ফারুক রা. এর উপর সালাম দিবে।

আল্লাহ তা‘আলা সকল হাজি সাবেবানদের হজ্জকে কবুল করুন। আমাদের সবাইকে তার ঘর ও নবীজি সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লামের রওযা যিয়ারতের তাওফীক দান করুন। আমীন।..

(সৌজন্যে- দারসে মানসুর)