মুফতি আবুল কালাম জাকারিয়া রহ এর সংক্ষিপ্ত পরিচয়
March 13 2019, 10:16
লিখেছেন-মাও. মুহাম্মাদ আতাউল কারীম মাকসুদ
হাওর-বিলে পরিবেষ্টিত জেলা, সুনামগঞ্জ। উন্নতির ছোয়া খুব একটা লাগেনি এখনো। প্রকৃতি এখানে দর্শককে কাছে টানে। সবুজ-শ্যমল বাংলাকে উপভোগ করার জন্য সুনামগঞ্জ বিখ্যাত। অনেক মহামণীষী জন্মগ্রহণ করেছেন এই সুনামগঞ্জে। মাদফুনে মক্কি হজরত শায়খে গাজিনগরি রহ., কুতবে বাঙ্গাল হজরত শায়খে কাতিয়া রহ. এখানকারই বাসিন্দা। আব্দুস সামাদ আজাদ ও বিখ্যাত হাসন রাজার নিবাস এখানেই। জানা-অজানা আরো বহু গুণীজনের জন্মস্থান হিসেবে সুনামগঞ্জ গর্বিত।
১৯৫৬ সালের ১৫ই মার্চ। স্বাভাবিকভাবেই সুর্যোদয় হয়। কিন্তু বিশ্বম্ভপুরের জনাব লালমিয়া সাহেবের পরিবার সেই সুর্যোদয় ছিল ভিন্নরকম। কারণ, তাঁর ঘরকে আলোকিত করে একটি নবজাতকের জন্ম হয়। আজকের আবুল কালাম জাকারিয়াই হলেন সেই নবজাতক। কে জানত যে, পরবর্তী জীবনে তাঁর প্রস্থানে পুরো বাংলাদেশ শোকাহত হয়ে পড়বে। দেশবাসী তাঁর ইন্তেকালে হবেন অশ্রুসিক্ত। উলামাসমাজ যার বিয়োগে হয়ে যাবেন ব্যাথাতুর। সব হারালাম, সব হারালাম, রব উঠবে যার প্রস্থানে!
সুনামগঞ্জের রামনগর মাদরাসায় কাফিয়া পর্যন্ত পড়াশোনা করেন। শরহেজামি থেকে সিলেটের বিখ্যাত দরগাহ মাদরাসায় পড়াশোনা করেন। ১৯৭৮ সালে এখান থেকেই দাওরায়ে হাদিস সমাপ্ত করেন। কৃতিত্বের সমাহার ছিল তাঁর পুরো ছাত্র জীবন। অসাধারণ মেধাবী হওয়ার পাশাপাশি ছিলেন পরিশ্রমী। এজন্য সফলতার হাতছানি পেয়েছেন তিনি। আসাতিজায়ে কেরামের স্নেহ-মমতার পরশ পেয়েই ছাত্রজীবন সমাপ্ত করেন। এদারা বোর্ডের অধীনে কেন্দ্রীয় পরিক্ষায় সর্বোচ্চ নম্বর পেয়ে প্রথম স্থান অর্জন করেন। পরীক্ষায় বুখারিতে ১০৫ নম্বর অর্জন করেন তিনি। এমন ছাত্রকে আসাতিজায়ে কেরাম ভালোবাসবেন, আগলে রাখবেন, এটাই স্বাভাবিক। তাইতো, তাঁর সকল আসাতিজায়ে কেরাম তাকে নিয়ে গর্ব করতেন। সস্নেহে কাছে ডেকে নিতেন। অধমের আব্বাজান, উসতাদুল উলামা ওয়াল মুহাদ্দিসিন, শায়খুল হাদিস আল্লামা কুতবুদ্দিন রহ, তাকে নিজ সন্তানের মত দেখতেন। আদর-সোহাগ দিয়ে তাকে গড়ে তুলেছেন।
আব্বাজান রহ. এর প্রস্তাবে দরগাহ মাদ্রসাতেই তাকে শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া হয়। প্রাতিষ্ঠানিকভাবে তিনি কোথাও ইফতা পড়েন নি। তদীয় উস্তাদ মুফতি রহমতুল্লাহ রহ, এর তত্ত্বাধানেই তিনি কিছুদিন ইফতার প্রশিক্ষণ অর্জন করেন। আর এতেই তিনি হয়ে যান বাংলাদেশের শীর্ষস্থানীয় মুফতিদের একজন। ইলমে ফিকহে তার দক্ষতা ছিল অপরিসীম। হাজারো ফতোয়া তিনি নিজ হাতে লিখেছেন। জামিআ দরগাহর দারুল ইফতা পুরো সিলেটের শেষ আশ্রয়। তিনি ছিলেন এর প্রধান মুফতি।
উসতাদদের লাজ তিনি রক্ষা করেছেন পুরো জীবন। যে পরম আস্থার বহিপ্রকাশ ঘটিয়ে তাকে শিক্ষক নিয়োগ দিয়েছিলেন তাঁরা, তিনি তার লাজ রেখেছেন। শিক্ষক হয়ে তাঁকে আর পিছনে ফিরে তাকাতে হয় নি। সফলতায় ভরপুর এক কর্মজীবন গুজরান করেছেন। পদে পদে সফলতা তাঁর হাতে ধরা দিয়েছে। বাহিরের সকল ব্যস্ততা থেকে অবসর নিয়ে কিতাবকেই গ্রহণ করেন নিজের বন্ধু হিসেবে। জামিআ দরগাহর সমৃদ্ধ কুতুবখানাতেই পড়ে থাকতেন সারাদিন। ‘কিতাবের পোকা’ বলে একটি বচন রয়েছে আমাদের প্রাত্যহিক জীবনে। তিনি ছিলেন সত্যিকার অর্থেই কিতাবের পোকা। নির্ধারিত দরস প্রদানের পর তাঁকে আর কামরায় পাওয়া যেত না। মাদ্রাসার কুতুবখানাকেই নিজের কামরা মনে করতেন। মনিমুক্তা কুঁড়াতে পড়ে থাকতেন মাদরাসার কুতুবখানাতেই। আর এভাবে তিনি নিজেই হয়ে উঠেন জীবন্ত মুক্তা। চলমান লাইব্রেরী উপাধিতে ভূষিত হয়ে যান সেই আশির দশকেই। প্রাথমিক শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ হয়ে অল্পদিনেই মাদরাসার সিনিয়র মুহাদ্দিস হয়ে যান। এক পর্যায়ে জামিআর নাজিমে তালিমাত, নায়বে মুহতামিম এর পদে উন্নীত হন। সহিহ বুখারি ও তিরমিজির দরস প্রদান করেন দীর্ঘদিন। অবশেষে ১৪৩০ হিজরির ২রা জিলকদ সর্বসম্মতিক্রমে তাঁকে জামিআর মুহতামিম হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়। মৃত্যু পর্যন্ত তিনি এ পদে বহাল ছিলেন।
জামিআ দরগাহতেই তার পড়াশোনা ও কর্মজীবন। সিলেটের বাহিরে কোথাও তিনি পড়াশোনা করেন নি। একটি প্রান্থিক অঞ্চলে শিক্ষা অর্জন করেই নিজেকে এতটা সমৃদ্ধ করে নিয়েছিলেন যে, আজকের বাংলাদেশে তার মত প্রাজ্ঞ আলেম ও বিচক্ষণ মুফতির সংখ্যা অপ্রতুল। ইলমে দীনের প্রতিটি বিষয়ে তিনি ছিলেন সমান দক্ষতার অধিকারী। যে কোনো বিষয়ে তাঁর সাথে কথা বললে মনে হত, এখনই তিনি বিষয়টি মুতালাআ করে এসেছেন। পুরো বিষয়টি রয়েছে তাঁর নখদর্পনে। হাদিসের সবকে তার অসাধারণ জ্ঞান-গরিমা দেখে হতবাক হতে হত। ফাতহুল বারি, উমদাতুল কারি, ফয়জুল বারি ইত্যাদি কিতাবগুলোর তুলনামূলক বিশ্লেষণ পেশ করতেন তিনি। জ্ঞান সাগরে ডুবুরির মত ডুবে থাকাই ছিল তার নেশা।
কোলাহলমুক্ত জীবন তিনি পছন্দ করতেন। তবে, শেষ বয়সে ব্যস্ততা পেয়ে বসে। অসাধারণ বাগ্মী ছিলেন শৈশব থেকেই। কিন্তু প্রচলিত ওয়াজ মাহফিল থেকে দূরেই থাকতেন তিনি। তবে, জীবনের শেষ দশ বছর তাকে দেখা যেত বয়ানের মসনদেও। বৃহত্তর সিলেটের সর্বোত্তম আলোচক হয়ে যান অতি অল্প দিনেই। তথ্যবহুল আলোচনা উপস্থাপন করতেন সাবলীল ভঙ্গিতে। অনেক কঠিন ও জঠিল বিষয়কে পানির মত বুঝিয়ে দিতেন। বাতিল ফিরকার খন্ডন করতেন সিদ্ধহস্তে। তবে, সচরাচর বক্তাদের ন্যায় ই‘তেদালহীন আলোচনা করতেন না। বস্তুনিষ্ট আলোচনা ও দালিলীক উপস্থাপনা ছিল তার বয়ানজুড়ে। এজন্য শীর্ষস্থানীয় মুহাদ্দিসিন ও শায়খুল হাদিসরা তাঁর বয়ানে ছাত্রদের মত বসে পড়তেন তথ্যের মুক্তা কুঁড়াতে। আবার সহজ উপস্থাপনার কারণে সাধারণ জনতাও সমানভাবে উপকৃত হতেন।
দুনিয়াবিমুখতা ছিল তাঁর জীবনের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। টাকা পয়সা জমা করা, অথবা সম্পদের পাহাড় গড়ে তুলতে হবে, ঘুর্ণাক্ষরেও কখনো তা ভাবেন নি। সাদাসিদে জীবন, অভাব অনটনই ছিল তাঁর নিত্য সঙ্গী। মহান আল্লাহ তাআলার উপর তাওয়াক্কুলই ছিল ভুষণ। পড়াশোনা ও ইলম চর্চায় মগ্ন থাকেতন সর্বদা। জানা কথা, এগুলো নিয়ে পড়ে থাকলে টাকা-পয়সা খুব একটা কামানো যায় না। কিন্তু আবুল কালাম জাকারিয়া রহ. টাকা কামানোর চিন্তা না করে নিজের ইলমি সমৃদ্ধতা ও উম্মাহর চিন্তায় ব্যস্ত থাকেতন। তাই তো, তার বিয়োগ ব্যথায় আজ বৃহত্তর সিলেট কাতর হয়ে আছে। উলামাসমাজ প্রিয়জন হারানোর ব্যাথায় শোকাতুর। এমন কান্নাভেজা জানাযা জীবনে আর দ্বিতীয়টি দেখি নি। কান্নার রোল উঠেছিল পুরো জানাযায়। কাছের ও দুরের সবার একই কথা যে, এখন আমাদের ইলমি পিপাসা নিবারণ করবে কে? গুরুত্বপূর্ণ ও জটিল মাসআলা-মাসায়েলের সমাধান দিবেন কে?
১১ই মার্চ ২০১৯ ইংরেজি। ঘনকালো একটি অন্ধকার দিন। সে দিনই ইলম ও তাকওয়ার সূর্যকে হারাতে হয়েছে । বাদ ফজর প্রায় আড়াই ঘন্টা বুখারির দরস দিয়েছেন। জোহারের আগেও হাদিসের মসনদে শোভা ছড়িয়েছেন। ছাত্রদের লিখিত ফতোয়া সম্পাদনা করেছেন। বাদ জোহর বিশ্রাম করেছেন, গোসল করেছেন। দরগাহ মসজিদের মিনার থেকে আসরের আজান পরিবেশিত হয়েছে। মহান আল্লাহ তাআলা বান্দাদেরকে তাঁর ঘরে আহ্বান করেছেন। সিলেটের ইলমি মিনার যেন সে সময় ধ্বসে পড়লো। অজু করতে যাবেন, তখনই বুকে ব্যাথা অনুভব করেন। এ্যাম্বুলেস নিয়ে আসা হলো দ্রুত। বারবার আল্লাহু আকবার বলছিলেন। কাছেই অবস্থিত হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হলো। ডাক্তার বললেন, মুফতি সাহেব চলে গিয়েছেন আল্লাহর সাক্ষাতে। সবাই মসজিদে গিয়েছেন, আর তিনি সরসারি আল্লাহ তাআলার সাক্ষাতে চলে গিয়েছেন। পরদিন সকাল এগারোটায় লক্ষাধিক মানুষের উপস্থিতিতে সিলেট আলিয়া মাদরাসা মাঠে জানাযা শেষে শাহজালাল রহ. এর মাজার সংলগ্ন কবরস্থানে তাকে সমাহিত করা হয়। জামিআ দরগাহর হিফজুল কুরআন ও দাওরায়ে হাদিসের পাশেই তার আখেরি আরামগাহ রচিত হয়।
মুফতি আবুল কালাম জাকারিয়া চলে গেছেন না ফেরার দেশে। রেখে গেছেন তিনজন ছেলে ও তিনজন মেয়ে। হাজারো উলামায়ে কেরাম। অসংখ্য গুণগ্রাহী ও ভক্তজন। রচিত, অনুদিত ও সম্পাদিত অনেক গ্রন্থ। বিখ্যাত শিক্ষাবোর্ড, আযাদ দীনি এদারার অনেকগুলো পাঠ্যবই তাঁর হাতে রচিত ও সম্পাদিত। বায়জাবি শরিফের ব্যাখ্যাগ্রন্থ ‘তাকরিরে কাসিমি’ তাঁর অনবদ্য রচনাগ্রন্থ। তাঁর অসাধারণ ইলমি যোগ্যতার প্রকাশ রয়েছে এ কিতাবে। মহান আল্লাহ তাআলা সবার প্রিয় মুফতি আবুল কালাম জাকারিয়াকে তাঁর প্রিয় করে নেন। জান্নাতুল ফিরদাউসে তাঁর নিবাস রচিত হোক।