আরিফ বিল্লাহ হযরত ক্বারী সিদ্দিকুর রহমান রহঃ এর

May 06 2019, 05:51

qowmipedia.com,
কালের চাকায় ভর কর বয়ে চলছে পৃথিবীর চলমান গতিধারা। সে গতিধারায় যায় যায় দিনে জন্ম নিয়েছেন হাজারো লাখো মনীষী। যাঁদের শুভাগমন পৃথিবীবাসীর জন্য বয়ে এনেছে কল্যাণের পয়গাম। যাঁরা যুগে যুগে ভ্রান্ত ও ভ্রষ্ট মানবতাকে হেদায়েত ও কল্যাণের পথে পথ দেখিয়েছেন।
 যখনই মুসলিম সমাজ কোরআন সুন্নাহ’র নির্দেশিত পথ ছেড়ে বিদআত ও কুসংস্কারের অন্ধকারে নিমজ্জিত হয়। তখনই তাদের মাঝে আগমন করেন শায়েখ সিরহিন্দি ও তার উত্তরসূরিরা। খাঁটি নায়েবে নবী। যারা কোরআন সুন্নাহের পথে সমাজকে আলোকিত করেন। সমাজকে সংস্কার ও ঢেলে সাজান। এ ধারারই একজন কালজয়ী উজ্জ্বল নক্ষত্র আমার দাদা হযরত শায়খ ক্বারী সিদ্দিকুর রহমান রহঃ।
হযরত শায়খ ক্বারী সিদ্দিকুর রহমান রহঃ হাজারো জিন্দা মুরদাহ আকাবিরের জন্মভূমি, সুজলা সুফলা, বন বনানী ঘেরা কুমিল্লা জেলার বরুড়া থানার অন্তর্গত রাজাপুর গ্রামে ১৩০৩ বাংলা মোতাবেক ১৯১৮ ইংরেজি সালে সুবহে সাদিকের মত আলোকরশ্মি নিয়ে জন্মগ্রহণ করেন।
হযরত রহঃ বাল্যকাল থেকেই ভিন্নপ্রকৃতির ছিলেন। অন্য শিশুদের মত তিনি চঞ্চল ছিলেন না। শিশুসূলভ বাচালতা কোনোদিনই তাঁর মাঝে দেখা যায়নি। তিনি ছিলেন ধীর স্হির গাম্ভীর্যপূর্ণ। সদা আপন মনে বসে চিন্তা করতেন। খেলাধূলায় মন দিতেন না কখনো। আপন মনে স্বকিয়তা বজায় রেখেছেন সর্বদা।
হযরত রহঃ শিশুকালেই ইমানী পরিক্ষার মুখোমুখি হন। রাসূল সঃ এর মত বাল্যকালেই ইয়াতীম হয়ে যান। হযরতের পুরো জীবনই ছিল কষ্টের। বহু ঝড় তুফান বয়ে গেছে তাঁর জীবনে। সবর ও ইবতিলার মাঝেই তিনি বড় হয়েছেন। যেন আগুনে পোড়া একটুকরো খাঁটি সোনা। হযরতের বয়স যখন মাত্র দেড় বছর, তখন তাঁর সম্মানিতা মাতা আয়েশা খাতুন আল্লাহর ডাকে সাড়া দিয়ে চলে যান। পিতার আশ্রয়ে লালিত পালিত হতে লাগলেন। কিন্তু নিয়তির ফায়সালা ছিল একটু ভিন্ন। হযরতের বয়স যখন মাত্র আট বছর, তখনই তাঁর সম্মানিত পিতা সৈয়দ আলী তালুকদার বালক সিদ্দিকুর রহমানকে ইয়াতীম করে চিরবিদায় নেন। পৃথিবীতে এখন তার আপন বলতে কেউ নেই। মাতৃমমতা পিতৃঅভিভাবকত্বের ছায়া সবই হারালেন। আল্লাহই যেন তাকে নিজ অভিভাবকত্বে নিয়ে নিলেন।
হযরতের দুই চাচী ছিল। একজন নামাযী। আরেকজন ছিল নামযের প্রতি অমনোযোগী। হযরত রহঃ নামাযী চাচীর দুধ পান করতেন। অপর চাচীর হাতের কিছুই খেতেন না। কোনো অদৃশ্য শক্তি যেন বাল্যকালেই তাঁর ভেতরে ‘হুব্বু ফিল্লাহ ও বুগদু ফিল্লাহে’র দীক্ষা গেঁথে দিয়েছে।
রাহবার ছাড়া যেমন অচেনা পথিক  পথ চলতে পারেনা।বিভ্রান্ত হওয়ার সমূহ আশংকা থাকে, তোমনি মানুষের জীবনে ইলমি মুরুব্বি একান্ত প্রয়োজন। ইলমের এ পথ কণ্টকাকীর্ণ, বন্ধুর ও প্রতিকূল। তাই, শায়খ রহঃ ঐতিহ্যবাহী মাদরাসা ইবরাহিমিয়া দারুল উলুম উজানীর স্বনামধন্য শায়খুল হাদিস হযরত মাওলানা নওয়াব আলী সাহেবকে ইলমী মুরুব্বী হিসেবে গ্রহণ করেন।
চাচাত ভাই হযরত মাওলানা আব্দুল আজিজ সাহেবের নিকট কোরআন শিক্ষার মাধ্যমে তার শিক্ষজীবনের হাতেখড়ি। কোরআনের প্রতি ছিল তার প্রবল আগ্রহ। তাই তিনি ইবরাহিমিয়া দারুল উলুম উজানি থেকে হযরত মাওলানা ক্বারী উবাইদুল্লাহ রহঃ এর কাছ থেকে ক্বারীয়ানা সনদ লাভ করেন।
আল্লাহ পাকের দরবারে যোগ্যতার কোন মূল্য নেই।বরং, আল্লাহ পাকের দরবারে গ্রহণযোগ্যতার মানদণ্ড হল, আমল ও তাক্বওয়া। আল্লাহর বাণী, “তোমাদোর মধ্যেই সেই বেশি সম্মানী, যে বেশি মুত্তাকী পরহেজগার।” আর আমল ছাড়া ইলমের কীইবা মূল্য। দরসীভাবে হযরত শায়খ রহঃ এর শিক্ষার পরিধি যদিও শরহেজামি পর্যন্ত ছিল; কিন্তু আমলের ক্ষেত্রে তিনি ছিলেন অতুলনীয় ব্যক্তিত্ব। ফলে আল্লাহ তাআলা তাঁকে ‘ইলমে লাদুনী’ দান করে ছিলেন।
হযরতের জীবনে শিক্ষারচে’ দীক্ষারই প্রভাব বেশি। যৌবনের শুরু থেকেই নিরত হয়েছেন আত্মশুদ্ধি ও আধ্যাত্মিকতার সাধনায়।পবিত্র আত্মা ও সফলতার পথে।আসা যাওয়া করতেন উপমহাদেশের শ্রেষ্ঠ আধ্যাত্মিক রাহবার ফক্বিহুন নাফস রশিদ আহমাদ গাঙ্গুহী রহঃ এর  বিশিষ্ট খলিফা উজানির ক্বারী ইবরাহিম সাহেব রহঃ এর দরবারে।ফয়েজ ও সোহবত লাভে ধন্য হয়েছেন এ মহান আধ্যাত্মিক রাহবারের। প্রথম মুর্শিদ ক্বারী ইবরাহিম সাহেব রহঃ এর ইন্তিকালের পর তাঁর একান্ত ও বিশিষ্ট খলিফা চাঁদপুরের হযরত মাওলানা তাজউদ্দিন মিয়া সাহেব রহঃ এর নিকট বায়আত গ্রহণ করেন। নিজের শায়েখের দেয়া সবক নিয়মিত আদায় করে তিনি ইশক ও মারেফাতের সাগরে হাবুডুবু খেতে থাকেন। তাসাউফ ও আধ্যাত্মিকতার শীর্ষচূড়ায় পৌঁছে যান। খেলাফত লাভ করেন স্বীয় শায়খ মিয়া সাহেব রহঃ থেকে। পরবর্তীতে আপন শায়েখের মৃত্যুর পর শায়খুল হাদিস আলহাজ্ব হযরত মাওলানা নূরউদ্দিন গহরপুরী রহঃ থেকে খিলাফতপ্রাপ্ত হন।
ইশকে ইলাহির অমীয় সুধা পানের তীব্র নেশায় একপর্যায়ে তিনি ছুটে যান শায়খুল আরবে ওয়াল আজম হযরত মাওলানা সায়্যিদ হুসাইন আমহমদ মাদানি রহঃ এর বিশিষ্ট খলিফা বরুনার পীরে কামেল হযরত মাওলানা লুৎফুর রহমান সাহেব রহঃ এর কাছে এবং নিজেকে পেশ করেন হযরতের দরবারে। কিন্তু, মাওলানা লুৎফুর রহমান রহঃ আপন প্রভুর সান্নিধ্যে চলে গেলে তিনি মাওলানা ইসহাক রহঃ (পীর সাহেব চরমোনাই) এর নিকট মুরিদ হন। এভাবেই তিনি মা’রেফাতে ইলাহির অদম্য বাসনায় ছুটে বেড়ান এখানে ওখানে।
হযরত শায়খ রহঃ এর কর্মজীবন ছিল বড়ই বৈচিত্র্যময়। আল্লাহর বান্দাদের আল্লহমুখি করাই ছিল হযরত রহঃ এর জীবনের প্রধান বৈশিষ্ট্য ও মূল লক্ষ্য। নেত্রকোনার জারিয়ার  পল্লী গ্রামের এক মসজিদে কোরআনের তা’লীমের দ্বারা সূচিত হয় কর্মজীবনের। এ জারিয়াতেই কাটিয়েছেন জীবনের সিংহভাগ। স্বভূমি ও আত্মীয় স্বজনের মায়া ত্যাগ করে, যাবতীয় প্রতিকূলতাকে বরণ করে, শুধু দ্বীনের খাতিরে এ জারিয়াতেই পড়ে ছিলেন জীবনভর। পথহারা ও আল্লাহভুলা লোকদের খুঁজে খুঁজে এনে কোরআনের তা’লীম দিতেন। তাঁর অবিরাম সাধনা ও ঐকান্তিক প্রচেষ্টার ফলে জারিয়ার মাটিতে গড়ে ওঠে কোরআন চর্চার সুন্দর ও মনোরম পরিবেশ। তাঁর প্রত্যক্ষ উদ্যোগে গ্রামে গ্রামে বহু মক্তব ও মাদরাসা প্রতিষ্ঠিত হয়। আলিম ওলামা থেকে শুরু করে শিক্ষিত ও সাধারণ মুসলমানদের অনেকেই তাঁর মুরিদ হন। জারিয়ার স্টেশন মসজিদ ছিল তাঁর খানকা ও নামায আদায়ের স্হান। ঐ মসজিদেই তিনি প্রতি রমযানে ছাত্র, মুরিদ ও শিষ্যদের নিয়ে ই’তিকাফ করতেন। তাঁর রূহানী ফয়য অল্প দিনেই বাংলার আনাচে কানাচে ছড়িয়ে পড়ে।
হযরত রহঃ ব্যক্তিগত জীবনে ছিলেন নির্মোহ। দুনিয়ার ন্যূনতম লোভ লালসাও তাঁর মাঝে ছিল না। তবে জাগতিক ব্যাপারে ছিলেন পরম উদার। আর ধর্মীয় ব্যাপারে ছিলেন অত্যন্ত রক্ষণশীল। সদা সুন্নতের উপর অটল অবিচল। বিদআত ও কুসংস্কারের প্রতি কঠোর ও ঘোরবিরোধী ছিলেন। সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে ছড়িয়ে পড়া বিদআতের সমূলে উৎপাটন করে সুন্নতের জিন্দা করেছেন। বাংলাদেশেরর বিভিন্ন অঞ্চল বিশেষ করে ময়মনসিংহ, ঢাকা,নারায়ণগঞ্জ, নরসিংদী,  জারিয়া এবং বরমিতে তিনি তাঁর রূহানিয়্যাতের আলো ছড়িয়েছেন। যেখানে গড়ে ওঠেছে তাঁর অসংখ্য ভক্ত মুরিদান। তিনি তাঁর মজলিসে পরিপূর্ণ  আলিম না হয়েও কোরআন হাদিসের এমন সব ব্যখ্যা দিতেন, আলেমগণ পরে কিতাব খুলে এমনই পেতেন।
নেত্রকোনার জারিয়া ছাড়াও তাঁর নিজ গ্রাম রাজাপুরে একটি মসজিদ ও মক্তব প্রতিষ্ঠা করেন। গ্রামের ছেলেমেয়েদের নিজ হাতে দ্বীনি শিক্ষা দিতেন। গ্রামের মানুষের সুখে দুঃখে পাশে দাঁড়াতেন। বর্তমানে রাজাপুর গ্রামের প্রায় ঘরে ঘরেই যে হাফেজ আলেম পাওয়া যায়, এটা তাঁরই নেক তাওয়াজ্জুহের বরকত।
নারায়ণগঞ্জের ধর্মগঞ্জে মুহিউসসুন্নাহ জামিয়া সিদ্দিকিয়ার প্রতিষ্ঠাতাও তিনি।
জামিয়া আরাবিয়া মাখজানুল উলূম খাগডহর ঢোলাদিয়া মোমেনশাহীও তাঁর স্বপ্নে চিহ্নিত স্হানে প্রতিষ্ঠিত। তাঁর আদেশেই এখানকার বনজঙ্গল কেটে প্রতিষ্ঠা করা হয় অত্র মাদরাসা।
★ হযরত মাওলানা আব্দুল হাই রাহমানী, শায়খুল হাদিস গুরুস্থান মাদরাসা, মুক্তাগাছা,  মোমেনশাহী।
★ হযরত হাফেজ মাওলানা আব্দুর রহমান (হাফেজ্জী হুজুর), মুহতামিম মাখজানুল উলূম মাদরাসা, মোমেনশাহী।
★ হযরত মাওলানা মুফতি তাজুল ইসলাম, শায়খুল হাদিস আরজাবাদ মাদরাসা, মিরপুর, ঢাকা।
★ হযরত হাফেজ মাওলানা আব্দুল হক, পেশ ইমাম বড় মসজিদ, মোমেনশাহী।
প্রমুখ বড় বড় উলামায়ে কেরামসহ আরো অনেক খুলাফা তিনি রেখে গেছেন। যারা একই সাথে ইলম পিপাসুদের ইলমি পিপাসা মেটাচ্ছেন এবং দিকে দিকে হেদায়েতের আলো ছড়িয়ে দিচ্ছেন।
১৯৯০ সালে হজ্ব থেকে ফিরে আসার পর তিনি ডায়াবেটিস রোগে আক্রান্ত হন। দীর্ঘদিন ডায়াবেটিসে ভোগেন। ১৯৯৯ সালের শেষ দিকে এসে শারীরিক দুর্বলতা ক্রমাগত বাড়তে থাকে। অবশেষে ১২/০৫/১৯৯৯ ইং ২৯ শে বৈশাখ ১৪০৬ বাংলা ২৫ শে মুহাররম ১৪২০ হিজরি রোজ বুধবার দুপুর ২ টা ১০ মিনিটে এ মহান ওলী আল্লাহর যিকির করতে করতে হাসিমুখে এধরার মায়া ত্যাগ করে মহান প্রভুর সান্নিধ্যে চলে যান।
লেখক : হাফেয মাওলানা সাইদুর রহমান
(শায়েখের নাতি)
মুঠোফোন: 01846813567