সারা দেশের মাদ্রাসাসমূহ

হযরত মাওলানা কারী মুহাম্মাদ তৈয়ব রহ. এর জীবন দর্শন

July 18 2020, 10:15

লিখেছেন- মুহাম্মাদ সাইফুল ইসলাম ।।

বিংশ শতকের শেষভাগে ভারতবর্ষে হাতেগোনা যে ক’জন বরেণ্য মুসলিম মনীষী গত হয়েছেন, হাকীমুল ইসলাম হযরত মাওলানা কারী মুহাম্মাদ তৈয়ব রাহ. ছিলেন তাদের মধ্যে অগ্রগণ্য। বহুমুখী প্রতিভা ও গুণের সমাবেশ ঘটেছিল তার ব্যক্তিত্বে। একাধারে তিনি ছিলেন একজন সুবিজ্ঞ আলেম, বিদগ্ধ গবেষক, অসাধারণ বক্তা, শক্তিমান লেখক-রচয়িতা এবং একজন উঁচু মাপের আল্লাহওয়ালা বুযুর্গ। পাশাপাশি একজন সফল পরিচালক ও আদর্শবান মুহাতামিম। কে না জানে, হযরত কারী সাহেব রাহ. ছিলেন উপমহাদেশের ইলমে দ্বীনের সূতিকাগার দারুল উলূম দেওবন্দের পঞ্চাশ বছরের স্বনামধন্য মুহতামিম।

জন্ম ও শিক্ষা

বহু অভিধায় খ্যাত ও নানামুখী প্রতিভায় দ্বীপ্ত এ মনীষীর এক বড় পরিচয় হলো, তিনি হুজ্জাতুল ইসলাম হযরত মাওলানা কাসেম নানুতবী রহ. এর নাতি। তার পিতার নাম মাওলানা হাফেয মুহাম্মাদ আহমদ। জন্ম ১৩১৫ হিজরী মোতাবেক ১৮৯৭ ঈসায়ী। সাত বছর বয়সে তিনি দারুল উলূম দেওবন্দে ভর্তি হন। মাত্র দু’বছরে কুরআন মাজীদ হিফয করেন। তারপর পাঁচ বছর ফারসী, গণিত স্তরের শিক্ষা অর্জন করে আরবির সিলেবাস আরম্ভ করেন।

হাদীসের বিশেষ সনদ তিনি লাভ করেছিলেন তৎকালীন বিখ্যাত ওলামায়ে কেরাম ও আসাতিযার কাছে। হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ মুহাদ্দিস হযরত আল্লামা আনোয়ার শাহ কাশ্মিরী রহ. ছিলেন তার হাদীসের খাস উস্তাদ। তার অন্যান্য উস্তাদদের মধ্যে ছিলেন হযরত মাওলানা আযীযুর রহমান উসমানী, মাওলানা হাবীবুর রহমান উসমানী, আল্লামা শাব্বীর আহমদ উসমানী এবং মাওলানা আসগর হুসাইন সাহেবের মতো বিখ্যাত মনীষীগণ।

১৩৩৯ হিজরীতে শায়খুল হিন্দ হযরত মাওলানা মাহমুদুল হাসান রহ.-এর কাছে তিনি বাইআত হন। হযরতের ওফাতের পর আল্লামা আনোয়ার শাহ কাশ্মিরী রহ-এর কাছে বাইআত হয়ে আধ্যাত্মিক তরবিয়ত হাসিল করেন। তারপর ১৩৫০হি./১৯৩১ ঈসায়ীতে হাকীমুল উম্মত হযরত মাওলানা আশরাফ আলী থানবী রহ. তাকে খেলাফত প্রদান করেন।

কর্মজীবন

দরস
ফারাগাতের পর হযরত কারী মুহাম্মাদ তৈয়ব সাহেব রাহ. দারুল উলূম দেওবন্দে শিক্ষকতা আরম্ভ করেন। যদিও পরবর্তীতে বিভিন্ন ইন্তেযামী ব্যস্ততা, লেখালেখি ও দ্বীনী সফরের কারণে তাদরীসে বেশি সময় দেয়া হয়ে উঠেনি। যতদিন দারুল উলূম দেওবন্দে ছিলেন তার যিম্মায় দাওরায়ে হাদীসের মুয়াত্তা ইমাম মালেক রহ. এবং মুয়াত্তা ইমাম মুহাম্মাদ রহ. কিতাবের দরস ছিল। এছাড়া ফুনূনাতের কিতাবের মধ্যে হুজ্জাতুল্লাহিল বালিগার দরস তিনি প্রদান করতেন। হযরত কারী সাহেব রহ.-এর হুজ্জাতুল্লাহিল বালিগার দরসটি ছিল ইলমুল আসরার ও শরীয়তের রহস্যতত্ত্বের মূল্যবান গবেষণা, হিকমত ও দর্শনের দুর্লভ সমাহার।

ইহতেমাম
১৯২৪ সালের শুরুতে কারী সাহেব রাহ. কে দারুল উলূম দেওবন্দের নায়েবে মুহতামিম এবং ১৯২৯ সালে মুহতামিম করা হয়। তার আমলে দারুল উলূমে ব্যাপক উন্নতি ঘটে। মাদরাসায় বিভিন্ন বিভাগের সংযোজন, উস্তাদ ও তালিবুল ইলমদের সংখ্যাসহ অনেকগুলি শানদার ইমারত নির্মিত হয়। তিনি যখন দারুল উলূমের যিম্মাদারি গ্রহণ করেন তখন মাদরাসার বার্ষিক বাজেট ছিল পাঁচ লাখ ২২৬ রুপিয়া। যা পরবর্তীতে তার আমলেই ২৬ লাখে গিয়ে পৌঁছে। এছাড়া বহির্বিশ্বে দারুল উলূমকে পরিচিত করানো এবং বিভিন্ন ঘরানার লোকদের দারুল উলূমের কাছাকাছি আসার ক্ষেত্রে হযরতের অনবরত সফর ও হৃদয়গ্রাহী বয়ানের অনেক অবদান ছিল। দীর্ঘ পঞ্চাশ বছর যাবত হযরত কারী সাহেব রহ. যে নিয়ম, শৃংখলা ও সুচারুরূপে দারুল উলূমের ব্যবস্থাপনা পরিচালনা করেছিলেন তার দৃষ্টান্ত খুবই কম পাওয়া যায়।

বয়ান ও সফর
হাকীমুল ইসলাম হযরত মাওলানা কারী মুহাম্মাদ তৈয়ব সাহেব রহ. এর আরেকটি বৈশিষ্ট্য ছিল তার অসাধারণ বয়ান। যাদের তার বয়ান শোনার সৌভাগ্য হয়েছে তাদের বক্তব্য হলো, আমরা এমন সারগর্ভ ও গভীর মর্মবোধসম্পন্ন বয়ান কখনো শুনিনি।
হযরত মুফতী মুহাম্মাদ তকী উসমানী দা.বা. এর ভাষায়: ‘আল্লাহ তাআলা হযরতকে বয়ানের এমন বিস্ময়কর ও দুর্লভ যোগ্যতা দান করেছিলেন যার নজির খুঁজে পাওয়া মুশকিল। বাহ্যিকভাবে বয়ান ও বক্তৃতার সাধারণ পর্যায়ে গ্রহণযোগ্যতার যেসব কারণ আজকাল দেখা যায়, হযরত কারী সাহেবের ওয়াজে তার কোনটিই প্রায় ছিল না। না জোশ-গর্জন, না চটকদার বাক্যের ব্যবহার, না মুগ্ধকর কণ্ঠস্বর, না কোন সুর-টান, না বক্তাসুলভ আচরণ কোনটিই নেই। কিন্তু তা সত্ত্বেও বয়ান এতটা প্রভাব সৃষ্টিকারী, হৃদয়গ্রাহী এবং অভিভূতকারী হত যে, আম মানুষ এবং ওলামায়ে কেরাম উভয় শ্রেণি একই সঙ্গে উপকৃত হত। বিষয়বস্তু উচ্চস্তরের আলেমসুলভ, আধ্যাত্ম-বিষয়ক; কিন্তু বলার ধরণ এত সাবলীল যে, জটিল সব বিষয়ও পানি হয়ে যেত।…. তার বয়ানে সমুদ্রের উন্মত্ততার পরিবর্তে শান্ত-স্থির এক নদীর স্থিরতা বিরাজ করত, যা মানুষকে উথাল-পাথাল করার পরিবর্তে ধীরে ধীরে নিজের সঙ্গে প্রবাহিত করে নিয়ে যেত।’ (নুকূশে রফতেগাঁ)

সাধারণ শিক্ষিত লোকজন হযরতের ইলমী এবং প্রজ্ঞাপূর্ণ বয়ান দ্বারা খুবই প্রভাবিত ছিল। মুসলিম ইউনিভার্সিটি আলীগড় এবং অন্যান্য ইউনিভার্সিটিসমূহে তার বয়ান ছিল বিশেষ সমাদৃত । কিছু কিছু বিখ্যাত বয়ান হযরতের আলীগড় থেকেও প্রকাশিত হয়েছে। ভারতের কোন প্রদেশ এবং অঞ্চল এমন ছিল না যেখানে তার বয়ানের আওয়াজ পৌঁছেনি। এছাড়া বহির্বিশ্বেও তিনি আফগানিস্তান, বার্মা, আফ্রিকা, মিসর, রাশিয়া, ইতালি, ফ্রান্স ও জার্মানিসহ পৃথিবীর অসংখ্য রাষ্ট্রে দ্বীনী সফর করেছেন।

মুতালা ও লেখালেখি
দারুল উলূমের ব্যস্ততা ও বয়ান ব্যতীত আরো যে কয়েকটি বিষয়ের প্রতি হযরত কারী সাহেবের প্রবল ঝোঁক ছিল তা হলো মুতালা ও লেখালেখি। নানান ব্যস্ততা এমনকি সফরকালের অবসর সময়টুকুও হযরত এ কাজে ব্যয় করতেন।
কঠিন থেকে কঠিন বিষয়কে সহজ ভাষায় লেখার অসাধারণ দক্ষতা ছিল তার। জটিলতম বিষয়গুলোকেও তিনি সহজ ভাষায় লিখে ফেলতেন। লেখালেখির হাতেখড়ি তার তালিবে ইলমীর যামানাতেই হয়ে গিয়েছিল। তিনি ‘আলকাসেম’ পত্রিকায় লেখালেখি করতেন। ঐসময় থেকেই তার লেখক খ্যাতি।

হযরত কারী সাহেব রহ. রচিত কিতাবের সংখ্যা শ’য়ের কাছাকাছি। যা বিভিন্ন ইসলামী বিষয়বস্তুর উপর লিখিত। এযাবত ভারত-পাকিস্তানের বিভিন্ন মাকতাবা থেকে হযরতের অসংখ্য কিতাব প্রকাশিত হয়েছে। তন্মধ্যে বিখ্যাত কিছু গ্রন্থ হলো- ‘খুতবাতে হাকীমুল ইসলাম’ (৮খণ্ড), ‘খুতবাতে কাসেমী’, ইসলাম আওর মাগরিবী তাহযীব’, ‘শানে রিসালাত’, ‘খেলাফতে মুআবিয়া’, ‘সাইন্স আওর ইসলাম’, ‘আততাশাব্বুহু ফিল ইসলাম’, ‘খাতাম্মুন নাবীয়্যীন’, ‘ইসলাম মে আখলাক কা নেযাম’, ‘ফিতরী হুকুমত’, ‘ইসলাম আওর মাসীহী আকওয়াম’, ‘হাদীস কা কুরআনী মে’য়ার’, ‘কালিমায়ে তাইয়িব’, ‘হাদীসে রসূল কা কুরআনী মেয়ার’ ‘ইসলামী মুসাওয়াত’, ‘আলইজতিহাদ ওয়াত তাকলীদ’ প্রভৃতি।

অন্যান্য খিদমত
এতসব ব্যস্ততার পাশাপাশি হযরত মাওলানা কারী তৈয়ব সাহেব রহ.-এর বাইআত ও ইরশাদের ধারাও সবসময় অব্যাহত ছিল। হযরতের মুরীদানের সংখ্যা অগণিত। যাদের মধ্যে ভারত এবং ভারতের বাইরের মুসলমানরাও ছিলেন।

হযরত কারী সাহেব রহ. কে হযরত শাহ ওয়ালিউল্লাহ রহ.-এর মাসলাক ও চিন্তাধারার প্রকৃত তরজুমান এবং দাঈ মনে করা হয়। হযরতের মতামতের মধ্যে অসাধারণ ভারসাম্য থাকায় তিনি অন্যান্য ফিরকা ও দলের খণ্ডনকে কখনো বয়ানের বিষয়বস্তু বানাননি। মাসলাক ও চিন্তাগত বাড়াবাড়ি হযরতের মধ্যে ছিল না। যার ফলে ভারতের ওলামায়ে কেরাম এবং বিদ্বান সমাজ সর্বসম্মতিক্রমে তাকে ‘অল ইন্ডিয়া মুসলিম পার্সোনাল ল’ বোর্ডের সভাপতি হিসেবে নির্বাচন করেন। এমনিভাবে একই বৈশিষ্ট্যের কারণে তিনি ভারতের বিখ্যাত দ্বীনী ইদারা নদওয়াতুল ওলামা লখনৌ ও আলীগড় ইউনিভার্সিটির মতো প্রতিষ্ঠানগুলোরও রোকন ছিলেন। এছাড়াও তিনি কায়রোতে মুতামারে আলমে ইসলামী এবং মক্কা মুকাররমায় রাবেতায়ে আলমে ইসলামীর সম্মেলনে একাধিকবার অংশগ্রহণ করেছিলেন।

ইন্তেকাল
উপমহাদেশের এ বরেণ্য মনীষী হাকীমুল ইসলাম হযরত মাওলানা কারী মুহাম্মাদ তৈয়ব রহ. ছিলেন আমাদের পূর্বসূরী আকাবিরের যোগ্য আমানতদার এবং প্রতিনিধি। তিনি একাই ছিলেন একটি প্রতিষ্ঠান ও সংগঠনের তুল্য। জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত তিনি মুসলিম উম্মাহর খেদমত করেছেন। ১৯৮০ সালে দারুল উলূম দেওবন্দের জলসায়ে সদ-সালার পর থেকে হযরতের স্বাস্থ্যের অবনতি হতে থাকে।

অবশেষে আজকের এই দিনে ১৭ জুলাই ১৯৮৩ সালে (৪ শাওয়াল ১৪০৩হি.) তিনি দুনিয়া ছেড়ে আখেরাতে পাড়ি জমান। হযরতের জানাযার নামায দারুল উলূম দেওবন্দের প্রাঙ্গনে তার সাহেবযাদা হযরত মাওলানা মুহাম্মাদ সালেম সাহেব কাসেমী পড়িয়েছিলেন। হাজার হাজার মুসলমান শরীক হয়েছিল সে জানাযায়। হযরতের দাফন সম্পন্ন হয় তারই দাদা, দারুল উলূম দেওবন্দের প্রতিষ্ঠাতা, হুজ্জাতুল ইসলাম মাওলানা মুহাম্মাদ কাসেম নানুতুবী রহ.-এর কবরের পাশে।

(সূত্র: তারীখে দারুল উলূম দেওবন্দ, দারুল উলূম আওর দেওবন্দ কি তারীখী শখসিয়াত, নুকূশে রফতেগাঁ প্রভৃতি)

সৌজন্যে ইসলাম টাইমস

Spread the love