সারা দেশের মাদ্রাসাসমূহ

শায়খুল হাদীস মাওলানা তজম্মুল আলী রাহ. এর জীবনী

June 22 2020, 03:44

লিখেছেন- মাওলানা লুকমান হাকীম

দেশ ও জাতির খেদমতের জন্য যে সব মনীষী আজীবন ত্যাগ তিতীক্ষা প্রদর্শন করে জাতির সামনে উজ্জ্বল নক্ষত্র হিসাবে প্রস্ফুটিত হয়েছিলেন- তাদের মধ্যে একজন ছিলেন শায়খ মাওলানা তজম্মুল আলী লাউড়ীর হুজুর। সিলেটে জন্মগ্রহণ করে তিনি সিলেটী হতে পারেননি। কর্মজীবনের গুরুত্বপূর্ণ অংশ যশোর জেলার লাউড়ী মাদরাসায় প্রিন্সিপ্যাল ও শায়খুল হাদীস ছিলেন, তাই তাকে লাউড়ী হুজুর বলা হয়। স্বাধীন বাংলাদেশের সর্বপ্রাচীন ইসলামী দল জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম বাংলাদেশ এর ১৯৭৪ সালে কমিটি গঠিত হলে তিনি সভাপতি নির্বাচিত হন।

 জন্ম: তিনি সিলেট জেলার বিয়ানীবাজার উপজেলার পঞ্চখণ্ড পরগনার আংগুরা গ্রামের এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে ১৯১৪ সালে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতার নাম মরহুম মাওলানা শরাফত আলী।

 শিক্ষা: গ্রামের মক্তবে পবিত্র কোরআন শরীফ ও পঞ্চখন্ড প্রাইমারী স্কুলে প্রাথমিক শিক্ষা লাভ করেন। পরে মামার বাড়ীতে অবস্থান করে বাহাদুরপুর মাদ্রাসায় পড়াশুনা করেন। অতঃপর তিনি সিলেট সরকারী আলিয়া মাদ্রাসায় ভর্তি হন। সেখানে কৃতিত্বের সাথে কামিল (টাইটেল) পরীক্ষায় প্রথম বিভাগে উত্তীর্ণ হন। হয়রতের বর্নণা মতে- এ সময় কুতবে আলম হযরত শায়খুল ইসলাম হোসাইন আহমদ মাদানী রাহ. সিলেট নয়াসড়ক মসজিদে এতেকাফ করতেন। তিনি এবং তার বাল্যবন্ধু ও সাথী খলীফায়ে মাদানী আল্লামা আব্দুল জলীল বদরপুরী দু’ জন বাইসাইকেলে হযরতের খেদমতে যেতেন। এর দ্বারা হযরতের প্রতি তাদের আগ্রহ তৈরি হয়। রামাযান পর তারা দুজন ১৯৪১ সালে উপমহাদেশের শ্রেষ্ঠ ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় দারুল উলুম দেওবন্দ গমন করেন। দেওবন্দে ভর্তি হয়ে হাদীসের সর্বোচ্চ ডিগ্রী লাভ করেন। সেখানে ২ বছর সুনামের সাথে লেখাপড়া কালে উপমহাদেশের সেরা ইসলামী ব্যক্তিত্ব শায়খুল ইসলাম কুতবুল আলম আল্লামা সাইয়্যিদ হোসাইন আহমদ মদনী রাহ., শায়খুল আদব আল্লামা এজাজ আলী রাহ., আল্লামা ইব্রাহিম বলিয়াভী রাহ. প্রমুখের সাহচর্য লাভে ধন্য হন।

 কর্মজীবন: কর্মজীবনে হাদীসের দরস প্রদান ছিল শায়খ তজম্মুল আলীর রাহ. নেশা ও পেশা। দীর্ঘ অর্ধশতাব্দী কালেরও বেশি সময় পবিত্র হাদীসের খেদমত আঞ্জাম দেন। দারুল উলুম থেকে দেশে প্রত্যাবর্তনের পর প্রথমে সিলেট গোলাপগঞ্জের বারোকুট মাদ্রাসায় শিক্ষকতার মাধ্যমে তিনি কর্মজীবনের সূচনা করেন। জামেয়া কাসিমুল উলুম দরগাহে হযরত শাহজালাল সিলেট ও বিয়ানীবাজারের বাহাদুরপুর মাদ্রাসায় কিছুদিন শিক্ষকতা করেন। ১৯৪৩ সাল থেকে ১৯৮৩ সাল পর্যন্ত একাধারে ৪০বছর যশোর জেলার মনিরামপুর থানার লাউড়ী রামনগর আলিয়া মাদ্রাসায় শিক্ষকতা করেন। যশোর থেকে আসার পর ঢাকার যাত্রাবাড়ী মাদ্রাসায় সুনাম ও দক্ষতার সাথে ২বছর মুহতামিম ও শায়খুল হাদীসের দায়িত্ব পালন করেন।

 আধ্যাত্মিক সাধনা: আধ্যাত্মিকতার ক্ষেত্রে তিনি এক জন উচুঁ পর্যায়ের শায়খে তরীকত, ওলীয়ে কামেল ছিলেন। এক্ষেত্রে আধ্যাত্মিক জগতের মুকুটহীন সম্রাট আওলাদে রাসুল শায়খুল ইসলাম হযরত মাওলানা সাইয়্যিদ হোসাইন আহমদ মদনী রাহ. এর হাতে বায়আত গ্রহণ করেন। তাজকিয়ায়ে ক্বলবের মেহনতের চূড়ান্ত ফলস্বরূপ আপন শায়খ কুতবে আলম মদনী রাহ.-কর্তৃক তরীকতের ইজাযত বা খেলাফত প্রাপ্ত হন।

 হজ্ব ও ভ্রমণ: মরহুমের একমাত্র ছেলে মাওলানা আবু ছাঈদ মো. ইয়াহইয়া- কর্তৃক প্রাপ্ত তথ্য মতে ১৯৫১ সালে তিনি সর্বপ্রথম পবিত্র হজ্ব পালন করেন। অতঃপর পর্যায় ক্রমে ২৫ বার পবিত্র মক্কা মদীনা জিয়ারতের সৌভাগ্য লাভ করেন। তিনি সৌদি আরব, ইংল্যান্ড, আমেরিকা, ভারত, পাকিস্তানসহ বিভিন্ন রাষ্ট্রে তাবলীগী সফর করেন।

 রাজনৈতিক জীবন: ইসলামী আন্দোলন তথা রাজনৈতিক ময়দানে স্বীয় মুর্শিদ, স্বাধীনতা সংগ্রামের অগ্নিপুরুষ- শায়খুল ইসলাম আল্লামা সায়্যিদ হোসাইন আহমদ মাদানী রাহ. এর সার্থক উত্তরসুরি ছিলেন। তিনি জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম বাংলাদেশ এর সাথে সক্রিয় ছিলেন। বৃটিশ খেদাও আন্দোলনে ও গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন। ১৯৭৪ সালের জানুয়ারী মাসে ঢাকার দারুল উলুম মাদানিয়া যাত্রাবাড়ী মাদ্রাসায় উলামা ও সুধীবৃন্দের এক সন্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। উক্ত সম্মেলনে সর্বসম্মতিক্রমে শায়খ মাওলানা তজম্মুল আলী লাউড়ীর হুজুরকে সভাপতি এবং মাওলানা মুফতী শাহ আহরারুজ্জামান বানিয়াচঙ্গীকে সাধারণ সম্পাদক করে বাংলাদেশে প্রথম জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম গঠন করা হয়। ১৯৭৪ সালের ২৯ শে অক্টোবর পর্যন্ত তিনি সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন। অতঃপর ১৯৯০ সালে তিনি জমিয়তে উলামায়ে ইসলামের কেন্দ্রীয় প্রধান পৃষ্ঠপোষক নির্বাচিত হন। মৃত্যু পর্যন্ত তিনি এ পদে বহাল ছিলেন।

 রচনাবলী: সাহিত্যের ক্ষেত্রে আলেম সমাজের দুর্বলতার দিক নিয়ে তিনি ভাবতেন। ইসলামী সাহিত্য সংস্কৃতি চর্চার জন্য সাগরিদদের পরামর্শ দিতেন। ছাত্রদের মধ্যে লেখা-লেখির উৎসাহ-প্রেরনা দিতেন। এ ক্ষেত্রে নিজেও সচেষ্ট ছিলেন। শায়খুল হাদীস উবায়দুল্লাহ ফারুক বলেন- ‘লাউড়ি হুজুর একজন দক্ষ সংগঠক ও ভাল সাহিত্যিক ছিলেন’। তিনি একজন লেখক হিসেবে পরিচিত। তার লিখিত প্রথম বই হলো- ১. ‘গোমর ফাঁক। ২. মাকামে আম্বিয়া ও সাহাবা।
৩. মোনাজাতে মকবুল। ৪. সালাসিলে ত্যায়্যিবা (বাংলা)। ৪. তিনি শেষ জীবনে তার একটি আত্মজীবনী ও লিখেছিলেন যার কিছু কিছু আমাদেরকে পড়ে শুনিয়েছিলেন।

 সন্তানাদি: পারিবারিক জীবনে তিনি ২ সন্তানের জনক। যথাক্রমে: রায়হানা বেগম ও মাওলানা আবু ছাইদ মো. ইয়াহইয়া। একমাত্র মেয়ে রায়হানা বেগমের সাদী হয় জকিগঞ্জের শাহবাগে এবং একমাত্র পুত্র মাওলানা আবু ছাইদ মো. ইয়াহইয়া ১৯৫১ সালে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি কুয়েতে কর্মরত অবস্থায় গত ১৩.০৮.২০০৫ সালে ইন্তেকাল করেন। তিনি ৫ ছেলে ও ২ মেয়ে রেখে যান। ছেলেরা হলেন- আবুল কালাম, আবু তাহের, আবু নাসের, আবু নাঈম ও আবু ছালিম।

 শাগরিদ: দীর্ঘ অর্ধশতাব্দী কাল শিক্ষকতার জীবনে হযরত লাউড়ী হুজুর রাহ. অসংখ্য ছাত্র, উক্ত শাগরিদ রেখে গেছেন। কাজী মুতাসিম বিল্লাহ রাহ. বলেন- হুজুরের শাগরিদের সংখ্যা ২০ হাজারেরও বেশি। বাংলাদেশ কওমী মাদ্রাসা শিক্ষাবোর্ড আযাদ দ্বীনী এদারায়ে আলিমের মহাসচিব মাওলানা হুছাইন আহম্মদ বারোকুটি, শায়খুল হাদীস মুফতী মো. ওয়াককাস এম. পি., ঢাকা মালিবাগ মাদ্রাসার প্রিন্সিপাল মাও. কাজী মুতাসিম বিল্লাহ রাহ., মাওলানা কমর উদ্দীন আগিরামী রাহ., মাওলানা শাহ ইউনুস, মাওলানা আব্দুল হামিদ বারোকুটি, সিলেট দরগাহ মাদ্রাসার মুহতামিম মাওলানা আব্দুল হান্নান রাহ. প্রমূখ তার ছাত্রদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য।

 খলীফা: তিনি যাদেরকে খেলাফত প্রদান করেছেন তারা হলেন:- মাওলানা ফরীদ উদ্দীন- যশোর, মাওলানা জালাল উদ্দীন রাহ.,যশোর, মাওলানা ইউসুফ রাহ. যশোর, মাওলানা কাজী মুতাসীম বিল্লাহ রাহ. মুহতামিম ও শায়খুল হাদীস জামিয়া শরইয়াহ মালিবাগ- ঢাকা, মাওলানা মুফতী মুহাম্মদ ওয়াক্কাস এম. পি, মুফতী আব্দুল মজীদ- যশোর, মাওলানা শিহাবুদ্দীন- যশোর, মাওলানা ঈমান আলী – যশোর, মাওলানা আব্দুল মান্নান রাহ.- খুলনা, মাওলানা রফিক উল্লাহ- যশোর, মাওলানা আব্দুল আলিম দেওবন্দী, কুড়িগ্রাম।

 ব্যক্তিত্ব: তিনি যশোরে অত্যন্ত মর্যাদাবান ব্যক্তিত্ব ছিলেন। মুফতী ওয়াক্কাস সাহেব প্রথম যখন সংসদ নির্বাচনে প্রার্থী হন তখন তিনি প্রত্যেক এলাকায় সফর করেছেন। তার উপস্থিতি ও বয়ান মুফতী সাহেব নির্বাচিত হবার প্রধান শক্তি ছিল। হুজুরের বর্নণামতে এই খবর গুয়েন্দাসূত্রে তৎকালিন প্রেসিডেন্ট এরশাদের কাছে পৌঁছে। লাউড়ি হুজুর তখন সিলেটের তার গ্রামের বাড়ী আঙ্গুরাতে অবস্থান করতেন। প্রেসিডেন্ট এরশাদ সিলেট সার্কিট হাউসে হুজুরকে যথা সম্মানে আমন্ত্রণ করে মুফতী সাহেবকে জাতীয় পার্টিতে যোগ দেয়ানোর আবেদন করেন। হুজুর সম্মত হওয়ায় তাকে ধর্মপ্রতিমন্ত্রী বানানো হয়।

 ইন্তেকাল: ২০০৬ ঈসায়ী সালের ৪ঠা ফেব্রুয়ারী, ২২শে মাঘ ১৪১২ বাংলা, রোজ শনিবার রাত ৯.৩০ মিনিটে সিলেট শহরে তার নিজস্ব বাস ভবন ‘‘মদনী মঞ্জিল ২০/৩ ফাজিল চিশত’’-এ-র্বার্ধক্যজনিত কারণে ইন্তেকাল করেন। পরদিন রবিবার বেলা ২.৩০ মিনিটের সময় সিলেট সরকারী আলিয়া মাদ্রাসা মাঠে তাঁর জানাযা অনুষ্ঠিত হয়। জানাজার ইমামতি করেন তার খলীফা ও প্রিয় ছাত্র জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় মহাসচিব ও ধর্ম প্রতিমন্ত্রী (সাবেক) শায়খুল হাদীস মাওলানা মুফতী মুহাম্মদ ওয়াক্কাস এম. পি.। জমিয়তে উলামায়ে ইসলামের কেন্দ্রীয় সভাপতি শায়খুল হাদীস মাওলানা আব্দুল মোমিন শায়খে ইমামবাড়ী, খলিফায়ে মদনী শায়েখ আব্দুল হক গাজীনগরী, আল্লামা আমীন উদ্দীন শায়খে কাতিয়া, আযাদ দ্বীনী এদারায়ে তালীম বাংলাদেশের মহাসচিব মাওলানা হুছাইন আহমদ বারকুটি, লাউড়ী মাদ্রাসার প্রিন্সিপাল মুফতী আব্দুল ওয়াদুদ, মাওলানা কাজি মুতাসিম বিল্লাহ প্রমুখ জানাযায় উপস্থিত ছিলেন। পরে তাকে তার পারিবারিক কবরস্থান আঙ্গুরায় দাফন করা হয়।

 মহান আল্লাহপাক তাঁকে উত্তম জাযা: জান্নাতুল ফিরদাউস দান করুন। আমীন।

Spread the love