শায়খুল হাদীস মাওলানা শায়খ শিহাব উদ্দিন রহ. এর বর্ণাঢ্য জীবন

November 20 2018, 07:28

qowmipedia.com,

লিখেছেন-তালিব উদ্দীন শমশেরনগরী> মুহাদ্দিস, জামেয়া তাওয়াক্কুলিয়া রেঙ্গা

সর্বমহলে সমাদৃত ও প্রশংসিত উপমহাদেশের অন্যতম হাদীস বিশারদ আল্লামা শিহাব উদ্দিন রহ.। বর্ণাঢ্য কর্মজীবনের প্রথম দিন থেকেই শায়খুল হাদীসের মসনদে স্বমহীমায় আসীন। অর্ধশতাব্দি কালব্যাপী জামেয়া রেঙ্গায় বুখারী শরীফের দারস প্রদানের বিরল কৃতিত্বের অধিকারী। শায়খুল মাশায়েখ, শায়খুল হাদীস আল্লামা শায়খ শিহাব উদ্দীন দাঃ  বাঃ একটি নাম, একটি ইতিহাস। একটি প্রেরনা। আলোর দিশারি। চেতনার বাতিঘর। জীবনের প্রতিটি ধাপে ধাপে যার রয়েছে ঈর্ষণীয় সাফল্য। খেদমতে খলকে দৃঢ়প্রত্যয়ী, নিরলস পরিশ্রম, অদম্য স্পৃহা অসীম সাহস, বৈচিত্র্যময় গুণাবলী সম্পন্ন এক বিরল ব্যক্তিত্ব। অসাধারণ প্রতিভা, ব্যতিক্রমী কর্মস্পৃহা, বহুমুখী প্রতিভা ও অত্যান্ত বিচক্ষণ ব্যক্তি। আধ্যাত্বিক কামালতের মুর্তপ্রতীক এই হযরতের ইলমের গভীরতা ও তাআল্লুক মা’আল্লার ঝান্ডাবাহী। উস্তাজুল আসাতিজা ওয়াল মুহাদ্দীসীন, বহুমাত্রিক সাফল্যমন্ডিত কর্মময় জীবনের অধিকারী। স্বমহীমায় উজ্জল সত্যিকারের নায়েবে নবী। আমার মুহতারাম উস্তাদ, সাদাসিধে জীবনের অধিকারী পরম শ্রদ্ধেয় ব্যক্তিত্ব।

সিলেট জেলার অন্তর্গত, পুন্যবানদের অন্যতম ঘাটিখ্যাত, কানাইঘাট থানার ৫নং চতুল ইউনিয়নের পর্বতপুর নয়াফৌদ গ্রামের এক সম্ভ্রান্ত দ্বীনদার পরিবারে মরহুম আলহাজ্ব ক্বারী  মাওঃ নিসার আলী রহঃ ও আলেমা মহিয়সী নারী মরহুমা মোছাঃ আয়েশা বেগম রাহঃ র ঔরশে ১৩৫৫ বাংলার মাঘমাসে মোতাবেক ১৯৪৮ ইং সালের সোমবার দিনে ১২ রবিউল আউয়ালে সোবহে সাদিকের সময় জন্মগ্রহণ করেন।

অপরুপ নিসর্গশোভা মায়াবী পরিবেশে শৈশবের সোনাঝরা দিনগুলো তিনি অতিক্রম করেন। মুক্ত আবহাওয়ায় বেড়ে উঠেছেন বলে বাল্যকাল থেকেই তাঁর চিন্তা চেতনা এক অসম ব্যাপ্তি লাভ করে। পিতা- মাতার স্নেহছায়ায় থেকে সত্য, ন্যায় ও ইনসাফের কঠিন পাঠগুলো সহজেই আত্মস্থ করে নেন। শিশুকাল থেকেই তাঁর সত্তায় লুকিয়ে ছিলো দ্বীনে ইলাহীর তীব্র তৃষ্ণা। আরাধ্য ইবাদতে ছিলেন অনুস্বরণীয়।

সময়ের সর্বাধিক আলোচিত একটি নাম। সর্বসাধারনের জন্য ছায়াদার একটি বটবৃক্ষ। একটি অবিস্মরণীয় ইতিহাস। পুর্ণতার প্রতিচ্ছবি,  একটি চেতনা, এ শতাব্দীর কিংবদন্তীতুল্য মহাপুরুষ। একটি গণবিপ্লব, প্রকৃত মুমিনের জন্য একজন অবিসংবাদিত যোগ্য রাহবার। সহজ সরল,উদারমনা, নিরহংকারী হযরত শায়খ  গণমানুষের শান্তির ঠিকানা। তার মুহতারাম পিতা ছিলেন হাকিমুল উম্মত হযরত থানভী রহঃ’র হাতে বাইআত। আবাল – বৃদ্ধ  বণিতা, নারী- পুরুষ সবার কাছে তিনি দেওবন্দী নামে ছিলেন পরিচিত। শায়খের পিতা উচ্চশিক্ষার জন্য দেওবন্দের উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন। তিনি দেওবন্দ থাকাবস্থায় তার পিতা শায়খের দাদা মারা যান  দেওবন্দ থেকে উচ্চশিক্ষার সম্পন্ন করে

ইলমুল কিরাআত বিভাগে ভর্তি হয়ে কিরাতে সাবআ আসারার ডিগ্রী অর্জন করেন। তার পিতা শায়খকে ছোট অবস্থায় আনুমানিক ৭ বৎসর বয়সে বাড়িতে রেখে তার হাতে ভাংতি সিকি (কয়েন) জাতীয় টাকা দিয়ে চট্রগ্রাম হইতে পানির জাহাজ যোগে সাড়ে তিন মাসে ১৪০০ টাকায় হজব্রত পালন করেন। হজ্বশেষে বাড়ীতে আসার মুহুর্তে বাবার মৃত্যু সংবাদ পেয়ে শায়খ বিচলিত হন। অবশেষে আল্লাহর রহমতে তিনি সহিহ সালামতে ফিরলে তাকে নৌকাযোগ দরবস্ত বাজার থেকে এসে বাড়ীতে নিয়ে যান। শায়খের মুহতারামা মাতা সাংসারিক কাজকর্মের ঝামেলা সত্বেও নিয়মিত তেলাওয়াত, তরজমায়ে কোরআন ও অন্যান্য উর্দু কিতাবাদী নিয়মিতভাবে মোতালা – অধ্যয়ন করতেন। শায়খের মাতা- পিতা বারবার স্বপ্নযোগে রহমতে আলম, নবীয়ে আকরম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কে দেখেছেন বারবার। শায়খ সম্পর্কে ও তারা অনেক গুরুত্বপুর্ণ স্বপ্ন দেখেন।সে সব স্বর্ণপুরুষের স্বপ্নিল প্রতিচ্ছবি হয়ে ওঠেন আধ্যাত্বিক জগতের সুর্য, মফাক্কিরে ইসলাম, উম্মাহর দুরদর্শি দরদী রাহবার আল্লামা শায়খ শিহাব উদ্দীন দাঃ বাঃ। শায়খের পিতা ৭৫ বৎসর বয়সে ১৯৮৭ ইং সালের ২৭ ডিসেম্বর শুক্রবার সকাল ৯ টা ৩০ মিনিটের সময় ইন্তেকাল করেন এবং তার মাতা ৮৫ বৎসর বয়সে ইন্তেকাল করেন। শায়েখ তার  আব্বা ও তিন চাচার মধ্যে তিনি তার পিতা ও হাজী চাচাকে পেয়েছিলেন, দুই চাচা শায়খের জন্মের পুর্বেই মৃত্যু বরণ করেন। শায়খের দাদা হাজি আহমদ আলী রহঃ দাদী মোছাঃ মফুরা বিবি রহঃ উভয়ই ১২০ টাকা করে সে সময় হজব্রত পালন করেন। শায়খের একমাত্র ফুফু কে তিনি জীবিতাবস্হায় পেয়েছিলেন।

হযরত শায়খের সম্মানিতা মাতা ছিলেন  একজন আবিদা, সালিহা ও আলেমা মহিলা এবং পিতাও ছিলেন দেওবন্দী এক ক্ষনজন্মা আমিল আলিম। সেকারনে মাতা-পিতার তত্ত্বাবধানে পারিবারিকভাবে তাঁর শিক্ষা জীবনের সুচনা হয়। পাশাপাশি নিজগ্রামের মক্তবে। তারপর বর্তমানের “জামেয়া ইসলামিয়া দারুল হাদীস চতুল ঈদগাহে” (যার প্রাক্তন নাম ছিল ” চতুল ঈদগাহ আলিয়া মাদ্রাসা”)। এ মাদ্রাসায়   ইবতেদাইয়্যাহ থেকে আলিয়া ২য় বর্ষ পর্যন্ত কৃতিত্বের সাথে লেখা-পড়া করেন। প্রতিটি ক্লাসেই তিনি প্রথম স্থান অধিকার করেন। হেদায়াতুন নাহু জামাতে এ মাদ্রাসা থেকে পরিক্ষায় অংশ নিয়ে কানাইঘাট বোর্ডে প্রথম স্থান অধিকার করেন। সরফ জামাতে পড়াকালীন বাৎসরিক জলসার স্টেইজে আল্লামা মুশাহিদ বায়মপুরী রহঃ শায়খ শিহাব উদ্দীন দাঃ কে সিগাহ ও তা’লীল ধরালে তিনি ঝটপট উত্তর দিয়ে সকলের দৃষ্টি আকর্ষন করেন, এবং বায়মপুরী রহঃ মাহফিলে মাইকে ঘোষনা দিয়ে তখনকার সময়ের ১ টাকা পুরুষকার দেন যখন ওয়াজের হাদিয়া ছিল ছয় টাকা। হযরত শায়খ গেলো সপ্তাহেও সেই বায়মপুরীকে স্বপ্নযোগে দেখেছেন এবং ইদানিং বারবার স্বপ্নযোগে তাকে তিনি দেখতে পাচ্ছেন।

শায়খের বাড়ী থেকে মাদ্রাসাটির দুরত্ব হল ১ কিলোমিটার। প্রতিদিন দু’পাশে দিগন্ত বিস্তৃত অবারিত ফসলের মাঠ মাড়িয়ে দ্বীনী শিক্ষার অমীয় সুধা পান করতে, সেই নববী কাননের মধু আহরণ করতে ভ্রমরের মতো ছুটে চলতেন এই রাসুল প্রেমিক- আসেকে রাসুল চতুল ঈদগাহ মাদ্রাসার পানে। চতুল মাদ্রাসার শায়খের কয়েকজন উস্তাদ হলেন ; ১. খলিফায়ে ফেদায়ে মিল্লত মরহুম মাওঃ শেখ আহমদ আলী রাহঃ যিনি মিযান মুনশাইব ও তরজমায়ে কোরআনের উস্তাদ। ২. মাওঃ শামসুল হক রহঃ। ৩. মাওঃ  নছিরুদ্দীন রাহঃ । ৪. মাওঃ আঃ সামাদ রাহঃ ও হযরত মাওঃ মুহিব্বুল হক সাহেব । উল্লেখ্য যে প্রাচীন বাংলার রাজধানী সোনারগাঁয়ে ১২৭০ ঈসায়ী সনে সুলতান গিয়াসুদ্দীন বলবনের আমলে প্রখ্যাত মুহাদ্দিস শায়খ শরফুদ্দীন আবু তাওয়ামা এসে তদানিন্তন বিশ্বের হাদিস চর্চার শ্রেষ্ঠ কেন্দ্র  গড়ে তোলেন। ইতিপুর্বে হিজরি পঞ্চম শতকের সুচনার দিকে চালু হয় বর্তমান প্রচলিত ধারার মাদ্রাসা। ৪১০ হিজঃ মোতাঃ ১০১৯ খৃঃ গজনিতে সুলতান মাহমুদ গজনবী সর্বোচ্ছ ইসলামী বিদ্যাপীঠ হিসেবে ‘বিশ্বদুহিতা’ মসজিদের কাছে একটি মাদ্রাসা নির্মাণ করেন। একসময় গোটা ভারতবর্ষে কোনো নগর- বন্দর এমন ছিলনা যেখানে মাদ্রাসা গড়ে ওঠেনি। সরকারিভাবে মাদ্রাসাগুলোর ব্যয়ভার বহন করা হতো। তখন কওমী – সরকারী  বলে কোনো পার্থক্য ছিল না। শুধু মোগল শাসনামলে রাজধানী দিল্লিতেই ছিল এক হাজার মাদ্রাসা। বৃটিশ  শাসনের পুর্বে  শুধু বাংলাদেশেই ছিল ৮০ আশি হাজার মাদ্রাসা। বৃটিশরা  ভারতবর্ষের ক্ষমতায় আসীন হলে চুরমার হয়েযায় মাদ্রাসা শিক্ষাব্যবস্থা।বৃটিশরা হাজার বছরের লালিত লক্ষলক্ষ মাদ্রাসা মসজিদ ভেঙে চুরমার করে দেয়।সর্বশেষ উলামায়ে কেরামের আযাদী আন্দোলনের ফলে স্বাধীন হয় এ উপমহাদেশ ১৯৪৭ সালে। হুজুরের জন্ম ১৯৪৮ সালে হওয়ায় শিক্ষাব্যবস্থা ও ভঙ্গুর যোগাযোগ ব্যবস্থা কোন পর্যায় ছিলো সচেতন মহলের অজানা নয়।

হযরত শায়খ দাঃ বাঃ চতুল ঈদগাহ মাদ্রাসায় শিক্ষা- দীক্ষার  মাধ্যমিক স্তর শেষ করেন।  মেধা, আমল – আখলাক ও সুন্নতি লেবাসের কারণে উস্তাদগণ তাকে খুবই ভালোবাসতেন এবং স্নেহ করতেন। তাঁই উস্তাদগণ তাঁকে উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষার জন্য ১৮৮৯ ইং সনে প্রতিষ্ঠিত সিলেটের কানাইঘাটে দারুল উলুম দেওবন্দের আদর্শ ও শিক্ষা ব্যবস্থার অনুসরণে বাংলাদেশের সর্বপ্রথম দ্বীনী প্রতিষ্টান কানাইঘাট ইসলামিয়া মাদ্রাসায় ( আজকের দারুল উলুম কানাইঘাটে) যাওয়ার জন্য পরামর্শ দেন। পিতা – মাতার সম্মতি লাভের পর অনেক প্রতিকুলতার মাঝেও অবশেষে তিনি পাড়ি জমান ঐতিহ্যবাহী দ্বীনী বিদ্যাপীঠ দারুল উলুম কানাইঘাটে। সেখানে তিনি তিন বছর লেখা- পড়া করেন। শায়খের বাড়ী থেকে কানাইঘাটেরর দুরত্ব প্রায় ১২ কিলোমিটার। রাস্তা বলতে পায়ে হাটার মেঠো পথ, খাল ও নালায় গ্রাম – বাংলার ঐতিহ্যের সেই বাসের সাকো। শীত ও বসন্ত কালে ক্ষেত কাটার পর জমির ড্রাইবেসন দিয়ে বাস চলত। অন্য মওসুমে পায়ে হেঁটে যাতায়াত করতে হতো, পায়ে ব্যথা হতো, গতি মন্থর  হতো কিন্তু হাঁটতে হাঁটতে পথ আর শেষ হতোনা। অভুতপুর্ব দৃশ্য নয়নাভিরাম মানজর অবলোকন করতে করতে শায়খ ছুটে চলতেন যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন অজোপাড়া গাঁয়ের আর দু’ পাশে দিগন্ত বিস্তৃত বিস্তীর্ণ সবুজের সমারোহ অবারিত ফসলের মাঠের বাঁকে বাঁকে বয়ে যাওয়া কাচা রাস্তা দিয়ে। মেঘলা আকাশে হঠাৎ ঝলমলিয়ে ওঠা রোদের মত দ্বীনের এ রবি হাজির হতেন কানাইঘাটের ঐশি কাননের আলোর পথে। পদব্রজে হাঁটার পথে তার মানসপটে যা তিনি কষতেন -আকঁতেন যদি লেখা যেতো তাহলে অনেক আত্মা শান্তি পেতো। উল্লেখ্য যে কানাইঘাট ইসলামিয়া, ঝিংগাবাড়ী ও ফুলবাড়ি মাদ্রাসা সমুহে দাওরায়ে হাদীস খোলা হয়  ১৯৫২ সনের পরে তবে চট্রগ্রামে দারুল উলুম দেওবন্দের পু্র্ণ আদর্শ ও শিক্ষা ব্যবস্থার অনুসরনের ১৯০১ সালে দারুল উলুম মঈনুল ইসলাম হাটহাজারী মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠিত হয় এবং ১৯০৮ ইং হতে দাওরায়ে হাদীস খোলা হয়। সে হিসেবে এটাই বাংলাদেশের প্রথম মাদ্রাসা যেখানে হাদীসের “সিহাহ সিত্তাহ” শিক্ষাদানের ব্যবস্থা করা হয়। এ কারনে হাটহাজারী মাদ্রাসাকে উম্মুল মাদারিছ বলা হয়। এরপর শায়খুল ইসলাম হুসাইন আহমদ মাদানী রাহঃ ১৯২৪ ইংতে সিলেটে আসেন এবং মক্তব মাদ্রাসা নির্মানে ব্রতী হন। যারফলে ১৯৬৪ সাল পর্যন্ত এ দেশে প্রায় ৪৪৩ টি কওমী মাদ্রাসা স্থাপিত  হয়েছিল। পাশাপাশি ৫১ টি মাদ্রাসা ছিল দাওরায়ে হাদীস পর্যন্ত।

দারুল উলুম কানাইঘাটে হযরত শায়খ দাঃ বাঃ সেখানকার আলিয়া ৫ম পর্যন্ত অত্যান্ত সুনাম- কৃতিত্বের  সাথে পড়াশুনা করেন। ঐ সময় থেকেই অধ্যয়নের সাথে সাথে তার চিন্তার দিগন্ত উন্মোচিত হয়, গবেষণার জগতে নিমজ্জিত হন। তার মাঝে পরিলক্ষিত হয় গভীর ভাবগাম্ভীর্যতা। উল্লেখ্য যে হযরত বায়মপুরী রাহঃ এর হজ্বে গমণের সুযোগকে কেন্দ্র করে তার কর্মস্হল গাছবাড়ী জামেউল উলুম মাদ্রাসা কর্তৃপক্ষ গাছবাড়ী মাদ্রাসাকে সরকারি মাদ্রাসায় পরিণত করলে তিনি দারুণভাবে আহত হন। অবশেষে ১৯৫৩ ঈসায়ী সনে কানাইঘাট ইসলামিয়া মাদ্রাসায় যোগদান করেন। প্রথমে মাদ্রাসার নাম পরিবর্তন করতঃ “দারুল উলুম কানাইঘাট” নামকরণ করেন এবং পুর্ব  সিলেট কওমী মাদ্রাসা সমুহের সমন্বয়ে ” পুর্ব সিলেট আযাদ দ্বীনী  আরবী মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ড “গঠন করেন। আলিয়া চাহারমে শায়খ দাঃ বাঃ আবারও অতীতের ন্যায় এ বোর্ডের ফাইনাল পরিক্ষায় ১ নম্বর  হয়ে আলোড়ন সৃষ্টি করেন। বাংলাদেশের কিংবদন্তি আদর্শপুরুষ, আধ্যাত্বিক রাজধানী সিলেটের গৌরব, ১৯৬২ ইং র জাতীয় নির্বাচনে বিপুল ভোটে নির্বাচিত দক্ষ পার্লামেন্টারিয়ান আল্লামা মুশাহিদ বায়মপুরী রাহঃ র খাছ তাওয়াজ্জুহ লাভে ধন্য হয়েছিলেন হযরত শায়খ দাঃ  বাঃ। ইলমে ওহীর সুতিকাগার দারুল উলুম কানাইঘাটের নন্দনকাননে প্রথম দিন থেকেই শায়খ ছিলেন অত্যান্ত সমাদৃত, পরমনন্দিত। শায়খের লজিং ছিল হাজী হাবিবুর রহমান সাহেবের বাড়ীতে। তিনতিনটি বছর এ বাড়ি থেকে গিয়েই লেখা-পড়া করেন। পার্শে ছিল ১৫/১৬ ফিট প্রসস্ত একটি খাল। খালের ওপারে ছিল বায়মপুরী রাহঃ র বাড়ী। আলিয়া পান্জমের বছর বিভিন্ন এখতেলাফে কানাইঘাট মাদ্রাসার লেখা- পড়ায় বেশ ব্যাঘাত ঘটে। এ বৎসরই দারুল উলুম থেকে বিদায় নেন মাওঃ আঃ রব কাসেমী ফিল্লারকান্দী রহ. যার কাছে তিনি হামাছা ও তাফসীরে মাদারিক অধ্যয়ন করেন। আরো বিদায় নেন মোনাযিরে আযম আল্লামা শফিকুল হক আকুনির মেছাব যারকাছে হযরত শায়খ হেদায়াহ ছালিছ পড়েন। তাদের বিদায়ে সাময়িক শিক্ষক সংকটে পড়ে দারুল উলুম কানাইঘাট। যারা নিয়োগ পান তাদেরদারা যখন শায়খের কিতাবাদী চলছিলনা তখন পড়ানোর দায়িত কাধে তুলে নিলেন স্বয়ং বায়মপুরী রহঃ। এই সুবাদে বায়মপুরীর কাছে তাফসীরে মাদারিক ও মাওঃ মুজ্জাম্মিল সাহেবের কাছে হেদায়াহ ছালিছ পড়েন। হযরত বায়মপুরী রহ. শায়খকে তার নিজের লেখা ” মুল্লা মুবিন ” ও তার ব্যক্তিগত “তাহরিরে সম্বট” বই খানা খুশি হয়ে পড়ার জন্য দান করেন।

কিছুদিন পরে চলে আসে রমজান। রমজানের পুর্বে কোন এক সময় শায়খ দাঃ বাঃ চিঠি লিখেন হাটহাজারীর মুহতামিম শায়খ মাওঃ আব্দুল ওয়াহ্হাব রহ.’র কাছে। নিজের পঠিত কয়েকটি কিতাবের নাম উল্লেখ করে ভর্তির আগ্রহ পেশ করে লেখা চিঠির জবাব দানের জন্য পোষ্ট কার্ড ও সঙ্গে পাঠান। অপ্রত্যাশিত ভাবে সেই চিঠির জবাব ও দেন হাটহাজারীর মুহতারাম মুহতামিম সাহেব এবং শায়খকে দাওরায়ে হাদীসে ভর্তির সুযোগ দিবেন বলেও আশ্বস্ত করেন। আল্লামা আব্দুল ওয়াহ্হাব সাহেব কোনদিন মাদ্রাসায় থাকবেন আর কোনদিন থাকবেন না তাও পত্রে উল্লেখ করে শায়খকে সাক্ষাতের দিনক্ষণ ঠিক করে দেন। হযরত শায়খ ১৩৮৫/৮৬ হিজরীতে রমজানের পর উচ্চশিক্ষা লাভের উদ্দেশ্যে হাটহাজারীর পানে যাত্রা করেন এবং সে মাদ্রাসার সার্বিক চিত্র দেখে তিনি মূগ্ধ হন। চিঠি প্রেরণের প্রায় তিনমাস পর হাটহাজারীর মুহতামিম সাহেবের সাথে সাক্ষাত হলেও তিনিই যে চিঠির প্রেরক সে পরিচয় না দিয়ে ভর্তি হন। ১ম বৎসরে মুখতাসারুল মা’য়ানী, সুল্লাম, মুল্লা হাসান ও মাকামাতে হারীরীসহ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ  ঘন্টা নেন। ২য় বৎসর তাওজীহ, মুসাল্লামুস সুবুত, জালালাইন, মিশকাত, খেয়ালির ঘন্টা করেন। পরবর্তী বৎসর দাওরায়ে হাদীসের ক্লাসে ভর্তি হন। ২২ বৎসর বয়সে ১৩৮৮/৮৯ হিজরীতে দাওরায়ে হাদীসের সনদ যখন লাভ করেন তখন শায়খের দাড়ি পুরোমাত্রায় উঠেনি এবং এবৎসরই বাবার ১ম পুত্র হিসাবে বিয়ের পিড়িতে বসেন। শায়খুল মাশায়েখ শায়খুল হাদীস আল্লামা আঃ কাইয়ুম সাহেবের কাছে বুখারী শরীফ কামিল অধ্যয়ন করেন। মুফতি শায়খ আহমদুল হক সাহেবের কাছে মুসলিম শরীফ কামিল, মাওঃ আব্দুল আজিজ সাহেবের কাছে তিরমিজি শরীফ কামিল, শায়খ আল্লামা জুনায়দ বাবুনগরী হাফিজাহুল্লাহর পিতা তানযীমুল আসতাতের মুসান্নিফ, হাটহাজারী মাদ্রাসার শায়খুত তাফসীর আল্লামা শায়খ আবুল হাসান সাহেবের কাছে নাসায়ী শরীফ ও ত্বাহাবী শরীফ, হযরত শায়খ মোহাম্মদ আলী সাহেবের কাছে ইবনে মাজাহ শরীফ ও মুয়াত্তা মুহাম্মদ ও বর্তমান প্রিন্সিপাল আমীরে হেফাজত, খলিফায়ে মদনী হযরত শায়খ আহমদ শফী হাফিজাহুল্লাহ’র কাছে মুয়াত্তা মালিক, তাওজীহ, মুসাল্লামুস সুবুত ও জালালাইন অধ্যয়ন করেন। পীর সাহেব হুজুর নামে খ্যাত হযরত মাওঃ হাফিজুর রহমান সাহেবের কাছে মিশকাত ছানী পড়েন। যিনি হযরত শায়খের উপস্থিতি ছাড়া সবক পড়ানো শুরু করতেন না, কুনুযে এ’যাযিয়াহ ও মুসাল্লামের সংকলক হযরত মুহাম্মদ আলী সাহেব দরসে হযরত শায়খকে তাঁর ডানদিকের ব্রেঞ্চে বসাতেন। কানাইঘাটে ফিল্লার হুজুর হযরত মাওঃ আব্দুর রব কাসিমীর কাছে হামাছাহ, তাফসীরে মাদারিকুত তানযীল উরফে তাফসীরে নাসাফী ও বিশিষ্ট পার্লামেন্টারিয়ান আল্লামা বায়মপুরী রহ. ‘র ভাই হযরতুল আল্লাম মুজাম্মিল সাহেবের কাছে হেদায়াহ ৩য় খন্ড ও মুফাস্সল এবং বায়মপুরী রহ. ‘র কাছে তাফসীরে নাসাফীর অবশিষ্টাংশ অধ্যয়ন করেন।

উলুমুল কোরআনের মুসান্নিফ/ রচয়িতা দেওবন্দের শায়খুত তাফসীর আল্লামা শামসুল হক আফগানী রহ. হাটহাজারী মাদ্রাসা সফরের সময় বুখারী শরীফের পাঠদান কালে হযরত শায়খ দাঃ বাঃ বুখারী শরীফের ইবারত পড়ে তার নেক নজর কাড়তে সক্ষম হন ও হাদীসের ইজাজত লাভ করেন। মাগরীবী পাকিস্তানের মুফতিয়ে আযম আল্লামা মুফতি শফি রহঃ ও হাটহাজারী সফরে আসেন। তিনিও সফরকালে বুখারী শরীফের পাঠদান করলে ইবারত পড়েন হযরত শায়খ দাঃ বাঃ। শায়খের ইবারত পড়া তিনি মনযোগ সহকারে শ্রবণ করেন এবং আনন্দচিত্তে হযরত শায়খকে হাদীসের ইজাজত দান করেন। আরেকবার হাটহাজারী মাদ্রাসা ভিজিটে আসেন মদীনা ইউনিভার্সিটির শায়খুত তাফসীর  আল্লামা শায়খ উমর হাফিজাহুল্লাহ। তিনিও বুখারী শরীফের দারস দান করেন। আর হযরত শায়খই ইবারত পড়েন ও ইলমে হাদীসের ইজাজত লাভ করেন। হযরত শায়খ জীবনে বহুবার হজ্জব্রত পালন করেছেন। স্বপরিবারেও হজ্জ পালন করেন। ২০০৮ সালের কথা, শায়খ হজ্জব্রত পালনকালে মসজিদে নববীর ২য় তলায় قسم المخطوطات -চিঠিপত্র সংরক্ষণ বিভাগের কক্ষে একফাঁকে প্রবেশ করেন এবং রোমের রাজা হিরাক্লিয়াসের প্রতি প্রিয় নবীর প্রেরিত পত্রের/ চিঠির কোন হাতে লেখা কপি থাকলে দেখার আগ্রহ প্রকাশ করেন। তখন এই বিভাগের দায়িত্বরত সবাই শায়খের দিকে বিষ্ময়ভরা চোখে অপলক নেত্রে হেরিতে থাকে। অনেকক্ষণ অপেক্ষার পর যখন শায়খ নীচে নেমে আসেন তখন উপর থেকে দ্রুত নেমে আসেন একজন সুদর্শন যুবক ( যিনি ছিলেন একজন বড়মাপের আলেম ও বিমানের একজন পাইলট) মাহদী বিন সালিম আনসারী দাঃ বাঃ সহ তার সঙ্গীরা এবং মসজিদে নববীর খালি জায়গায় ১০ টি হাদীসের কিতাব থেকে শায়খকে সেই মাহদী আনসারী সনদ ও মতনসহ ২০টি হাদীস শুনান ও শায়খের সনদে বর্ণনার ইজাজত প্রার্থনা করেন। শায়খ নিজেকে বাঙ্গালী ও আজমী বলে তার স্বভাবজাত কসর নফসী হিসাবে উপযুক্ত নয় বললেও তাঁর পীড়াপীড়িতে অবশেষে সনদ ও ইজাজত দিতে বাধ্য হন। শায়খের মদীনা ইউনিভার্সিটির শায়খ উমরের প্রসঙ্গ আসলে মাহদী বলে উঠেন শায়খ উমর সেখানে এখনও বিদ্যমান আছেন। হযরত শায়খ মক্কাতুল মুকাররমায় অবস্থিত জামেয়া উম্মুল কুরা সফরের আমন্ত্রণ পেলেও শেষ পর্যন্ত সময় সল্পতায় যেতে পারেননি।

২২ বছর বয়সে১৩৮৯ হিজরীতে দাওরায়ে হাদীসের সনদ লাভ করেন। শিক্ষা সমাপনের পর বাড়িতে আসেন এবং বিবাহের পিড়িতে বসেন। দাওরায়ে হাদীসের বছর শায়খের লেখাপড়াবস্থায় জামেয়া রেঙ্গার পক্ষ থেকে শায়খুল হাদীসের চাহিদা পেশ করলে  হাটহাজারী মাদ্রাসার বর্তমান মুহতামিম আল্লামা আহমদ শফি দাঃ বাঃ এর নির্দেশে ১৩৯০ হিজরীতে জামেয়া রেঙ্গার শায়খুল হাদীসের মসনদে আসীন হয়ে কর্মজীবনের সুচনা করেন। রেঙ্গা মাদ্রাসায় তখন সিলেট থেকে ট্রেনযোগে মোগলাবাজার রেল ষ্টেশনে নেমে আসতে হতো। হযরত আহমদ শফি হাফিজাহুল্লাহ হযরত শায়খকে নিজের সঙ্গে করে রেঙ্গা মাদ্রাসায় নিয়ে আসার উদ্দেশ্যে সিলেট রেল ষ্টেশনে পৌঁছে ট্রেন মিছ করলে আমীরে হেফাজত চলে যান সুলেমান খাঁ’র বাসায় এবং শায়খকে হাটহাজারী মাদ্রাসার বাৎসরিক রিপোর্টের কপি সঙ্গে দিয়ে পাঠিয়ে দেন শায়খে রেঙ্গা রহ.’র খেদমতে। সেই ১৩৯০ হিজরী ১৯৬৯ ঈসায়ী থেকে সূদীর্ঘকাল যাবৎ জামেয়া রেঙ্গার শায়খুল হাদীস পদে নিরবচ্ছিন্ন অবিরাম খেদমত আঞ্জাম দিয়েছিলেন তিনি।

তিনি গত ১ জুন রাত ২টার সময় নিজ বাড়িতে ইন্তেকাল করেন।