ইউরোপে জড়বিজ্ঞানের অনেক উন্নতি হয়েছে। সে উন্নতির সুফল সারাবিশ্বই ভোগ করছে। মানুষের দৃষ্টিশক্তিও তাতে আলো পেয়েছে। সে আলোয় মানুষ বস্তুগত নানা সুবিধা চাক্ষুষ করতে পারছে। দেখছে জাগতিক হাজারও সুযোগ-সুবিধা। মানুষ সেসব সুযোগ-সুবিধা ভোগে আজ মাতোয়ারা। তারা তা ভোগ করছে অন্ধের মত, বিশেষত ইউরোপের মানুষ। সেইসঙ্গে ইউরোপ দ্বারা যাদের মন-মানসিকতা তৈরি, তারাও। এ শ্রেণীর মানুষ অন্ধই বটে। তারা চর্মচক্ষে আলো পেয়েছে বটে, কিন্তু তাদের দিব্যদৃষ্টিতে আলো পড়েনি। মনের চোখ যাদের কানা, প্রকৃত অন্ধ তারাই। কুরআন মাজীদ বলছে-
فَاِنَّهَا لَا تَعْمَی الْاَبْصَارُ وَ لٰكِنْ تَعْمَی الْقُلُوْبُ الَّتِیْ فِی الصُّدُوْرِ.
প্রকৃতপক্ষে চোখ অন্ধ হয় না, বরং অন্ধ হয় সেই হৃদয়, যা বক্ষদেশে বিরাজ করে। -সূরা হজ¦ (২২) : ৪৬
অন্তর্দৃষ্টি আলো পায় নবুওয়াতের আলোকধারা থেকে। পশ্চিমা জগৎ হযরত ঈসা-মসীহ আলাইহিস সালামের সঙ্গে নিজেদের সম্পর্ক গড়েছিল বটে, কিন্তু তাঁর নবুওয়াতের আলো গ্রহণের সুযোগ তাদের হয়নি। কারণ ততদিনে পৌলের প্রতারণায় সে আলোর স্থান দখল করে নিয়েছিল পৌত্তলিকতার অন্ধকার। তারা সে অন্ধকারেই গা ভাসাল। ফলে তাদের মনোজগত আর আলোকের সন্ধান পেল না। অন্ধকারের ভেতরই তাদের দিন কাটতে থাকল। ইত্যবসরে উদিত হল নবুওয়াতে মুহাম্মাদীর সূর্য। তার আলোয় এশিয়া-আফ্রিকা উদ্ভাসিত হল। কিন্তু ইউরোপ নিজ দরজা-জানালা বন্ধ করে রাখল। তার অন্তরলোকে সে আলো প্রবেশ করতে দিল না। তাই সব জায়গা থেকে জুলমাত ও জাহিলিয়াতের অবসান ঘটলেও ইউরোপের জাহিলিয়াত আর খতম হল না।
সে জাহিলিয়াতেরই বীভৎস প্রকাশ আমরা দেখলাম নিউজিল্যান্ডের ক্রাইস্টচার্চে, যদিও দেশটি ইওরোপের সীমানা থেকে বহুদূরে। ক্রাইস্টচার্চ- খৃষ্টমন্দির। নগরের এক বাহারি নামই বটে। এমন বাহারি নাম খৃষ্টজগতের পূব-পশ্চিম সবখানেই আছে। কিন্তু নামসর্বস্বতাই এ জাতির বিশেষত্ব। তারা যিশুখৃষ্টের পরিচয়ে পরিচিত, কিন্তু তাঁর শিক্ষার সাথে সম্পর্করহিত। তাঁর শিক্ষা ছিল তাওহীদ ও একত্ববাদী। এরা বিশ্বাসী ত্রিত্ববাদ ও পৌত্তলিকতায়। তাঁর শিক্ষা ছিল অহিংসা। এরা চরম জিঘাংসু। তিনি ছিলেন ক্ষমাশীল। এরা আগ্রাসী। অন্যসব নবীর মতই তিনি ছিলেন উদার ও মানবতাবাদী, কিন্তু আজকের খৃষ্টজগত চরম সংকীর্ণ ও বর্ণবাদী।
নবুওয়াতী শিক্ষায় বর্ণবাদের কোনও স্থান নেই, শারীরিক রঙের তো নয়ই। কখনও কোনও আসমানী ধর্ম মানুষের সাদাকালো রঙে প্রভেদ করেনি। তা ইউরোপের মানুষ খৃষ্টান হওয়া সত্ত্বেও আজও কেন বর্ণবাদী? তারা বর্ণবাদী এ কারণে যে, হযরত ঈসা-মসীহ আলাইহিস সালামের মূল শিক্ষার সঙ্গে তাদের কোনও সম্পর্ক নেই। তাঁর নামে যা আছে তা কেবলই সেন্ট পৌলের নসীহত। সে নসীহতের সঙ্গে আসমানী শিক্ষার সম্পর্ক না থাকায় তা পশ্চিমাদের মনের অন্ধকার ঘুচাতে পারেনি। তারা সাদা চামড়ার মানুষ বটে, কিন্তু তাদের মন নিকষ কালো। তা বর্ণবাদের জাহিলিয়াতে আচ্ছন্ন। যে কারণে সাদাকেই তারা শ্রেষ্ঠজ্ঞান করে। কেবল শ্রেষ্ঠই নয়, তাদের দৃষ্টিতে যাদের চামড়া সাদা তারাই যেন মানুষ, কালো চামড়ার লোক অন্য কোনও জীব। মানুষ হলেও পূর্ণাঙ্গ মানুষ নয়; ঊনমানুষ মাত্র, যাদের নেতৃত্ব দেওয়ার অধিকার তো নেই-ই, এমনকি মানুষ হিসেবে তারা শ্বেতাঙ্গদের সমান অধিকার রাখে না; বরং সাদাদের সঙ্গে মিশে থাকারও কোনও অধিকার তাদের নেই। অর্থাৎ মনেপ্রাণে তারা শ্বেতাঙ্গ আধিপত্যে বিশ্বাসী। সেই আধিপত্যবাদের হিংস্র ও নগ্ন প্রকাশই ঘটে গেল ক্রাইস্টচার্চের নূর মসজিদে। শ্বেতাঙ্গ আধিপত্যবাদী হিংস্রতার এটাই একমাত্র ঘটনা নয়। এর আগে শ্বেতাঙ্গ বন্দুকধারীর গুলিতে নরওয়েতে ৭৭ জন প্রাণ হারিয়েছে। আমেরিকার বিভিন্ন স্থানে শ্বেতাঙ্গ চরমপন্থীর গুলিতে বহু অশ্বেতাঙ্গের প্রাণহানি হয়েছে।
এসব নরঘাতকের অন্তরে বর্ণবিদ্বেষ এত প্রবল যে, অশ্বেতাঙ্গ হত্যায় তাদের বুক এতটুকু কাঁপে না; বরং তাতে যেন তারা বুকে আরাম বোধ করে। নিউজিল্যান্ডের হত্যাকা- দ্বারা এমনটাই অনুমান করা যায়। খবরে প্রকাশ-শ্বেতাঙ্গ বন্দুকধারীর উপর্যুপরি গুলিতে একের পর এক লাশ পড়তে থাকে, লাশের স্তুপ বনে যায়, তারপরও সেই স্তুপের উপর সে একের পর এক গুলি চালাতে থাকে। গুলিতে আহতরা হামাগুড়ি দিয়ে পালানোর চেষ্টা করে। তাদের উপরও সে গুলি চালায়। সে একদম নির্বিকার। গুলি চালাতে থাকে ঠাণ্ডা মাথায়। হেলমেটে ভিডিও রেকর্ডার রেখে নিজ নৃশংসতার ছবিও তুলতে থাকে। এর দ্বারাই অনুমান করা যায় কী পরিমাণ অশ্বেতাঙ্গবিদ্বেষ সে নিজ অন্তরে পোষণ করে।
কালোদের প্রতি এহেন বিদ্বেষ সাদা চামড়ার মানুষদের মধ্যে নতুন জন্ম নেওয়া কোনও খাসলাত নয়। এর ইতিহাস অনেক পুরোনো। বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদ সারা বিশ্বে যখন তাদের কলোনি বিস্তার করে, তখনও তারা অশ্বেতাঙ্গদের প্রতি অমানবিক আচরণ করত। তাদেরকে পশুর মত বেচাকেনা করত। দাস ব্যবসা ছিল তাদের অর্থনৈতিক উন্নয়নের একটি বড় উৎস। তারা সেসব দাসদের বিভিন্ন কলকারখানা, কয়লার খনি, লোহার খনি, সোনার খনি, চা-বাগান, নীলচাষ ইত্যাদির শ্রমসাধ্য কাজে ব্যবহার করত এবং তাতে তাদের প্রতি যে অমানুষিক আচরণ করা হত, তাতে হাজার হাজার শ্রমিকের অকাল প্রাণবিয়োগ ঘটত। আমাদের এ দেশে নীলকরদের অত্যাচার মানবেতিহাসের এক কালো অধ্যায়। বস্তুত পশ্চিমা ঔপনিবেশের চরম উৎকর্ষ সাধিতই হয়েছিল বিশ্বব্যাপী লাখ লাখ অশ্বেতাঙ্গ হত্যার বুনিয়াদে।
পরবর্তীকালে পশ্চিমা দেশগুলোতে শ্বেতাঙ্গ আধিপত্যবাদ ক্রমান্বয়ে আরও সহিংস হয়ে উঠতে থাকে। ঊনবিংশ ও বিংশ শতাব্দীতে উগ্র শ্বেতাঙ্গ শ্রেষ্ঠত্ববাদী সংগঠন কে.কে.কে (ক্লু ক্লাক্স ক্লান) আমেরিকায় কৃষ্ণাঙ্গ হত্যায় মেতে ওঠে। তাদের আক্রমণে লাখ লাখ কৃষ্ণাঙ্গ প্রাণ হারায়। একপর্যায়ে ভারতের হিন্দু বর্ণবাদী বজরঙ্গ ও আরএসএস-এর মত এ সংগঠনটিও মার্কিন শ্বেতাঙ্গদের ব্যাপক সমর্থন লাভ করে। বর্তমানে স্বতন্ত্রভাবে এ সংগঠনটির তেমন একটা তৎপরতা না থাকলেও ইউরোপ-আমেরিকায় শ্বেত বর্ণবাদ আজ এক প্রতিষ্ঠিত বাস্তবতা। গোটা শ্বেত সমাজই আজ অমানবিক এ দৃষ্টিভঙ্গীতে চরমভাবে আচ্ছন্ন। ফলে তাদের দৃষ্টিতে অশ্বেতাঙ্গ হত্যা, তা গণহত্যাই হোক না কেন, এমন কোনও অপরাধ নয়, যা সর্বোচ্চ গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করতে হবে, যদিও অশ্বেতাঙ্গ কোনও ব্যক্তির হাতে সাদা চামড়ার কারও গায়ে সামান্য একটু আঁচড়ও মারাত্মক খুন-খারাবির পর্যায়ে গণ্য হয়ে থাকে।
তাদের দৃষ্টিতে সাধারণত অশ্বেতাঙ্গ বলতে ইসলাম ধর্ম অনুসারীদেরই বোঝায়। বাস্তবিকপক্ষে এ ধর্মের অনুসারীদের মধ্যে শ্বেতাঙ্গ অপেক্ষা অশ্বেতাঙ্গই বেশি। তাদের কাছে অশ্বেতাঙ্গ ও মুসলিম অনেকটা সমার্থবোধক। কাজেই অশ্বেতাঙ্গবিদ্বেষ মুসলিমবিদ্বেষেরই নামান্তর। মুসলিমদের গায়ের চামড়া যেহেতু সাদা নয়, তাই তারা যেন মনুষ্য পদবাচ্যই নয়। এদের প্রতি পশুর মত আচরণ কর, চাই তো তুচ্ছ তুচ্ছ কারণে খুন করে ফেল। তাদের এ ঘৃণা বিষাক্ত রূপ লাভ করেছে কিছুটা রাজনৈতিক কারণেও। এককালে তারা সারা মুসলিম জাহান কবজা করেছিল। সেই কবজা থেকে মুক্তির লক্ষ্যে মুসলিম জাতি প্রাণপণ লড়াই করেছে। তা কেন তারা লড়াই করবে? তাদের চামড়া যখন সাদা নয়, তখন সাদাদের অধীন হয়ে থাকাই তো তাদের নিয়তি। সে অধীনতার শিকল ছিন্ন করতে চাওয়া চরম বেআদবী। তাই তাদের দমন করার জন্য সবরকম লোমহর্ষক জুলুম-নিপীড়ন তাদের উপর চালানো হয়েছে। তা সত্ত্বেও যখন দমিয়ে রাখা যায়নি এবং অগত্যা তাদের দেশ তাদের হাতে ছেড়ে দিয়ে আপন দেশে ফিরে যেতে হয়েছে, তখন পরাজয়ের বেদনা তাদের অশ্বেতাঙ্গবিদ্বেষ আরও লেলিহান করে তুলেছে। এর থেকেই তারা শুরু করেছে নতুন খেলা- ভূ-রাজনৈতিক খেলা। এ খেলায় তারা সবরকম বেঈমানী ও বিশ্বাসঘাতকতাকে জায়েয করে নিয়েছে।
আজ সারা বিশ্বে যত অশান্তি, যত সন্ত্রাস ও সহিংসতা, তা তাদের সেই বেঈমানীসুলভ কারসাজিরই ফল। তারা ফিলিস্তীনের জনগণকে বাস্তুহারা করেছে। তারা স্বাধীনতাকামী কাশ্মিরীদেরকে পরাধীন করে রেখেছে। আফগানিস্তান, আরাকান, লেবানন, সিরিয়া, সোমালিয়া, উইঘুর, বসনিয়া, চেচনিয়া, ইরাক, লিবিয়াসহ পৃথিবীর দেশে দেশে অশান্তির আগুন জ¦ালিয়ে রেখেছে। কারণ একটাই- তারা অশ্বেতাঙ্গ এবং তারা মুসলিম। তাদের ভিটেমাটি ও তাদের মানবাধিকার নিয়ে নিজেদের মধ্যে ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় মেতে থাকাটা যেন শ্বেতাঙ্গদের জন্মগত অধিকার। তাদের সে ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় নিজেদের অস্তিত্ব বিসর্জন দেওয়া এসব দেশের জনসাধারণের অবশ্যকর্তব্য। সে কর্তব্য পালন না করে যদি অস্তিত্ব রক্ষার জন্য কিছুমাত্রও নড়াচড়া করে, তবে তা কঠিনতম পাপ। এরূপ নড়াচড়া সন্ত্রাস, সহিংসতা এবং জঙ্গিবাদ নামে আখ্যায়িত হতে বাধ্য।
এ জাতীয় চরমপন্থী নাম দিয়ে আজ দুনিয়ার শ্বেতাঙ্গ আধিপত্যবাদীরা বিভিন্ন দেশের মুসলিম স্বাধীনতাকামীদের নিষ্ঠুরভাবে দমন করছে। আমরা অস্বীকার করব না যে, ইসলাম প্রতিষ্ঠার নামে গঠিত কোনও কোনও চরমপন্থী সংগঠন সম্পর্কে বিভিন্ন স্থানে নির্বিচার নরহত্যার অভিযোগ আছে। তার মধ্যে কোনও কোনও অভিযোগ অমূলকও নয়। কিন্তু জনবিচ্ছিন্ন এসব ঘটনাকে কিছুতেই মুসলিম উম্মাহ’র জাতীয় চরিত্র হিসেবে আখ্যায়িত করা যায় না এবং একে ইসলামী শিক্ষা-দীক্ষার সাথে সম্পৃক্ত করাটাও ইনসাফসম্মত কথা হতে পারে না।
নির্বিচার মানুষ হত্যা করে ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার কোনও ধারণা কুরআন-সুন্নাহে দেওয়া হয়নি। ইসলামের অনুসারীগণ কোনও কালে তা করেওনি। সবকালেই ইসলামের প্রচার ও প্রতিষ্ঠা দা‘ওয়াতী পন্থায়ই হয়েছে। জিহাদ (দুঃখজনকভাবে যে মোবারক আমলটি এখন অবহেলিত) তা তো ইলায়ে কালিমাতিল্লাহর জন্য এবং ফিতনা ও ফাসাদ দূর করার জন্য। মানুষকে ইসলাম গ্রহণে বাধ্য করার জন্য নয়। ইসলামের দাওয়াত ও ইসলামের মানবতাবাদী শিক্ষায় উদ্বুদ্ধ হয়েই দিকে দিকে মানুষ ইসলাম গ্রহণ করেছে। জুলুম-নিপীড়নে অতিষ্ঠ আদমসন্তান কুরআন-সুন্নাহ’র ইনসাফ ও সাম্যবাদের শিক্ষায় মুগ্ধ হয়েই ইসলামের ছায়াতলে আশ্রয় নিয়েছে।
ইসলামের দৃষ্টিতে পৃথিবীর সমস্ত মানুষ এক আদমসন্তান। সেই হিসেবে তারা সকলে ভাই ভাই। ভ্রাতৃত্বের বন্ধনে আবদ্ধ থাকায় দুনিয়ার কোনও শ্রেণীর মানুষের উপর অন্যায় আচরণ করার কোনও অবকাশ নেই। এমনকি সঙ্গত কারণে কেউ যদি প্রতিপক্ষও হয়ে যায়, তবুও তার উপর জুলুম করার কোনও বৈধতা ইসলাম দেয় না। যে সকল কারণে একের দ্বারা অন্যে নিপীড়িত হয়, ইসলাম তার মূল উপড়ে ফেলেছে। তার মধ্যে বর্ণবাদ বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। মহান এ দ্বীনে কোনওরকম বর্ণবাদের স্থান নেই। ঘোষিত হয়েছে, “অনারবীর উপর আরব ব্যক্তির কোনও শ্রেষ্ঠত্ব নেই।” আরও বলা হয়েছে, “কালোর উপর লাল (বা সাদা)-এর বাড়তি কোনও মর্যাদা নেই।” ইসলামে মর্যাদার ভিত্তি কেবলই তাকওয়া ও আল্লাহভীতির উপর। ধন-সম্পদ, বংশ-গোত্র, ক্ষমতা, ভাষা, অঞ্চল, পেশা ইত্যাদি কোনওকিছুই মর্যাদার মাপকাঠি নয়।
ইসলামে কৃষ্ণাঙ্গ বিলাল রা. ও শ্বেতাঙ্গ আবূ যার রা.-এর মধ্যে মর্যাদার কোনও তারতম্য নেই। কৃষ্ণাঙ্গ মুসলিম ও শ্বেতাঙ্গ মুসলিম একই মসজিদে একই কাতারে দাঁড়িয়ে নামায পড়ে। তারা একই হাজারে আসওয়াদে চুমু খায়। যোগ্যতার ভিত্তিতে একজন কালো চামড়ার লোক সাদা চামড়ার লোকদের ইমাম হতে পারে। তাদের মধ্যে আত্মীয়তায় কোনও বাধা নেই। চাকরি ও সামাজিক মান-মর্যাদায় কোনও প্রভেদ নেই। ইসলামের শত শত বছরের ইতিহাসে তারা একই সমাজের সমমর্যাদাসম্পন্ন সদস্যরূপে সহাবস্থান করে এসেছে। সাদা-কালোর প্রভেদ তাদের অন্তর থেকে এমনভাবে মুছে গেছে যে, সামাজিক কোনও পজিশনেই বর্ণের প্রশ্ন তাদের মাথায় আসে না। এমনকি কোনও অমুসলিমের ক্ষেত্রেও তার গায়ের রঙ কী- কোনও মুসলিম কখনও তা বিবেচনায় আনে না। এভাবে অন্যান্য বর্ণবৈষম্যের মত গায়ের রঙভিত্তিক বর্ণবাদও ইসলাম ও মুসলিম সমাজ থেকে চিরতরে নির্বাসিত, যে কারণে বর্ণভিত্তিক শ্রেষ্ঠত্বের ধারণা এ জাতির মধ্যে সম্পূর্ণ অনুপস্থিত। ফলে এ নিয়ে কোনও উগ্রতা বা চরমপন্থার অবকাশ মুসলিম-সমাজে নেই। তাদের নিজেদের মধ্যে এ নিয়ে কখনও কোথাও কোনও সহিংসতা কদাপি দেখা দেয়নি। এমনকি এ দৃষ্টিকোণ থেকে অন্য কোনও জাতির উপরও তারা কখনও শারীরিক তো নয়ই, মানসিক আঘাতও হানেনি। কিন্তু খৃষ্টজগতের কী অবস্থা?
যে খৃষ্টজগতে, বিশেষত পশ্চিমা দুনিয়ায় আজ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির জয়জয়কার এবং মুহুর্মুহু মানবাধিকারের জয়ধ্বনি, বর্ণবাদের ব্যাপারে আজও তা হাজারও বছর আগের মতই অন্ধকারাচ্ছন্ন। অন্য ধর্মাবলম্বী তো দূরের কথা, আপন ধর্মের অনুসারী একজন কৃষ্ণাঙ্গও শ্বেতাঙ্গ খৃষ্টানের চোখে সমমর্যাদা লাভের অধিকার রাখে না। সমাজের কোনও ক্ষেত্রেই নয়। তার জন্য বিদ্যালয় হবে আলাদা, অন্ততপক্ষে বসার স্থান তো আলাদা হতেই হবে। এমনকি কালোদের গির্জাও হতে হবে পৃথক। সাদাদের গির্জায় কৃষ্ণাঙ্গ খৃষ্টানের প্রবেশাধিকার নেই। এ বর্ণবৈষম্যের কারণে আজও সাদা চামড়ার হাতে কালো চামড়া নিগৃহীত। ইউরোপ-আমেরিকায় এ জুলুম-নিপীড়ন নিত্যদিনের ঘটনা।
কেবল গাত্রবর্ণে পার্থক্য থাকার কারণে যারা স্বধর্মীয়দের প্রতি জুলুম-নির্যাতন করে, কথায় কথায় গুলি চালায়, অন্য ধর্মের কৃষ্ণাঙ্গ বা তামাটে লোকেরা তাদের কাছে কী নিরাপত্তা ভোগ করতে পারে বা কী মানবাধিকার আশা করতে পারে? তাদের হাতে কোনও অশ্বেতাঙ্গের জান, মাল ও ইজ্জতের যে নিরাপত্তা নেই, সবশেষে ক্রাইস্টচার্চের ঘটনাও চোখে আঙ্গুল দিয়ে তা দেখিয়ে দিল।
সত্য বটে, এ ঘটনার পর নিউজিল্যান্ড দেশটি মুসলিম জাতির প্রতি সহমর্মিতা দেখিয়েছে। এজন্য মুসলিম উম্মাহ খুঁটিনাটি বিশ্লেষণের দিকে না গিয়ে তাদের কৃতজ্ঞতা জানাতেই পারে। অকুণ্ঠভাবে তা জানাচ্ছেও বৈ কি। কিন্তু লক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে, এ ব্যাপারে খৃষ্টানদুনিয়ার সাধারণ প্রতিক্রিয়া কী? ঘাতকের প্রতি মৃদু তিরষ্কারধ্বনি তাদের পক্ষ থেকে অনেকখানি করে ফেলাই গণ্য হবে। তাদের কাছে তো এরূপ গুলিবাজদের জাতীয় বীররূপেই বরিত হওয়ার কথা। এরূপ হঠকারী খুন-খারাবিতে লিপ্ত হয়ে প্রাণে মারা যাওয়া দুষ্কৃতকারীদের শহীদী মর্যাদা দেওয়া বর্ণবাদী এ জাতির পুরোনো ঐতিহ্য। হাজার বছর আগে থেকেই তাদের মধ্যে এ সংস্কৃতি চলে এসেছে। সূচনাটা মুসলিম স্পেনে। তাদের একেকজন মসজিদের সামনে বা কোনও মুসলিম সমাবেশে গিয়ে মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে গালাগাল করা কিংবা অন্য কোনও কদর্য আচরণ দ্বারা সংঘাতের সূচনা করত। পরিণতিতে সেই ব্যক্তি মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত হলে জাতীয় বীর ও শহীদরূপে আখ্যায়িত হত। পায়ে পা লাগিয়ে ফ্যাসাদ সৃষ্টির এহেন তৎপরতা কালক্রমে একটা আন্দোলনের রূপ নেয়। শান্তি-শৃংখলা নষ্টের আত্মঘাতী তৎপরতার সূচনা তখন থেকেই। পশ্চিমাদের গুয়েভল্সীয় প্রচারণা নীতির কারণে এখন আত্মঘাতী হামলার কথা বললেই মানুষের দৃষ্টি চলে যায় স্বাধীকার সংগ্রামে লড়াইরত কোনও কর্মী এবং ক্ষেত্রবিশেষে কোনও মুসলিম চরমপন্থীর দিকে। অথচ অন্যায্য কার্যসিদ্ধিকল্পে আত্মঘাতী আক্রমণসহ চরমপন্থা অবলম্বনের ধারাটির সূচনা খোদ পশ্চিমা দুনিয়াতেই। তারাই প্রথমে আপন দেশে এ ধারাটির পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেছে, তারপর ইসলামী দুনিয়ায় এটি সাপ্লাই করেছে। অতপর মুসলিম পদবাচ্যধারী কারও পক্ষ থেকে এ জাতীয় কোনও কর্মকা- হয়ে গেলে সেজন্য তারা গোটা মুসলিম জাতিকে দোষারোপ করছে। যেন গোটা এ জাতি সম্মিলিতভাবে কাজটি করেছে এবং এ জাতির সকলেই চরমপন্থী ও জঙ্গিবাদী।
বস্তুত ক্রুসেডার জাতির এটাই আসল রূপ। তারা তাদের দেশে ইসলাম ও ইসলামের নবীকে কিভাবে চিত্রিত করেছে? চরিত্র হননের এমন কোন্ দিক আছে, যা দ্বারা তারা মানবজাতির গৌরব হযরত মুহাম্মাদ মুস্তফা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রতি আঘাত হানেনি? কুরআনের মত এক অথৈ জ্ঞানভাণ্ডার ও অলৌকিক গ্রন্থকে বাতিল করে দেওয়ার দূরভিসন্ধিতে মিথ্যাচার করার যতটুকু সক্ষমতা তারা ধারণ করে, তার সবটাই ব্যবহার করে ছেড়েছে। ইসলাম তো তাদের কাছে কোনও ধর্ম হওয়ারই যোগ্যতা রাখে না। এর বিরুদ্ধে তাদের গোটা জাতিকে বিদ্বিষ্ট করে তোলার জন্য অপপ্রচারের একশেষ করেছে। এরই কুফল যে, সারা পশ্চিমা জগৎ পুরুষাণুক্রমে ইসলাম, ইসলামের নবী, ইসলামের ধর্মগ্রন্থ ও ইসলামের প্রতিটি বিষয় চরম ঘৃণার চোখে দেখে আসছে। তাদের দৃষ্টিতে মানুষের ইতিহাসে এসবের চেয়ে মন্দ জিনিস আর কখনও দেখা যায়নি। নিজ জাতির সামনে ইসলাম ও ইসলামের নবীকে কদর্যরূপে তুলে ধরার জন্য তাদের অনেকেই কলমের কসরত করেছে। তাদের সেসব রচিত বই-পুস্তক শুধুই গরলে ভরা। সে বিষপত্র যারা নাড়াচাড়া করেছে তারা এই ভেবে শিউরে ওঠে যে, মানুষ আল্লাহপ্রদত্ত সক্ষমতার অসৎ ব্যবহারে এতটা নিচেও নামতে পারে! এমনসব আবর্জনা উৎপাদনেও মানুষ আপন সৃজনশীলতার অপচয় করতে পারে! হাঁ, কর্মদক্ষতার এই লোমহর্ষক অপচয় দ্বারা তারা আর কিছু না পারুক, তারা যুগ-যুগান্ত লালিত একটা কুবাসনা ঠিকই পূরণ করতে পেরেছিল, তাতে মানবতা ও মানবসভ্যতার যতটা সর্বনাশই হোক না কেন। তারা গোটা ইউরোপজুড়ে ক্রুসেডের লেলিহান আগুন জ্বালিয়ে তুলতে পেরেছিল।
সর্বাত্মক জঙ্গিবাদে লিপ্ত একদিনকার ক্রুসেডার জাতি আজও সেই পুরোনো বিষ ও বিদ্বেষ আপন বুকে লালন করছে। তাদের বিশ্বাস- ইওরোপ ও আমেরিকা কেবল শ্বেতাঙ্গ খৃষ্টানদের দেশ এবং অনন্তকাল তাদেরই দেশ হয়ে থাকবে। মুসলিম নামের কোনও রাষ্ট্র এর কোথাও জন্ম নিতে পারবে না। বিক্ষিপ্ত ও বিচ্ছিন্নভাবে যেসকল মুসলিম ও অশ্বেতাঙ্গ ওখানে বসবাস করছে, যে-কোনও অজুহাতে আজ হোক বা কাল তাদের মিশ্রণ থেকে গোটা পশ্চিম দুনিয়াকে মুক্ত করতেই হবে। আজ জাতীয়ভাবে তারা সেরকম কোনও অজুহাতেরই সন্ধানে মত্ত।
সন্দেহ নেই এ অনুসন্ধান একদিন তাদের নিজেদেরই ধ্বংস করবে। ধর্মীয় ও রাজনৈতিক চরমপন্থা সৃষ্টির দ্বারা তারা যেমন বিভিন্ন মুসলিম দেশের শান্তি-শৃংখলা নষ্ট করছে এবং কোনও কোনও দেশকে অনেকটা ধ্বংসই করে ফেলেছে, তেমনি বর্ণবাদী চরমপন্থাকে উস্কানি দেওয়ার পরিণামে একদিন সমগ্র পশ্চিম দুনিয়ায়ও বিপর্যয় নেমে আসবেই। বর্ণবাদ যখন ওদের অস্থিমজ্জায় মিশে আছে, তখন একে উস্কানি দেওয়ার পরিণাম দাঁড়াবে গোটা জাতির মধ্যে হিংস্রতা ছড়িয়ে দেওয়া। সে হিংস্রতার ছোবলে আক্রান্ত জনগোষ্ঠী একদিন না একদিন রুখে দাঁড়াবেই। তারাও হিংস্রতার প্রতিশোধ হিংস্রতা দ্বারাই নিতে চাইবে। সে মহাবিপর্যয় ঠেকানোর সাধ্য কারও থাকবে কি? তা থেকে বাঁচার উপায় একটাই। আর তা শ্বেতাঙ্গ শ্রেষ্ঠত্ববাদকে আঁকড়ে ধরা নয়; বরং এ বৈষম্য থেকে মুক্ত হয়ে বর্ণসাম্যের প্রতিষ্ঠা দান করা। প্রশ্ন হচ্ছে, সে সবক তারা কোথায় পাবে? সাদা-কালোয় প্রভেদ না থাকার শিক্ষা ইসলাম ছাড়া আর কোথায় আছে?
বর্ণবৈষম্যের দৈত্যকে দমন করতে হলে ইউরোপ-আমেরিকাকে সবক নিতে হবে ইসলামের কাছেই। ইসলামই প্রকৃত মানবতার ধর্ম। এর সামনে নিজ দরজা-জানালা বন্ধ করে দেওয়ার মধ্যে কোনও কল্যাণ নেই। প্রকৃত কল্যাণ সে আলোকধারাকে নিজেদের ভেতর ঢুকতে দেওয়ারই মধ্যে। পশ্চিমা জগতের এখনও কি সে সুমতি হবে না? আজও কি ঘুচবে না তাদের দৃষ্টির অন্ধত্ব?
(সৌজন্যে- আহলে হক মিডিয়া)